সেদিন উনিশে জ্যৈষ্ঠ আর রবিবার।
সকালে হয়েছে খোলা মন্দিরের দ্বার।।
রামকুমার, চন্দ্র ভট্টাচার্য দু’জনে।
বাবার মন্দিরে আসি প্রণমে চরণে।।
মন্দির মাঝারে বাবা ছিলেন বসিয়ে।
চরণে প্রণাম করে দুই শিষ্য গিয়ে।।
চন্দ্র ভট্টাচার্য বাবা বলেন ঈঙ্গিতে।
কিছুক্ষণ গিয়ে তুমি বস বাহিরেতে।।
চন্দ্রকান্ত গিয়ে তবে বাবার আদেশে।
মন্দির হতে গিয়ে বাহিরেতে বসে।।
মন্দিরেতে রামকুমার গুরুদেব সনে।
নানা কথা আলোচনা করেন গোপনে।।
চন্দ্র ভট্টাচার্য থাকে বসিয়ে বাহিরে।
গুরুর আদেশে অতি ধৈর্য সহকারে।।
রামকুমার সহ বাবা নানা কথা কয়।
বাহির হতে কিছু নাহি জানা যায়।।
কিছুক্ষণ এরূপে আলোচনা শেষে।
মন্দির হতে রামকুমার যে আসে।।
চন্দ্র ভট্টাচার্যে বাবা ডাকল তখন।
ভট্টাচার্য গিয়ে বাবার বন্দিল চরণ।।
বাবা বলে শুন ভক্ত তোমারে জানাই।
শুভলগ্ন সমাগত বিলম্ব যে নাই।।
আজই পূর্বাহ্নে আমি ত্যাজিব শরীর।
ধর্মপথে সর্বক্ষণ রইবে সুস্থির।।
যা কিছু করার ছিল সমাপ্ত হয়েছে।
আর হেথা মোর কিবা প্রয়োজন আছে।।
জীবরে লাগিয়ে বল কেন অকারণ।
আর এই দেহ আমি করব ধারণ।।
এ দেহ ত্যাগ আমি অবশ্য করব।
কিন্তু তোমাদের আমি ছাড়িয়ে না যাব।।
সুস্থ দেহ এরপর করিয়ে ধারণ।
ভক্তগণ পাশে আমি রব সর্বক্ষণ।।
সবার উপরে দৃষ্টি আমার হবে।
ভক্তের উপরে সদা সুদৃষ্টি রবে।।
স্মরণ করিও মনে মনে একবার।
আসব তখনি আমি করি অঙ্গীকার।।
রণে বনে যেস্থানে থাকবে যখন।
একবার মনে মনে করিও স্মরণ।।
লোকমুখে এই কথা প্রচার হলো।
দলে দলে ভক্তগণ আসতে লাগল।।
লোকে লোকারণ্য হলো আশ্রম প্রাঙ্গণ।
শেষবার লোকনাথে করতে দর্শন।।
অন্তিমবারের মত প্রণাম জানাতে।
আসে যত নর-নারী বাবার পাশেতে।।
সবাকার চোখে অশ্রু থাকে দাঁড়িয়ে।
অতি প্রিয়জন আজ যাবে ছাড়িয়ে।।
মাতা পিতা ভ্রাতা যিনি বন্ধু আর গুরু।
বাসনা পূরণে যিনি হন কল্পতরু।।
আজ তিনি যাবে চলি লয়ে বিদায়।
আর কেহ রবে না এই জগতে হায়।।
কার নিকটে গেলে জুড়াবে হিয়ে।
কেবা রক্ষা করবেন সর্বশক্তি দিয়ে।।
সকাল ন’ঘটিকায় ছিল শুভযোগ।
লয়ে আসেন মাতা শেষ বাল্যভোগ।।
সজল নয়নে মাতা বাল্যভোগ নিয়ে।
বাবার সম্মুখে গিয়ে রহে দাঁড়িয়ে।।
বেদনায় মৌন মূক বাক্য নাহি সরে।
চক্ষু মেলি লোকনাথ চাহে ধীরে ধীরে।।
নিজহস্তে বাল্যভোগ করিয়ে গ্রহণ।
প্রসাদ করিয়ে বাবা দিলেন তখন।।
সেই মহাপ্রসাদ লয়ে যত ভক্তগণ।
মহানন্দে সবে মিলি করল ভক্ষণ।।
প্রসাদ ভক্ষণ শেষ হবার পরে।
মহতাযোগে বসে বাবা আপন মন্দিরে।।
নীরব নিস্তব্ধ সবে নিাহি মুখে কথা।
সবাকার বক্ষমাঝে বিয়োগের ব্যথা।।
ক্রমে সমাপ্তিস্থ বাবা নিশ্চল হল।
প্রস্তুর মুরতি সম বসিয়ে রইল।।
মুখেতে স্বর্গীয় হাসি বলবে না কেহ।
প্রাণ আছে কিংবা তাঁর প্রাণহীন দেহ।।
পরশ করতে তাঁর সবে ভয় পায়।
সমাধিতে যদি বাবা কোনো বাধা পায়।।
মৌনভাবে চেয়ে দেখে মত্ত ভক্তগণ।
এই মহা সমাধি বাবার ভাঙ্গবে কখন।।
দেখতে দেখতে দীর্ঘক্ষণ কেটে গেল।
সেই মহাসমাধি বাবার ভঙ্গ নাহি হলো।।
সকলে বলল বাবা নাহি এ জগতে।
মিশে গেছে আত্মা তাঁর পরম ব্রহ্মেতে।।
সকলেই উচ্চরবে লাগল কাঁদতে।
লোকনাথ বাবা আর নেই এ জগতে।।
মন্দির হতে তুলি তাঁর দেহখানি।
রাখা হলো সেই দেহ বিল্বতলে আনি।।
দেহ সৎকারের সবে করে আয়োজন।
আনা হলো থরে থরে ঘৃত আর চন্দন।।
আশ্রমের দক্ষিণ পাশে ঠিক পূর্বকোণে।
সজ্জিত করল চিতা যত ভক্তগণে।।
সেই চিতায় দেহ তাঁর রক্ষিত হলো।
শ্রেষ্ঠ শিষ্য রামকুমার মুখাগ্নি করল।।
অবশেষে দাহকৃত্য হল সমাপন।
কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যায় ভক্তগণ।
আশ্রম নির্জন হলো বাবার বিহনে।
শুধুমাত্র পুণ্যস্মৃতি রইল সেখানে।।
বাবার অভয় বাণী মনে পরে যায়।
যেদিন আমি আর রব না ধারায়।।
স্থূল দেহ ত্যাজি সুস্থ দেহ যে ধরব।
ত্রিলোক মধ্যেতে আমি বিরাজ করব।।
গোপনে শ্রীগুরু রূপে রহে অন্তরে।
জ্ঞান দিয়ে বিনাশিব অজ্ঞান আঁধারে।।
আমার স্মরণ করো রইবে যে স্থানে।
সর্ব বিপদেতে রক্ষা করব সেখানে।।
লোকনাথ বাবা বলি যেই কার্যে যাবে।
সেই কার্য অবশ্যই সফল হবে।।
জয় বাবা লোকনাথ পতিত পাবন।
রক্ষা করো বিপদেতে বিপদ বারণ।।
মন্ত্র মন্ত্র নাহি জানি অধম সন্তান।
সঙ্কটে পড়ল বাবা করো মোরে ত্রাণ।।
বাবার পাঁচালী হেথা হলো সমাপন।
জয় বাবা লোকনাথ বল ভক্তগণ।।
আরো পড়ুন…
লোকনাথ বাবার মঙ্গলাচরণ পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার আবির্ভাব পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার বাল্যজীবন পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার যোগ-সাধনা পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার ব্রহ্মজ্ঞান লাভ পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার দেশ ভ্রমণ পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার পুনরায় দেশ ভ্রমণ পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার সুমেরু যাত্রা পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার চন্দ্রনাথ পর্বতে আগমন পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার দাউদকান্দি গমন পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার বারদীতে আগমন পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার আশ্রম স্থাপন পাঁচালী…
লোকনাথ বাবার মহাপ্রয়াণ পাঁচালী…