ফাতেহা ই ইয়াজদহম : চার
তাঁর নাম শাহ্ মাখদুম জালাল উদ্দীন রূপোশ। অন্যত্র তাঁর নাম আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, ‘তাঁর নাম সায়্যিদ আবদুল কুদ্দুস। শাহ্ মাখদুম রূপোশ নামে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। ‘শাহ্’ মাখদুম, ‘রূপোশ’ এগুলো তাঁর লকব বা উপাধি।
হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ ৬১৫ হিজরির ২ রজব মোতাবেক ১২০৮ খৃস্টাব্দে বাগদাদ নগরীতে পিতৃগ্রহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত আযাল্লাহ্ শাহ্ । আযাল্লাহ্ শাহ্ ছিলেন আবদুল কাদের জিলানীর ২৭ পুত্রের একজন। শাহ্ মাখদুম রূপোশ ছিলেন আযাল্লাহ্ শাহ্-এর দ্বিতীয় পুত্র।
আবদুল কাদের জিলানীর কারামত জন্মলগ্ন থেকে একে একে বিকশিত হয়েছে। আবদুল কাদের জিলানী ৪৭০হিজরীতে (১০৭৫খ্রিষ্টাব্দ) পবিত্র রমজান মাসের জুমার দিন এই ধরণীতে তাশরীফ আনেন। “মানাকেবে মিরাজিয়া” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, আবদুল কাদের জিলানী জন্মকালীন তাঁর চেহারা প্রতিভাত হচ্ছিল যেন চন্দ্রের কিরণ। মনে হয়েছিল সমগ্র ঘর উদ্ভাসিত হয়ে গেছে চাঁদের আলোয়।
তাঁর পিতার নাম আবু ছালেহ মূসা জঙ্গী এবং তাঁর মায়ের নাম উম্মুল খায়ের ফাতিমা। “আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁ বেরলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত “হাদায়েক্বে বখশীশ” কাব্যগ্রন্থে’ সুন্দর বলেছেন –
“আপনি কেন হাসানী এবং হুসাইনী আর মহিউদ্দীন হবেন না?
যেহেতু আপনার বংশধারা দুই সাগরের সাথে মিলিত হয়েছে।”
আবদুল কাদের জিলানীর জন্মের সময় অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যখন দুনিয়ার বুকে তশরীফ আনেন তখন তাঁর মায়ের বয়স ছিল ষাট। যে বয়সে সাধারণত মহিলাদের গর্ভধারণের ক্ষমতা লোপ পায়। এটাও গাউছে পাকের এক বৈশিষ্ট্যের কারণে যা আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে পেয়েছেন।
আবদুল কাদের জিলানী মানুষের কাছে মাহবুবে সুবহানী, কুতুবে রাব্বানী, গাউসুল আজম, গাউসুস সাক্বলাঈন, মহিউদ্দীন এবং সায়্যিদুল আউলিয়া হিসেবে পরিচিত। হযরত আল্লামা আবদুর রহমান জামী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন –
“আঁ শাহ্-এ-ছরফরাজ কে গাউসুস সাক্বলাঈন আস্ত”
অর্থাৎ তিনিই উচ্চ মর্যাদাবান বাদশাহ্ যিনি গাউসুস সাক্বলাঈন নামে জগতে পরিচিত।
মানাকেবে গাউসিয়া নামক কিতাবে শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন– আবদুল কাদের জিলানীর জন্মের সময় গায়েব হতে পাঁচটি আজিমুশ্শান কারামত প্রকাশ পেয়েছে।
১. যে রাত্রিতে গাউসে পাক জন্মলাভ করেন সে রাতে তাঁর পিতা স্বপ্নে দেখলেন, সরওয়ারে কায়েনাত, ফখরে মওজুদাত, আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে সাথে নিয়ে তাঁর ঘরে তশরীফ আনলেন এবং ঐ ঘরে সমস্ত ইমাম ও আউলিয়ায়ে কেরাম উপস্থিত। রাসূল তাকে সম্বোধন করলেন-
“হে আবু ছালেহ! আল্লাহ্ তোমাকে এমন এক সন্তান দান করেছেন যিনি অলিকুল শিরোমনি এবং আমার সন্তান। সে আমার এবং আল্লাহর বন্ধু। অচিরেই তাঁর মর্যাদা অলিদের এবং কুতুবদের মধ্যে এমন হবে যেমন আমার মর্যাদা অন্যান্য নবীদের উপর।”
কবি সুন্দর বলেছেন-
গাউসে আজম দরমিয়ানে আউলিয়া
চুঁ জনাবে মুস্তফা দর আম্বিয়া।
অর্থাৎ নবীগণের উপর রাসূলেরর যে ফজিলত, গাউসে পাকেরও অন্যান্য অলিদের উপর সেই ফজিলত।
আল্লাহর রাসূলের এই বাণীর দিকে ইঙ্গিত করে আ’লা হযরত বলেন –
জো অলী কব্ল থে ইয়া বা’দ হুয়ে ইয়া হোঙ্গে
ছব আদব রাখতে হ্যাঁয় দিল মে মেরে আক্বা তেরা।
অর্থাৎ যে সমস্ত অলি গাউসে পাকের আগে এবং পরে হয়েছেন সবাই তাঁদের অন্তরে আমার গাউসে পাকের মুহাব্বত রাখেন।
২. গাউসে পাকের জন্মের সময় দেখা গেল তাঁর কাঁধের উপর রাসূলের পবিত্র কদম শরীফ (অর্থাৎ পদচিহ্ন) ছিল। যা তাঁর অলীয়ে কামিল হওয়ার সুস্পষ্ট দলিল বহন করে।
৩. গাউসে পাকের পিতাকে আল্লাহ্ স্বপ্নে সুসংবাদ দিলেন যে, তোমার যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তিনি সমস্ত অলিদের বাদশাহ্ হবেন। যারা তাঁর বিরোধিতা করবে তারা পথভ্রষ্ট এবং ধর্মহারা হবে।
৪. যে রাতে গাউসে পাক জন্মগ্রহণ করেন সে রাতে জিলান শহরের যে সমস্ত মহিলা সন্তান প্রসব করেন তারা সবাই আল্লাহর ইচ্ছায় ছেলে সন্তানের জন্ম দেন এবং পরবর্তীতে সেসব ছেলে সন্তান আল্লাহর অলি হয়েছেন।
৫. গাউসে পাকের জন্ম মাস ছিল রমজানুল মোবারক। তিনি সে দিন থেকে রোযা রাখা আরম্ভ করলেন। সেহ্রী থেকে ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত কিছুই খেতেন না। তাঁর পিতা বর্ণনা করেন- আমার সন্তান যখন দুনিয়ার মধ্যে তশরীফ আনেন তখন রমজান মাস ছিল। সারাদিন দুধ পান করতেন না।
তাঁর জন্মের দ্বিতীয় বৎসরে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় রমজানের চাঁদ দেখা যায়নি। তাই লোকজন আমার ঘরে এসে এ ব্যাপারে জানতে চাইলেন। তখন আমি তাদেরকে বললাম- আমার আবদুল কাদের আজ দুধ পান করেনি। এরপর তৎকালীন ইমামগণ ঐক্যমতে পৌঁছলেন যে, নিশ্চয়ই আজ রমজানের দিন।
গাউসে পাক কিছুদিন পর তাঁর প্রিয় পিতাকে হারান। সে সময় তাঁর প্রিয় নানা তাঁর কর্তৃত্বের ভার নেন। তাঁর নানা ছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত বুজুর্গ ব্যক্তি। তিনি তাঁর পবিত্র নাতিকে অলিয়ে কামেল করার জন্য দোয়া করলেন।
ছোটবেলা থেকে গাউসে পাক খেলাধুলা থেকে বিরত থাকতেন। অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জীবনযাপন করতেন। অতিরিক্ত কথাবার্তায় বলতেন না। গাউসে পাক বলেন– আমি যখন অন্যান্য ছেলেদের সাথে খেলা করার ইচ্ছা করতাম তখন আল্লাহ্ অদৃশ্যে থেকে বলতেন– হে আবদুল কাদের! খেলাধুলা থেকে বিরত থাক। (খোলাছাতুল মফাহির)
যখন তিনি পড়ার উপযুক্ত হলেন, তখন তাঁকে মক্তবে ভর্তি করানো হয়েছিল কোরআনুল করীম পড়ার জন্য। উস্তাদের সামনে তিনি নম্রতার সাথে বসলেন, উস্তাদ বললেন- পড়ুন! “বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম”।
একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ আওয়াজ এল– “মা লিহাজা খুলিক্বতা ওয়ালা বিহাজা উমিরতা” অর্থাৎ হে আবদুল কাদের! আপনাকে এজন্য সৃজন করা হয়নি। কথা শুনার পর তাঁর অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বত যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আঁছড়ে পড়ছিল।
তিনি বিসমিল্লাহ্ এর সাথে সূরা বাক্বারার শুরু থেকে পড়তে আরম্ভ করেন। উস্তাদ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কী ব্যাপার? তিনি উত্তর দিলেন হে প্রিয় উস্তাদ, আমিতো এই কোরআন আমার মায়ের মুখে মুখে গর্ভাবস্থায় শিখেছি (সুবহানাল্লাহ্)।
হুজুর গাউসে পাক বলেন- আমি যখন মাদ্রাসায় যেতাম তখন এক ফেরেশতা আমার সাথে থাকতেন এবং আমাকে দিক নির্দেশনা দিতেন। (কালায়েদে জাওহার)
হুজুর গাউসে পাক বলেন– এক ফেরেশতা আমার সাথে সাথে চলতে চলতে গন্তব্য স্থানে গিয়ে বলেন- হে লোকেরা আল্লাহর অলীর জন্য জায়গা করে দিন যাতে তিনি বসতে পারেন। অন্যান্য ফেরেশতা ঐ ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি কে? ফেরেশতা জবাবে বলেন- তিনি হলেন অলীদের সরদার। (বাহজাতুল আসরার)
হযরত আবদুল কাদের জিলানী জিলানের এক মকতবে অধ্যয়নরত ছিলেন। ইত্যবসরে তাঁর কফিল (অভিবাভক) নানাজান ইহজগৎ ত্যাগ করেন। তখন তাঁর সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব বর্তায় তাঁর মায়ের উপর।
একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ আওয়াজ এল– “মা লিহাজা খুলিক্বতা ওয়ালা বিহাজা উমিরতা” অর্থাৎ হে আবদুল কাদের! আপনাকে এজন্য সৃজন করা হয়নি। কথা শুনার পর তাঁর অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বত যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আঁছড়ে পড়ছিল।
এরপর তিনি আল্লাহ্কে পাবার জন্য মুরাকাবা, মুশাহাদায় লিপ্ত হয়ে যান এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে শরীয়ত ও তরীক্বতের কাজ করার লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেন।
(সমাপ্ত)
……………….
পুনপ্রচারি বিনীত : নূর মোহাম্মদ মিলু
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
………………………..
আরো পড়ুন:
ফাতেহা ই ইয়াজদহম : এক
ফাতেহা ই ইয়াজদহম : দুই
ফাতেহা ই ইয়াজদহম : তিন
ফাতেহা ই ইয়াজদহম : চার
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন