ভবঘুরেকথা
কোথা হতে আসে নৌকা

-মেঘনা কুণ্ড

এ পৃথিবীতে আমাদের একটি নির্দিষ্ট সময়ে জন্ম হয়। আবার নির্দিষ্ট সময়ে মৃত্যুও ঘটে। প্রতিটি মানুষের নির্ধারিত সময়কাল থাকে এ পৃথিবীতে বিচরণ করার। সময়কাল পেরিয়ে গেলে, সব মায়া কাটিয়ে মানুষকে বিদায় নিতেই হয়।

প্রতিটি মানুষ একা আসেন এবং এক-ই চলে যান। মানুষ এ পৃথিবীতে এসে অনেক কিছুই অর্জন করে। অনেক কিছু হারিয়েও ফেলে। অনেক ধন-সম্পদও সঞ্চয় করে। কিন্তু কোনো কিছুই বিদায় বেলায় নিয়ে যেতে পারে না। অনেকে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করে।

কিন্তু হয়তো তারা ভুলে যান অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় সব পুড়ে যায়, ঝলসে যায়, শেষে পড়ে থাকে শুধু ছাইটুকু, সব মিলিয়ে যায় পঞ্চভূতে। অনুরূপভাবে মাটিতে সমাহিত করলেও তাও একই রূপে মিলে যায় পঞ্চভূতে।

কিন্তু আমরা কখনও এভাবে ভেবে দেখেছি যে, ‘মানুষের জন্ম কেনো হয়?’

আমাদের মানুষ হিসেবে প্রথমেই এটা প্রশ্ন করা উচিৎ যে, ‘আমাদের জন্ম কেনো হলো!’

আসলে প্রতিটি আত্মা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা কোন্ পরিবারের অংশ হবে। কোন্ মাতার গর্ভে জন্ম নেবে। কে হবে তার পিতা। কারণ আত্মার জন্মই হয় যাদের পূর্ব জন্মে কোনো কাজ বাকি থাকে। বা কোনো কাজের হিসেব মেলাতে বা পূর্ব জন্মের কর্মফল ভোগ করতেই এ পৃথিবীতে আগমন হয়ে থাকে।

এ পৃথিবীতে আসার পর মাতা বা পিতা যেমন হবে ঠিক সেভাবেই যা শেখানোর শিখিয়ে দেন। কিন্তু শেখাটা চলতেই থাকে কারণ ‘Learning never stops!’

তাহলে মানুষের জন্ম হয় কেনো? সম্ভবত উপনিষদে বর্ণিত আছে, নর থেকে নারায়ণ হবার যাত্রা পূর্ণ করতেই মনুষ্যের জন্ম হয়। কোন মানুষ যেমন হন না কেন তিনি তুচ্ছ হতে পারেন, শ্রীমাণ হতে পারেন, নিরীহ হতে পারেন, প্রকাণ্ড পণ্ডিত ব্যক্তি ও হতে পারেন।

কিন্তু নারায়ণ তো তিনি নন। শিবোহম তিনি নন। ব্রহ্ম তিনি নন। আর এই নারায়ণ বা শিবোহম বা পরমব্রহ্ম’র গুণ নিজের মধ্যে সমাহিত করবার যে যাত্রা, ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’র পথে নিজেকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তাকেই আধ্যাত্মিক স্তরে মনুষ্যের প্রকৃত জীবনযাত্রা বলা হয়।

প্রতিটি মানুষের এই পরম ব্রহ্মে যাওয়ার চেষ্টাকেই প্রধান উদ্দেশ্য করতে হবে। সসীম থেকে অসীমে যাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। সসীম থেকে অসীমের যাত্রা সারাজীবন ধরে মানুষের জীবনে চলতে থাকে।

অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল কর্মকাণ্ডের জন্য মানুষ ভীষণ মাত্রায় প্রভাবিত হয়ে পরে। সে ভুল সংশোধন করতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ায়। তীর্থস্থান ভ্রমণ করতে থাকে। কতটুকু আন্তরিক ভক্তি আছে এতে, এ বলা বড় মুশকিল।

বেশির ভাগ মানুষই ছুটে চলেছে পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে। ঈশ্বরের কাছে গিয়ে কখনও কেউই ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে না। শুধু তাঁর দর্শন করতে যান না। কিছু না কিছু আর্জি পেশ করতেই হবে, মানুষের এই ধরণের মানসিকতা থাকা উচিৎ? মানুষের অবস্থা অনেকটা রামকৃষ্ণদেবের ‘কথামৃত’র সেই গল্পটির মতো যেখানে-

এক ব্যক্তির তামাকের ভারী নেশা ছিল। একদিন গভীর রাতে হঠাৎ তাঁর তামাকের নেশা লাগলো, তিনি হুঁকো সাজিয়ে আগুন ধরাতে যাবেন তখনই তাঁর খেয়াল হলো, আগুন তো নেই! তিনি তাঁর সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আগুন আর পাচ্ছেন না।

বাধ্য হয়ে প্রতিবেশীর কাছে আগুন আনতে গেলে প্রতিবেশী বলেন, ওরে! তুই তো লণ্ঠন নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছিস! আর তুই আগুনের খোঁজে এতো রাতে চলে এলি? আরে আগুন তো তোর কাছেই! তখন ঐ নেশায় উন্মত্ত লোকটির চেতনা ফিরলো এবং তিনি প্রতিবেশীর কথায় লজ্জিত হলেন।

অর্থাৎ ঈশ্বর আমাদের অন্তরেই বাস করেন, আমাদের চেতনা হলেই তাঁকে অনুভব করতে পারবো। নজরুল ইসলাম রচিত সেই বিখ্যাত গানের লাইনগুলো সর্বদা মনে রাখতে হবে-

অন্তরে তুমি আছো চিরদিন
ওগো অন্তরযামী!
বাহিরে বৃথাই যতো খুঁজি তাই
পাই না তোমারে আমি,
ওগো অন্তরযামী!

আমাদের ভেতরে কুণ্ডলিনী মা সাড়ে তিন প্যাঁচে অবস্থান করছেন। তিনি সুপ্ত অবস্থায় থাকলে মানুষের চেতনা হয় না। যোগ ও ধ্যানের মাধ্যমে তাঁকে জাগিয়ে তুলতে হবে। যদি একবার এই চেতনার জাগৃতি ঘটে, তাহলে মানুষ এই ধরাধামের সমস্ত সুখদুঃখকে অতিক্রম করে চলে যাবে এবং তিনি Living death অবস্থায় পৌঁছে যাবে।

Living death-এর অবস্থা হলো, জীবিত থেকেও এই পৃথিবীর সমস্ত মোহমায়া ত্যাগ করা, এই বিষয় নিয়ে অনেক মন্তব্য রয়েছে, তা অন্য একদিন আলোচনা করবো।

…………………………………
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে : ভারতের সাধক-সাধিকা
পুনঃপ্রচারে বিনীত -মেঘনা কুণ্ডু

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!