ফাতেহা ই ইয়াজদহম : তিন
ইসলাম প্রচারে অবদান :
বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে সুফিয়ায়ে কেরামের ভূমিকা সর্বজনবিধিত। তাঁরা তাঁদের উন্নত চরিত্র, উদার ভাবধারায় এত সহজে মানুষের অন্তরকে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা শক্তি ও তলোয়ারের মাধ্যমে সম্ভব হয়নি ও হবেও না।
মানবজাতির হেদায়তের ক্ষেত্রে তাদের দু’টি দিক সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য। একদিকে আদর্শ, উন্নত চরিত্র, উদারতা, সর্বসাধারণের সাথে মেলামেশা, বিনম্র মনোভাব, উত্তম মুয়ামালা ইত্যাদিতে তাঁরা ছিলেন অদ্বিতীয়। ফলে তাঁরা খুব সহজে খুব দূরের মানুষকে কাছে আনতে এবং শত্রুকেও বশ করতে সক্ষম ছিলেন। যেমনটি দেখা যায় আবদুল কাদের জিলানীর জীবনে।
অন্যদিকে তাঁদের ওয়াজ-নসিহতের মাহফিল ও বৈঠক, যাতে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল উম্মুক্ত। ফলে তাঁদের আলোচনা দ্বারা মানুষের জীবনে এক আমুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো। আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুল কাদের জিলানী।
প্রাথমিকভাবে মজলিস আরম্ভ হয়েছিল দুই তিন জনকে নিয়ে, কিন্তু তাঁর মধুরবাণী ও সুমিষ্ট ওয়াজ-নসিহতে মানুষ বিমুগ্ধ হয়ে দলে দলে লোক আসতে শুরু হলো। এমনকি তাঁর এক একটি মজলিসে সত্তর হাজারেরও অধিক মানুষ অংশগ্রহণ করতো।
আবদুল কাদের জিলানী শুধুমাত্র উন্নত আদর্শ, উদারতা, মানবপ্রেম, ওয়াজ নসিহত ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেননি বরং বিশ্বব্যাপী ইসলামের আলো বিতরণ করার জন্য তাঁর খলীফা, মুরিদ ও শিষ্যদের নিয়ে এমন একটি জামাত গঠন করেন যারা দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। তাঁদের একটি দল আবদুল কাদের জিলানীর জীবদ্দশায় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন।
তাঁর মাদ্রাসায় বসার জায়গা সংকুলান হচ্ছিলনা বিধায় বাগদাদের মহাসড়কে তাঁকে ওয়াজ-নসিহত করতে হতো। এভাবে তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর মানুষকে হেদায়ত করেন। ‘ফলে তাঁর এমন কোনও মজলিস ছিল না যেখানে অসংখ্য বিধর্মী ইসলাম গ্রহণ করতো না। পাশাপাশি অসংখ্য ডাকাত, খুনি, পাপাচারী ও অপরাধীতো আছেই যাঁরা তাঁর হাতে তাওবা করে, সঠিক পথে ফিরে আসতো। [বাহজাতুল আসরার, পৃ ৯]
গবেষক জামালুদ্দিন ফালেহ্ জিলানী তাঁর ‘ইমাম আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি নামক কিতাবে লিখেছেন সবচেয়ে প্রাচীনতম তরিকা হলো কাদেরিয়া তরিকা। এ তরিকার প্রবর্তকের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো তিনি এমন একটি প্রজন্ম গঠনে ভূমিকা রেখেছেন যারা বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফকে খ্রিস্টান দখলদারমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আর এ কাদেরিয়া তরিকার অনুসারীদের অন্যতম ছিলেন বিম্ববিজয়ী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, আবদুল কাদের জাজায়েরী, ওমর মুখতার, জেনারেল আবদুর রহমান, রফিক আলী আল জিলানীসহ এ উম্মতের গৌরব করার মত আরও অনেকেই।
আবদুল কাদের জিলানী শুধুমাত্র উন্নত আদর্শ, উদারতা, মানবপ্রেম, ওয়াজ নসিহত ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেননি বরং বিশ্বব্যাপী ইসলামের আলো বিতরণ করার জন্য তাঁর খলীফা, মুরিদ ও শিষ্যদের নিয়ে এমন একটি জামাত গঠন করেন যারা দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। তাঁদের একটি দল আবদুল কাদের জিলানীর জীবদ্দশায় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন।
হেলী কারবার দানকোচ বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের কোকাজের মুসলমানগণ এখনও হানাফী মাযহাব এবং কাদেরিয়া তরিকার অনুসারী-কমিউনিউজিয়ামের শাসন ক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁদেরকে তাঁদের ঘরে কাদেরিয়া তরিকার ওয়াজিফা পাঠ করতে শুনেছি।
আবদুল কাদের জীলানীর সরাসরি খলিফা হলেন হযরত বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, যিনি বড়পীর সাহেবের জীবদ্দশায় এবং তাঁরই নির্দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং বাংলাদেশেই শাহাদত বরণ করেন। তিনিই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম খানকায়ে কাদেরিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। অনুরূপভাবে হযরত শাহ্ মখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি যিনি গাউসে পাকের পৌত্র (নাতী) ছিলেন, রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার করেন।
অধ্যাডক ড হাসান ইব্রাহীম হাসান তাঁর রচিত ‘ইনতেশারুল ইসলাম ফিল ক্বাররাহ্ আল আফরিকীয়্যাহ্’ গ্রন্থে বলেন, ‘আফ্রিকা মহাদেশে ইসলাম প্রচারে যে তরিকার অবদান সবচেয়ে বেশি তা হলো তরীকায়ে কাদেরিয়া। অনুরূপভাবে ড আবদুর রহমান জাকী তাঁর রচিত ‘আল মুসলেমুনা ফি আল আলাম আল ইয়াউম’ নামক কিতাবে একই মন্তব্য করেন।
মাসিক আল ইসলাম ওয়াত তাসাউফ (জানুয়ারি ১৯৬১) তার রিপোর্ট উল্লেখ করেছে সোমালিয়াতে সর্বপ্রথম যে তরিকাটি প্রবেশ করে সেটি হলো কাদেরিয়া তরিকা। ফরাসী প্রাচ্য গবেষক ফানসান মুনতাই ১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি মরক্কোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে লিখিত প্রবন্ধে বলেন, ‘চীনের ইনান নামক প্রদেশে একটি মাজার দেখা যায় যার ফলকে লিখা আছে।
আবদুর রাজ্জাক বাগদাদির নাম, যিনি দ্বাদশ খ্রিস্টীয় শতাব্দীতে চীনে ইন্তেকাল করেন। যিনি ছিলেন আবদুল কাদের জিলানীর পৌত্র (নাতী) এবং চীনে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারকারী।’’
হেলী কারবার দানকোচ বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের কোকাজের মুসলমানগণ এখনও হানাফী মাযহাব এবং কাদেরিয়া তরিকার অনুসারী-কমিউনিউজিয়ামের শাসন ক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁদেরকে তাঁদের ঘরে কাদেরিয়া তরিকার ওয়াজিফা পাঠ করতে শুনেছি।
বিশ্বজুড়ে কাদিরিয়া তরিকা :
শরীয়ত তরীকত হাক্বীকত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে যে ইলম সম্বলিত ও বিকশিত হয়েছে তাকে বলা হয় ‘ইলমে তাসাওউফ’ বা তাসাওউফ বিজ্ঞান। প্রিয় নবী থেকেই এলমে তাসাওউফ চর্চা সূচিত হয়েছে।
কুরআন মজীদে যে তাযকীইয়ায়ে নফস এবং হাদীস শরীফে যে ইহসানের কথা বলা হয়েছে সেটাই মূলতঃ তাসাওউফের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তাসাওউফ চর্চায় বিভিন্ন পদ্ধতি কালক্রমে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিন্যাসিত হয়েছে যেগুলো ত্বরীকা নামে পরিচিত। কাদেরিয়া তরিকা তরিকাসমূহের মধ্যে বহুল প্রচলিত।
তিনি ইলমে তাসাওউফ তথা শরীয়ত, তরীক্বত ও হাক্বীক্বত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে বিন্যাসিত ইসলামের এ অনন্য বিজ্ঞানকে আরও সহজে চর্চার সুবিধার্থে এক আলোচিত ধারার পদ্ধতি বিন্যাস করেন।
আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় সবগুলো দেশে বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, সুদান, নাইজার, নাইজিরিয়া, মালী, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মৌরিতানিয়া প্রভৃতি দেশে এই তরীকার ব্যাপক চর্চা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে এবং ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এর চর্চা রয়েছে।
এটা কাদেরিয়া তরীকা নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ইলমে তাসাওফের আলখেল্লা পরা তাঁর কালের সমস্ত বাতিল ফিকাগুলোকে চিহ্ণিত করে তাদের সান্নিধ্যে না যাবার জন্য আহ্বান জানান। তিনি কি কি কারণে ঐ সমস্ত ফিরকাগুলো বাতিল তাও উল্লেখ করে পুস্তক লিখে তা জনগণের মধ্যে প্রচার করেন।
ইলমে তাসাওউফে যে সমস্ত তরীকা রয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তরীক্বা হিসেবে বিবেচিত হয় গাউসুল আযম কর্তৃক বিন্যাসকৃত কাদেরিয়া তরিকা। এ তরিকার বিস্তৃতি ঘটেছে বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপকভাবে, যা অন্য সব তরীকার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। যে কারণে গাউসুল আযমের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হয়েছে।
কাদেরিয়া তরিকা প্রসারিত হয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। এটাই শ্রেষ্ঠ তরিকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সারা পৃথিবীতে কাদেরিয়া তরিকার নিসবত বা সম্বন্ধ অনুযায়ী অসংখ্য খানকা শরীফ রয়েছে।
আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় সবগুলো দেশে বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, সুদান, নাইজার, নাইজিরিয়া, মালী, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মৌরিতানিয়া প্রভৃতি দেশে এই তরীকার ব্যাপক চর্চা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে এবং ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এর চর্চা রয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে কাদেরিয়া তরিকা :
বাংলাদেশে কাদেরিয়া তরিকার প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে। যতদূর জানা যায় হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি রাজশাহীর শাহ্ মাখদুম রহমাতুল্লাহি আলায়হি, পশ্চিম বাংলার হযরত মনসূর বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ অঞ্চলে এ তরীকার ব্যাপক প্রসার ঘটান।
বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি
যে ক’জন প্রখ্যাত সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাবা আদম ছিলেন অন্যতম শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ওলি। ভারতে মধ্যযুগে যে ক’জন সুফি দরবেশ ইসলাম প্রচারের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বাবা আদম তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
বাবা আদম ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারে উদ্দেশ্যে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান।
খোরাসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর বাবা আদম উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য বাগদাদে আবদুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে আসেন এবং তাসাওফের শেষ স্তর অতিক্রম করেন।
তিনি প্রথমে মহাস্থানগড়ে খানকায়ে কাদেরিয়া স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। কয়েকবার সম্মুখ ও নৌ-যুদ্ধ হয়েছিল বাবা আদমের সঙ্গে বল্লাল সেনের। ১১৭৪ সালে বিক্রমপুরে বাবা আদম শহীদ হন। শহীদ হওয়ার পর তাকে রিকাবী বাজার দীঘিরপাড় সড়কের পাশে দাফন করা হয়।
হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি
রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যাদের নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি অন্যতম। ওলীকুল শিরোমণি আব্দুল কাদের জিলানীর প্রিয়তম পৌত্র শাহ্ মাখদুম রূপোশ ছিলেন সে মহান সাধক যিনি রাজশাহীর মত অনগ্রসর স্থানে ইসলামের বাণী প্রচার করে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করেছিলেন।
তৎকালীন মহাকালগড়ে (বর্তমানে রাজশাহী) দেও রাজাদের অন্যায়-অনাচার-অবিচার ও নানা কুসংস্কার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। বিশেষ করে মানুষ বলি দেয়ার মত নিষ্ঠুর কাজে জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবাণীতে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ এ অঞ্চলের মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করে শান্তির নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
(চলবে…)
………………………..
আরো পড়ুন:
ফাতেহা ই ইয়াজদহম : এক
ফাতেহা ই ইয়াজদহম : দুই
ফাতেহা ই ইয়াজদহম : তিন
ফাতেহা ই ইয়াজদহম : চার
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন