প্রকৃতপক্ষে পরমাত্মা নিরাকার অর্থাৎ অশরীরী। মনুষ্যাত্মা যেমন কান দ্বারা শ্রবণ করে, পরমাত্মারও তেমনি মুখেন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় যাহাতে তিনি জ্ঞান দান করিতে পারেন। পরমাত্মা জন্ম মৃত্যুর চক্রের আবদ্ধ নহেন, তাহার কোন পিতা-মাতা নাই। তিনি কর্মের অতীত সুতরাং শিশুর ন্যায় জননীর জঠরে জন্ম লইয়া তিনি মনুষ্য দ্বারা লালিত পালিত হইবেনই বা কি করিয়া! আর উহাদের সহিত কর্ম সম্বন্ধই বা জুড়িবেন কি করিয়া?
অতএব স্থাপন, পালন ও বিনাশ এই তিন কর্তব্য করিবার জন্য পরমাত্মা প্রথমে তিন সূক্ষ্ম দেবতা যথা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শঙ্করকে রচনা করেন। এই তিন দেবতাকে রচনা করিবার জন্য পরমাত্মাকে ত্রিমূর্ত্তি বলা হয়।
…শিবলিঙ্গ পরমাত্মার প্রতিমা, আর শঙ্করের মূর্ত্তি হইতেছে তাহার শরীরের সূচক। আমি পূর্বেই আপনাকে বলিয়াছি যে জ্ঞান দান করিবার নিমিত্ত মুখেন্দ্রিয়য়ের আবশ্যক। সুতরাং পরমাত্মা শিব স্বয়ং পরমধাম হইতে অবতরণ করিয়া এক সাধারণ মনুষ্যের শরীরে প্রবেশ করেন যাহাকে পরমাত্মার দিব্য জন্ম অথবা পরকায়ায় প্রবেশ বলে। পরমাত্মা প্রকৃতির অধীন মনুষ্যের সদৃশ জন্মগ্রহণ করেন না। কিন্তু প্রকৃতিকে আপনার অধীন করিয়া অলৌকিক জন্মগ্রহণ অর্থাৎ পরকায়ায় প্রবেশ করেন। প্রতিদিন পরমধাম হইতে আগমন করিয়া ঐ সাধারণ এবং বৃদ্ধ মনুষ্যের মুখ দ্বারা জ্ঞান এবং সহজে যোগ শিক্ষা দিয়া বিকারের (কাম, ক্রোধ ইত্যাদি রিপু) উপর বিজয় প্রাপ্ত করিবার তথা দিব্য গুণ ধারণ করিবার সহজ উপায় বলিয়া যান।
যে বৃদ্ধ মনুষ্যের শরীরে তিনি প্রবেশ করেন তাহাকে তিনি প্রজাপিতা ব্রহ্মা এই কর্তব্য-বাচক নামে ভূষিত করেন। যাহারা প্রজাপিতা ব্রহ্মার মুখকমল নি:সৃত জ্ঞান শ্রবণ ও ধারণ করে তাহাদিগকে ব্রহ্মার মুখজাত সন্তান অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বা দ্বিজ বলে। দ্বিজ অর্থাৎ যাহার দ্বিতীয়বার জন্ম হইয়াছে। প্রত্যেক নর-নারলি লৌকিক জন্ম লৌকিক মাতা-পিতার দ্বারা হইয়ো থাকে। লৌকিক জন্মদাতাকে লৌকিক পিতা বলে। কিন্তু পরমাত্মার জ্ঞান শ্রবণ করিয়া মানুষের জীবনে যে বিশাল পরিবর্তন আসে তাহাও তাহার নূতন জন্মগ্রহণ বিশেষ। যাহার মাধ্যমে পরমাত্মার এই জ্ঞান শ্রবণ করা হয় তিনি আমাদের অলৌকিক পিতা। অতএব প্রজাপিতা ব্রহ্মা আমাদের অলৌকিক পিতা, কারণ তাহার মুখকমল নি:সৃত পরমাত্মার জ্ঞান শ্রবণে আমরা অলৌকিক জীবন প্রাপ্ত হই। সর্বোপরি সকল আত্মার পিতা পরমাত্মার সহিত আমাদের আত্মিক পিতার সম্বন্ধ চিরকালের জন্য রহিয়াছে। তিনি আমাদের পারলৌকিক পিতা। সুতরাং আমাদের পিতা তিনজন যথা লৌকিক, অলৌকিক, পারলৌকিক।
যাহা হউক, আমি আমাদের পরমাত্মার দিব্য কর্তব্য সম্বন্ধে বলিতেছিলাম। এখন ধরুন, কেহ দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগিবার পর যখন পুনরায় সুস্থ স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, তখন লোকে বলে- “উহার নূতন জন্ম হইয়াছে।” এই প্রকার যখন কলিযুগী বিকারী নর-নারী আপনার বিকারী, কুঅভ্যাসপূর্ণ অপবিত্র জীবন যাপন পরিত্যাগ করিয়া পবিত্র জীবন যাপন করে তখন এইরূপ বলা হয় যে তাহার ‘মরজীবা জন্ম’ হইয়াছে। অর্থাৎ এই জীবনেই সে তাহার পুরানো বিকারী অভ্যাসগুলি হইতে মারা গিয়াছে এবং নূতন দিব্য জীবন যাপন করিতেছে। পরমাত্মার জ্ঞান শ্রবণে এইরূপ পরিবর্তন আসে বলিয়া পরমাত্মাকে দিব্যদৃষ্টি দাতা এবং রচয়িতা বলা হয়।
আত্মা অবিনাশী। সুতরাং আত্মাকে রচনা করিবার প্রশ্নই ওঠে না। আত্মা-পরমাত্মার শাশ্বত, অবিচ্ছেদ্য পিতা-পুত্রের সম্বন্ধ তো রহিয়াছেই, কিন্তু সেই মধুর সম্বন্ধ মনুষ্যাত্মা ভুলিয়া গিয়াছে। পরমাত্মার রচনার কার্য হইতেছে আত্মাকে জ্ঞান দ্বারা নূতন জীবন দান করা এবং উহাকে এই নিশ্চয়ে স্থির করা- “ আমি আত্মা পরমপিতা পরমাত্মার সন্তান।”-
অতএব ইহা পরিস্কার যে জ্ঞান ও যোগ দ্বারা পরমাত্মা প্রজাপিতা ব্রহ্মার সাকার মাধ্যমে সত্যযুগী পবিত্র সংসার রচনার কার্য করিতেছেন। পরমাত্মার রচনা বলিতে উহা বুঝায় না যে কোন কিছুর নূতন সৃষ্টি করা, বরঞ্চ ইহাই বুঝায় যে মনুষ্যের চারিত্রিক নব-নির্মাণ অর্থাৎ দেবী ধর্মের পুন:স্থাপন। বর্তমান সময়ে পরমাত্মা শিব প্রজাপিতা ব্রহ্মার দ্বারা ঐ কর্তব্য করিতেছেন।