ভারতে মইনুদ্দিন সিজঝি নামে এক সুফি সাধক সুদূর তুর্কিস্তান থেকে এসে দ্বাদশ শতাব্দীতে উদার হৃদয় ‘চিস্তি’ তরিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সিজঝি সাহেব ভগবৎ-সাধনে সিদ্ধ এক দরবেশের কথা লিখেছেন, যার কথা শুনলে বুঝবেন, অনাসক্ত সংসারীর অনুভূতি কতটা বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হয়।
সেই সাধু দরবেশ এক নদীর ধারে থাকতেন স্ত্রীকে নিয়ে। একদিন তিনি হঠাৎ স্ত্রীকে বললেন- দ্যাখো! এই নদীর পরপারে আরেক দরবেশ আছেন এক অস্থায়ী কুটির বেঁধে। তুমি আজকে তাঁকে তোমার রান্না করা খাবার কিছু দিয়ে এসো। স্ত্রী বললেন- খাবার তো নিয়ে যেতেই পারি। কিন্তু এই নদী পেরিয়ে আমি যেতে পারব না। উত্তাল নদী আমি পার হব কী করে?
দরবেশ বললেন- খাবার হাতে নিয়ে তুমি নদীর পারে দাঁড়িয়ে উত্তাল জলরাশিকে আমার প্রতি মর্যাদা রেখে বলো যে, বিবাহিত হওয়া সত্বেও আমার স্বামী কোনও দিন আমার সঙ্গে শোননি- এই মর্যাদায় হে জলরাশি, তোমরা পরপারে যাওয়ার পথ দাও আমাকে।
স্বামীর কথা শুনে সরলা রমণী বিস্ময় মানল মনে। এটা কেমন কথা বলছে এই মানুষটা!
এরই সহচর্যে কতগুলি সন্তানের মা হলাম আমি। আর সে বলছে কিনা আমার সঙ্গে শোয়নি কোনও দিন! যাই হোক, দরবেশ ফকির স্বামী যেমনটা বলতে বলেছে, তেমনটা নদীর সামনে এসে বলতেই উত্তাল নদী দু’ভাগ হয়ে মাঝখানে পথ করে দিল দরবেশ স্ত্রীকে। সে স্বচ্ছন্দে খাদ্যবস্তু হাতে নিয়ে নদীর পরপারে চলে গেল এবং নদীও পুনরায় বইতে লাগল আগের মতোই প্রবাহিনী হয়ে।
নদীর ওপারে অন্য সেই দরবেশের সামনে খাবার থালা রেখে স্ত্রী অপেক্ষা করতে লাগল। দরবেশ খাওয়া শেষ করলেন। এবার পূর্বোক্ত দরবেশের স্ত্রী চিন্তামগ্ন হয়ে সেই দরবেশকে বলল- আসার সময় আমার স্বামীর বাক্যে বহতা নদীর মধ্যেও পথ পেয়েছে আমি। কিন্তু এখন আমি আবার ওপারে যাব কি করে? নদী তো বয়ে চলেছে আবার।
দরবেশ এবার চিন্তাকুলা সেই স্ত্রীকে বললেন- আমার প্রতি বিশ্বাস রেখে নদীর সামনে গিয়ে বলো- যে দরবেশ এই তিরিশ বছর ধরে কিছু খায়নি, আমি তাঁর সংবাদ শোনালাম তোমাকে, এবার তুমি পথ দাও!
রমণী আবার অবাক হল- বলে কী লোকটা!
তিরিশ বছর খায় নি? এখনই তো আমি যে খাইয়ে এলাম, সেটাও কি মিথ্যে! যাই হোক, নদীর কাছে এসে স্ত্রীটি বলল- তিরিশ বছর ধরে যে দরবেশ কোনও দিন খায়নি, তাঁর সংবাদ জানালাম তোমাকে। তুমি পথ দাও আমাকে। নদী আবারও দু’ভাগ হয়ে পথ করে দিল।
সেই স্ত্রী নদী পার হয়ে এসে এবার দরবেশ স্বামীর পায়ের কাছে বসে জিজ্ঞাসা করল- তোমার এই কথার রহস্য আমি কিছু বুঝিনি- তুমি কিনা এমন কথাটা বললে যে, তুমি আমার শয্যায় শোওনি কোনও দিন! আমাদের এতগুলি সন্তান! আর ওপারের ওই দরবেশের কথার রহস্যটাই বা কী? তিনি নাকি তিরিশ বছর কিছু খান নি, অথচ আমার সামনেই তিনি খাদ্য গ্রহণ করলেন!
দরবেশ স্বামী বললেন- আমাদের দু’জনের কথাই যে সত্য, সেটা তো তুমি নদীর আচরণ দেখেই বুঝেছ। তবু আমি যে তোমাকে বলেছি, আমি শুইনি তোমার সঙ্গে, তার রহস্য এবং সত্য এটাই যে, আমি তোমার যৌবন-রমণ সুখ ভোগ করিনি কখনও। তোমার মাতৃবাৎসল্য পূরণ করা এবং অনাদ্যনন্ত সংসারধারা রক্ষার জন্য যে প্রয়োজনীয় কর্ম, সেইটুকুই আমি করেছি, আমি ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করার জন্য তোমায় শয্যায় আসিনি কখনও।
আর ওপারের ওই দরবেশ সাধুর কথা বলি। তিনিও কোনও দিন ক্ষুধা মেটানোর জন্য অথবা পেট ভরে খেয়ে খাবারের আস্বাদন করেননি। যখন যতটুকু জুটেছে, তিনি তাই খেয়েছেন এবং তা নিতান্তই শরীর রক্ষার জন্য, সেই শরীররক্ষার তাগিদটুকুও ঈশ্বর-সাধনার জন্য, নিজের জন্য নয়।
এই জন্যই পাপ-পুণ্য, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় ইত্যাদি দ্বন্দ্বের ঊর্ধে উঠতে গেলে বুদ্ধি দিয়েই মনকে চালিত করতে হয় এবং সেই সমত্বের ভাবনাটাও বুঝতে হয় বুদ্ধি দিয়েই। হয়তো এই কারণেই ভগবদগীতা বলেছে- দ্বন্দ্বাতীত এই সমত্বের বুদ্ধি- সুখ-দুঃখে সমে কৃত্বা- থেকেই বোঝা যায় যে, কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার ফলের আশায় যে কর্ম করা হয় তার থেকে অনেক ভাল হলো নিষ্কামভাবে কর্ম করা।
এবং সেটার জন্য প্রয়োজন ফলাকাঙ্ক্ষাহীন সমত্বের বুদ্ধি- সমস্ত জৈব আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে শুধু কর্মের জন্যই কর্ম করার বুদ্ধি যদি তৈরি হয়, তাহলে জন্ম-মরণ, পাপ-পুণ্য, সুখ-দুঃখ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সেই পরম নিত্য, সত্য এক আনন্দের মধ্যে নিজেকে স্থাপিত করা যায়। তাতেই তত্ত্বজ্ঞানের সন্ধান পায় মানুষ। কৃষ্ণের মুখে অনেকক্ষণ ‘সমদুঃখ-সুখ’ ইত্যাদি কথা শুনে অর্জুন কিন্তু এতক্ষণে একটু ধাতস্থও হয়েছেন।
‘ধাতস্ত’ মানে কিন্তু ‘ধাতুস্ত’। কফ-বাত-পিত্তর সমতা, সত্ত্ব-রজঃ-তম গুণের ‘ইকুইলিব্রিয়াম’। এমনটা হয়েছে বলেই অর্জুন এবার সত্যের সন্ধানে কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন- যাঁদের প্রজ্ঞা সমত্বের বুদ্ধিতে থিতু হয়েছে সমাধিস্থ মানুষের মতো, তাঁদের লক্ষণটা কী, এবং কীভাবে চিনতে পারব তাঁদের?
কৃষ্ণ বললেন, যে মানুষ সমস্ত ভোগ-সুখের কামনা এক্কেবারে মন থেকে বিসর্জন দিয়েছেন, যে মানুষ আপনার মধ্যেই আপনিই আনন্দ পান, তাঁরই বুদ্ধি-প্রজ্ঞা সমত্বের মধ্যে আহিত, স্থির হয়। নিজের মধ্যেই যার নিজের আনন্দ- এই ব্যাপারটা বোঝানো খুব কঠিন, আবার এটা বোঝানো খুব সহজ।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করেছিলেন- যাঁদের প্রজ্ঞা এমন স্থিত হয়েছে, তাঁরা কথা বলেন কীভাবে, তাঁরা থাকেন কীভাবে কিংবা তাঁদের চাল-চলনই বা কেমন?
গীতার ভাবনাতে যদি এর উত্তর শোনাতে হয়, তাহলে কৃষ্ণ বলছেন- শত দুঃখ পেলেও যাঁর চিত্ত ব্যাকুল উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে না, আবার শত সুখ পেলেও যিনি স্পৃহাহীন নিস্তরঙ্গ থাকেন- কোনও কিছুতে যাঁর আশক্তি-অনুরাগ নেই, ভয় নেই, ক্রোধ নেই তাঁকেই স্তিতধী মুনি বলা চলে।
এমন মানুষ ভাই-বন্ধু-সুত-দারা-কোনওখানেই অতিস্নেহের বাঁধনে বাঁধা পড়েন না, শুভাশুভ যাই ঘটুক, তাতে আনন্দিতও হন না, আবার বিদ্বেষও পোষণ করেন না কারও প্রতি, তাঁর বুদ্ধি স্থির হয়েছে বলতে হবে- গীতায় এই স্থিতধী মানুষের চরিত্রকথা শুনে এটা ভাবার কোনও কারন নেই এই মানুষগুলি সব গুম হয়ে স্থবির সমাধিতে বসে থাকেন। বরঞ্চ উল্টো।
আপনার মধ্যে আপনিই যদি আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর ভাবটা হয় কস্তুরী-মৃগ-সম, আপন গন্ধে আপনি মাতোয়ারা। বিশ্ব জগৎকে তিনি আপনার মধ্যে দেখেন, আর নিজেকে দেখতে পান সকলের মধ্যে। এমন মানুষ চুপ করে বসে থাকে নাকি?
আমার কবি লিখছেন তাঁর কথা-
আপন মনে বেড়ায় গান গেয়ে,
গান কেউ শোনে কেউ শোনে না।
ঘুরে বেড়ায় জগৎ-পানে চেয়ে,
তারে কেউ দেখে কেউ দেখে না।
সে যেন গানের মতো প্রাণের মতো শুধু
সৌরভের মতো উড়ছে বাতাসেতে,
আপনারে আপনি সে জানে না,
তবু আপনাতে আপনি আছে মেতে।
গান গায় সে সাঁঝের বেলা, মেঘগুলি তাই ভুলে খেলা
নেমে আসতে চায় রে ধরা পানে,
একে একে সাঁঝের তারা গান শুনে তার অবাক-পারা
আর সবারে ডেকে ডেকে আনে।
আপনি মাতে আপন স্বরে, আর সবারে পাগল করে,
সাথে সাথে সবাই গাহে গান-
জগতের যা-কিছু আছে সব ফেলে দেয় পায়ের কাছে,
প্রাণের কাছে খুলে দেয় সে প্রাণ।
তোরাই শুধু শুনলি নে রে, কোথায় বসে রইলি যে রে,
দ্বারের কাছে গেল গেয়ে গেয়ে,
কেউ তাহারে দেখলি নে তো চেয়ে।
গাইতে গাইতে চলে গেল, কত দূর সে চলে গেল,
গানগুলি তার হারিয়ে গেল বনে,
দুয়ার দেওয়া তোদের পাষাণ-মনে।
……………………………
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী’র লেখা থেকে সংকলিত।
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন