ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ বিবর্তন সৃষ্টিতত্ত্ব

-ড. এমদাদুল হক

৩১
সাধনা অর্থ ঈপ্সিত বস্তু লাভের প্রচেষ্টা। সাধনা বা প্রচেষ্টা শুরু করার আগে ‘কী চাই’ তা স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। “কী চাই”- সহজ বাংলায় এটি হলো ভিশন। যা চাই, তা পাওয়ার মাধ্যম হলো মিশন। ভিশন হলো কিবলা, দিক। মিশন হলো মাধ্যম, উদ্দেশ্য।

মিশন এমনকিছু যেখানে পৌঁছানো যায়। ভিশনে পৌঁছানো যায় না, কিন্তু প্রত্যেকটি মিশন হওয়া চাই ভিশনমুখী। ভিশন হলো দিকদর্শন। যেমন, পশ্চিম দিক। যত পশ্চিমেই যাই না কেন আরো পশ্চিম বাকি থাকে। ডাক্তার হওয়া মিশন। মানবতার সেবা ভিশন। ডাক্তার হলাম- মিশন সাকসেসফুল। কিন্তু মানবতার সেবা? এর শেষ নেই।

মিশন হলো মাধ্যম, যা জীবন চলার পথে বারবার পরিবর্তন করতে হয়। আমি অমুক গুরুর ছাত্র হতে চাই। কেন চাই? কারণ- জ্ঞান চাই। জ্ঞান হলো ভিশন। গুরু হলো জ্ঞান অর্জনের একটি মাধ্যম বা একটি মিশন।

জীবন চলতে থাকে একটি মিশন থেকে আরেকটি মিশনে- ভিশনের দিকে, ভিশনের টানে। এমন কোনো স্থান নেই যেখানে পৌঁছে বলা যাবে- ‘আমার ভ্রমণ শেষ হয়েছে”। ভিশনে পৌঁছানো যায় না। তথাপি, ভিশন ছাড়া মিশন অর্থহীন।

মিশন বদলানো যায়, কিন্তু ভিশন বদলানো যায় না। নতুন মিশন নির্ধারণ করা যায়, কিন্তু নতুন ভিশন নির্ধারণ করা যায় না। ভিশন জীবনের শুরু থেকে জীবনের সঙ্গেই থাকে। শুধু উপলব্ধি করতে হয় যে, এটি আছে।

ভিশন প্রেমের মতো। প্রেম আমরা সৃষ্টি করি না। শুধু বুঝতে পারি যে, এটি আছে, সর্বদাই ছিল। বুঝার জন্য নিজেকে সময় দিতে হয়। ভিশন স্পষ্ট হলেই কেবল বুঝা যায়- জীবন নিরর্থক নয়।

কোনটি ভিশন আর কোনটি মিশন; কোনটি কিবলা আর কোনটি মাধ্যম- এটিই যে বুঝতে না পারে, সে জীবন চলার পথে উদভ্রান্ত পথিক।

উদভ্রান্ত পথিক মিশনকেই ভিশন বানিয়ে নেয়। মাধ্যমকেই যে কিবলা বানিয়ে নেয়, সে অসীমকে সীমায় বদ্ধ করে ফেলে; ফলে তার জ্ঞানপথের যাত্রা অচিরেই সমাপ্ত হয়ে যায়। সে আজীবন এক বইয়ের পাঠক থাকে এবং ভিশনে পৌঁছে যাওয়ার অহংকার প্রদর্শন করে।

৩২
যেই রোগী সুস্থ হতে চায়, কিন্তু ওষুধ খেতে চায় না, ডাক্তারের পরামর্শ মানতে চায় না- তাকে যদি উন্মাদ বলা যায়, তবে আমরা সবাই কম-বেশি উন্মাদ।

আমরা সুস্থ থাকতে চাই, কিন্তু আহার, নিদ্রা, মৈথুনে শৃঙ্খলা আনতে চাই না; ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই না, শরীরচর্চা করতে চাই না।

আমরা সুখী হতে চাই, কিন্তু ঈর্ষা ছাড়তে চাই না; প্রেমিক হতে চাই, কিন্তু হিংসা ছাড়তে চাই না; দয়ালু হতে চাই, কিন্তু ক্রোধ ছাড়তে চাই না।

আমরা জ্ঞানী হতে চাই, কিন্তু ধর্মান্ধতা ছাড়তে চাই না; সাঁতার শিখতে চাই, কিন্তু পানিতে নামতে চাই না। শুধু চাইলেই পাওয়া যায় স্বর্গলোকে? মর্ত্যলোকে চাওয়ার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হয় নিরন্তর কর্ম সাধনায়। অবিরাম লেগে থাকতে হয়- দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।

জীবনবৃক্ষে ‘কর্মফল’ আছে- ‘প্রার্থনাফল’ নাই। প্রার্থনা মৃতদের জন্য-জীবিতদের জন্য কর্ম। চাওয়া যদি আন্তরিক হয়, তবে অবশ্যই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলো পাওয়ার উপায় অনুসন্ধান করবে। কর্মেন্দ্রিয়গুলো তা বাস্তবায়নে লেগে যাবে; শয়নে, স্বপনে, জাগরণে চিন্তার কেন্দ্রে অবস্থান নিবে ঈপ্সিত।

ঘৃতপুষ্ট অগ্নির ন্যায় ঈপ্সা জ্বলতে থাকবে অস্তিত্বের অলিগলিতে; ছড়িয়ে পড়বে- আবেগে, অনুভূতিতে, কথায়, অঙ্গভঙ্গিতে, পোশাকে, চলনে, বলনে।

সব শক্তি যদি একটি ধারায় প্রবাহিত হয়, তবে যে যা চায় তা পাবেই, তদসঙ্গে তার কাছে উন্মুক্ত হবে জগৎ ও জীবনের রহস্য।

যে যা চায়, তার মধ্যেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা চাই। কর্ম ও কর্তার পার্থক্য যেন না থাকে। তাহলে নিজের অজান্তেই উৎপন্ন হয় একাত্মতা- উদ্ভাসিত হয় সত্য।

৩৩
জীবন মানেই শেখা। জন্মের পর থেকেই আমরা শিখতে শুরু করি। বসতে শিখি, হাঁটতে শিখি, খেতে শিখি, দৌড়াতে শিখি, খেলতে শিখি, বলতে শিখি। জীবনের চেয়ে বড় কোনো শিক্ষাগুরু নেই। জীবন একই বিষয় বারবার শেখায়, সবদিক থেকে শেখায়। যতক্ষণ শেখা পূর্ণ না হয় ততক্ষণ জীবন শেখানোর একটি সুযোগও ছাড়ে না।

জীবন কোনো অধ্যায় বাদ দেয় না। যথা সময়ে যথা অধ্যায়ের পাঠ দান করে। জীবনের প্রতিটি স্পন্দন পাঠ্য। সময় কখানো শূন্য হাতে আমাদের সম্মুখে আসে না। সময়ের সঙ্গে থাকে জ্ঞান।

তথাপি আমরা অজ্ঞানী কেন? কারণ পর্যবেক্ষণ নেই, মনোযোগ নেই। শেখার শস্ত্র হলো পর্যবেক্ষণ, মনোযোগ। আমরা জীবিকা অর্জন করতে শিখি- বাঁচতে শিখি না। কারণ আমাদের মনোযোগ জীবিকার দিকে থাকে- জীবনের দিকে নয়।

জীবিকা অর্জনের শিক্ষাকেই আমরা শিক্ষা বলি। আর এই শিক্ষাই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কেড়ে নেয়। এখন শিক্ষার মূল বিষয়- পরীক্ষা পাস করা। গুরুত্ব পরীক্ষা পাসের দিকে, সার্টিফিকেটের দিকে- শিক্ষার দিকে নয়।

এতো পরীক্ষা কেন? পরীক্ষা মানে চাপ। আমাদের শিক্ষাবিদরা ধরেই নিয়েছে- ছাত্রদের যত চাপে রাখা যাবে, তারা ততবেশি শিখবে। তাই বিরামহীন পরীক্ষার চাপ দেওয়া হচ্ছে। চাপের ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করছে কিন্তু শিখছে না কিছুই। সব চাপের সঙ্গে ইদানিং যুক্ত হয়েছে এক উদ্ভট চাপ, যার নাম- “সৃজনশীল চাপ!”

হায়রে শিক্ষালয়! হায়রে হতভাগা মানবসন্তান! বাস্তবে শেখা তখনই সম্ভব, যখন মন সব ধরনের চাপ থেকে মুক্ত থাকে।

৩৪
আমরা শিখতে পারি না, কারণ চাপমুক্ত হতে পারি না। মানুষ এমন এক সমাজ তৈরি করেছে, যে সমাজে চাপমুক্ত থাকার উপায় নেই।

কর্মক্ষেত্রে বসের চাপ, বাসে যাত্রীর চাপ, বাসায় স্ত্রীর চাপ, স্কুলে কোচিং চাপ। পানি গ্যাস বিদ্যুৎ চাল ডাল তেলের চাপ তো আছেই এর উপর ইদানিং যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গুর চাপ।

ক্ষুধা-তৃষ্ণা, কামনা-বাসনা, ঠাণ্ডা-গরম এসব জৈবিক চাপ তো থাকবেই। উচ্চাকাঙ্খা, ব্যর্থতা, হতাশা, পরশ্রীকাতরতা, কাম ও লোভজনিত মানসিক চাপ থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু এইসব স্বাভাবিক চাপই রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়।

নানাবিধ চাপে অস্থির মানুষ অবিরাম চাপ উৎপন্ন করে যাচ্ছে। চাপাক্রান্ত মানুষ অহেতুক রেগে যায়, ফলে চাপের সামষ্টিক পরিমাণ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়।

ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, গুগলের চাপে বীর বাঙালির মিটিং, মিছিল, হরতাল, গণতন্ত্র এমনকি ঘরোয়া রাজনৈতিক তৎপরতাও এখন চাপা পড়ে গেছে। আছে শুধু টকশোর চাপাবাজিটা।

চাপাক্রান্ত মানুষ শিখবে তো দূরের কথা- শেখার আগ্রহই হারিয়ে ফেলে। অতিচাপে রসবোধ, মননশীলতা, সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা মরে যায়। দেখা দেয় দুঃশ্চিন্তা, বিষণ্নতা।

অতি চাপে দিশাহারা হয়ে কিছু মানুষ, একটু শান্তির আশায় দরবারে যায়। ওখানে শুরু হয় অনুষ্ঠানের চাপ: সাপ্তাহিক মিলাদ, জন্মদিন, মৃত্যুদিন, খেলাফত প্রাপ্তি দিবস, প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, এগারো শরীফ, ফল ফাতেহা, ফুল শুভেচ্ছা, রজব- এরকম বার মাসে তের হাজার চাপ। অতি চাপে অস্থির এই মানুষগুলোকে তাড়া করে জীবনের দুঃস্বপ্ন- সারাদিন চোখ কচলায়, যেন কাঁদুনি গ্যাসের কুণ্ডুলি থেকে বেড়িয়ে এসেছে!

এসেছিলাম সত্যের খুঁজে। পাইলাম কি? অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের চাপে, শেখার শেষ ইচ্ছাটাও নিভে যায়। শেখার জন্য চাপমুক্তির গুরুত্বটি বুঝা চাই। যখন কিছু একটা হওয়ার বাসনা নেই, কিছু করার বা বুঝার প্রচেষ্টা নেই, হতাশা নেই, আশা নেই, পূর্ব ধারণা নেই, যখন মন সকল চাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, তখনই দেখা যায় জ্ঞানের ঝিলিক।

৩৫
শিক্ষার নামে এখন যেখানে যেখানে যা কিছু হচ্ছে তার প্রায় সবটিই ব্যবসা। শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর অবস্থান ভিন্ন। যে শিক্ষক নৈতিকতা শিক্ষা দিচ্ছেন তার জীবনযাপনে কোনো নীতি নাই। নৈতিকতা তার কাছে একটি সাবজেক্ট মাত্র।

শিক্ষা, শিক্ষকের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই শিক্ষার্থীরা কিছু নীতিবাক্য মুখস্থ করছে বটে, কিন্তু জীবনে ধারণ করছে না। মিথ্যাবাদীর কাছ থেকে সত্য বলার উপদেশ কেউ ধারণ করে না।

যে শিক্ষক কোচিং বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য করছে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার অধিকারই তার নেই। একইভাবে যে গুরু ধর্মব্যবসা করছে, তার অধিকার নেই ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার।

প্রকৃত শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়- এটি একটি অন্তরঙ্গ ক্রিয়া। এখানে শ্রম এবং পারিশ্রমিক মূল বিষয় নয়- আন্তরিকতাই মূল বিষয়।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কিংবা গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক দাস-মালিকের সম্পর্ক নয়-সখার সম্পর্ক। কেন? কারণ শিক্ষকও শিখছেন। শিক্ষক নিজেও একজন ছাত্র। শিক্ষা একটি অন্তহীন অবিরাম প্রক্রিয়া। জগতে এমন কোনো শিক্ষক নেই, যিনি বলতে পারবেন, তার শিক্ষা সমাপ্ত হয়ে গেছে।

কিতাবে লেখা থাকে কিছু তত্ত্ব ও তথ্য। শিক্ষক তত্ত্বও নয়- তথ্যও নয়। শিক্ষক হলো প্রমাণ। শিক্ষকের কাজ তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করা নয়- জীবন্ত প্রমাণ উপস্থাপন করা। সুতরাং যে যেই বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছে সে স্বয়ং যদি সেই বিষয়ের প্রমাণ না হতে পারে, তবে শিক্ষাদান থেকে বিরত থাকুক।

তথ্য মুখস্থ করার জন্য শিক্ষকের দরকার নাই, বিশেষ করে তা যদি ধর্মীয় শিক্ষা হয়। শাস্ত্র কচলানোর জন্য গুরুর দরকার নাই, বিশেষ করে তা যদি আধ্যাত্মিক শিক্ষা হয়।

শাস্ত্র মুখস্থ কর, ব্যাখ্যা কচলাও। কিছুই হবে না। ধর্ম হলো ফলিত যোগ। জীবনযাপন বদলাও, আচরণ বদলাও, অভ্যাস বদলাও। সব হবে।

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!