ভবঘুরেকথা
মানুষের আসল অভাব কালী ইন্দ্র সাধনা দেব বেদ

মানুষের আসল অভাবটা হচ্ছে ভগবানকে-না-পাওয়ার অভাব— সেই বিরাট অভাবটাই মূল অভাব। কিন্তু ঠাকুর খুব ফাঁকি দিতে জানেন, তাই ছোট ছোট নানান অভাব দিয়ে সেই বিরাট অভাবকে ভুলিয়ে রাখেন। সব অশান্তির মূল কারণ কিন্তু একটিই—ভগবৎ-অবস্থা থেকে বিচ্যুতি।

অপরের গুণকে বড় করে দেখাটাও একটা মস্ত বড় গুণ। সকলকেই বড় করলেই তো নিজেও বড় হয়ে যাবে। কারও কোনও গুণের কথা শুনে অনেকে সেটা কেটে দিয়ে বলে ওঠে— ‘ওটা এমন কিছু নয়।’ কিন্তু এটা করা ঠিক না। যার যেটুকু ভাল গুণ দেখবে, সেটাকেই বড় করবে, মর্যাদা দেবে। যার বিবেক জেগে আছে তার সব ঠিক আছে।

ভালবাসার এমন একটা পর্যায় আছে, যেখানে পৌঁছলে আর কোনও কিছু চাওয়ার থাকে না, কোনও কিছু পাওয়ারও থাকে না। তখন বুকটা সব সময় যেন ভরে থাকে, জগৎটা তুচ্ছ মনে হয়। নিজের ভেতর থেকে মহামায়াত্বকে সম্পূর্ণ সরাতে হবে। মহামায়া হচ্ছে মোহকরী শক্তি। প্রত্যেকের ভেতর সেটি রয়েছে। যে তার নিজের ভেতরের মহামায়াত্বটিকে বিসর্জন দিতে পেরেছে, সে আর কোন কিছুতেই মুগ্ধ হয় না।

মানুষের ভেতরে দুই-ই আছে, ফুল আর কাঁটা। আমরা ফুলটুকু গ্রহণ করব, কাঁটা যখন পাব তখন কষ্ট কি হবে না? কষ্ট ঠিকই হবে, কিন্তু তাই বলে কাঁটার পরিবর্তে কাঁটা দেব না। আমরা সাধু, আমরা ফুলই দিয়ে যাব জগৎকে। যে যা নয়, সে যদি তাই সাজে— তবে সেটা মানাবে না, কিছুতেই মানাবে না। সংসার সব কেড়ে নেয়, চুষে ফেলে দেয়। ভগবানকে দিলে তার চতুর্গুণ আমরা ফিরে পাই। কিন্তু সেটা পাই আমাদের অলক্ষ্যে, তাই বুঝতে পারি না।

সমস্ত অনুদারতার মূল হচ্ছে বাসনা। তপস্যা করতে করতে যখন অহংকার চলে আসে, তখনই হয় সাধকের পতন। তপস্যা করতে হবে, কারণ দেহবোধকে ভুলতে হবে। কিন্তু সাবধান, অহংকার যেন না আসে। মানুষ এমন কিছু করতে পারে না, যেটা তাঁকে পাবার মতো হতে পারে। সেই অমূল্য রত্নকে কেনবার মতো কোনও ধনই আমাদের নেই। তবু আমাদের এক পা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা দেখে তিনি সাত-পা এগিয়ে এসে কৃপা করেন। কৃপা সবসময় অহেতুক।

হুকুমের সুরে কাউকে কিছু করতে বললে, অহংকার প্রকাশ পায়, তাই সব সময় অনুরোধের সুরে বলবে। চাকরকেও হুকুমের সুরে বলতে নেই। মিষ্টি করে বলবে, ‘‘বাবা, এটা একটু ক’রে দাও তো!’’ সবাইকে সম্মান দিয়ে নম্রভাবে কথা বলবে। দেখবে যেন ক্রোধ না আসে। যতক্ষণ অহংকার আছে, ডাঙস খেতে হবে।

মানই হচ্ছে ঘরশত্রু বিভীষণ। মন যদি ঠিক থাকে, তা হলে কারও ক্ষমতা নাই কোনও কিছু করে। যদি সত্যই আধ্যাত্মিক পথে এগোতে চাও, তবে মনটাকে উদার করতে হবে। সেবা করতে করতে অনেক সময় অহংকার চলে আসে। মনে সে আকর্ষণ বা টান থাকে না, সেবাটা হয়ে ওঠে দায়সারা গোছের— করতে হবে বলেই করে যাওয়া। আসল উদ্দেশ্যটা ভুল হয়ে যায়। ভালবাসা যে সেবার মূল কথা, সেটাই ভুল হয়ে যায়।

আমাদের সমস্ত অশান্তির মূলে হচ্ছে প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজনটা যত বেড়ে যাচ্ছে স্বার্থচিন্তা ততই পেয়ে বসছে, আর তা থেকেই যত অশান্তি। প্রয়োজন কম থাকলে, এত অশান্তি হ’ত না।

ভালবাসা এমন একটা জিনিস যা বুকটাকে ভরিয়ে দেয়। কিছু পাক আর না পাক, ভালবেসেই তার সুখ। নিঃস্বার্থ ভালবাসা নেই বলেই এত অশান্তি। চাওয়াটা বড় কঠিন ব্যাপার। সামর্থ্যবান দাতার পক্ষে দিয়ে দেওয়াটা কিছু কঠিন নয়, কিন্তু পাওয়ার পর তার ভার বহন করা বড় কঠিন। তার যোগ্য মর্যাদা দেওয়াটাও শক্ত।

প্রতিভা হচ্ছে সত্য-শিব-সুন্দরের প্রকাশ। লেখক, শিল্পী, গায়ক সবাই যদি দিব্য জিনিস পরিবেশন করে, তবেই ঠাকুরের দেওয়া প্রতিভা সার্থক। যারা ঠাকুরের সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন, তাদের ওপরই তো ঠাকুরের একটা বিশেষ right আছে, দাবী আছে, অধিকার আছে। তাই সব আঘাতের বোঝা তাদের ওপর নিঃসঙ্কোচে চাপিয়ে দেন।

যদি ঈশ্বরে ভালবাসা না আসে? কী করণীয়?
আমাদের ঠাকুর বলেছেন, প্রার্থনা করতে— তিনি কৃপা ক’রে জোর ক’রে নিয়ে চলুন তাঁর দিকে। মনের সচেষ্ট ইচ্ছা থাকবে, পারছি না কিন্তু চাইছি। কাজেই বলতে হবে— তুমিই এটা করে দাও। যেমন সাধনা তেমন সিদ্ধি। মনকে ইষ্টমুখী করাই সাধনা।

সংসারের দিকে মন ছুটছে, চাহিদা জাগছে নানান্‌ রকমের। কিন্তু কেন? সব চাহিদা সব আকুলতা সংসারকে দেবে কেন? এটা তো ঠিক যে, আমরা কিছুটা অংশ অন্ততঃ ভগবানের দিকে দিতে পারি। কাজেই সেটা দিয়েই শুরু করতে হবে।

নামকীর্ত্তনের সময় খুব উচ্ছ্বাস দেখা যায়। হয়তো সাময়িক কিংবা লোক দেখানোই। ঐ সাময়িক উত্তেজনা উদ্দাম নৃত্য তারও লাভ আছে। এমনি না এলেও বসে ভেতর থেকে আকুলতা জাগানোর চেষ্টা। সেই চেষ্টাটাই সাধনা। দিনের পর দিন এটা করতে করতে শুভ সংস্কারের সৃষ্টি হবে। মানুষই তো শুভ অশুভ সংস্কারের সৃষ্টি করে তার আচরণের দ্বারা, তার কর্মের দ্বারা।

সমস্ত কর্তব্যের মূলে আছে ভালবাসা। মেয়েদের স্বভাব কোমল হবে, কিন্তু সেটার প্রকাশ হবে অপরের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ মাতৃভাবযুক্ত মনোভাব, দয়া, সেবা ইত্যাদির দ্বারা। এই কোমলতার অর্থ এই নয় যে, নৈতিক দৃঢ়তাকে বিসর্জন দেওয়া। আবার কোমলতাহীনের অর্থ এই নয় যে, নৈতিক কঠোর জিদপরায়ণ হতে হবে। নৈতিক দৃঢ়তার অর্থ আদর্শ জীবনের নীতিতে দৃঢ় থাকা, আধ্যাত্মিক জীবনে গুরুইষ্টের প্রতি নিষ্ঠায় দৃঢ় থাকা, মহৎ কাজে বা বড় কাজে অপরের বা নিজের ক্ষুদ্রতাকে পরিত্যাগ করা।

ঈর্ষা নিজের ও অপরের উভয়েরই ক্ষতি করে। মেয়েদের কোমল চালচলন এবং ব্যবহারের মধ্যে অনেক সময় মোহকরী শক্তির প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে কি নির্মম হতে হবে? না, তা নয়। এই কোমলতাকে পবিত্রতায় পরিশুদ্ধ ক’রে নিতে হবে আর তা প্রকাশ করতে হবে দেবভাবের মাধ্যমে। ভগবানই হচ্ছেন সবচেয়ে আপনজন। তাঁর চেয়ে আপন আর কেউ নেই। যারা ভগবানকে ভালবাসে, তারাই ঠিক ঠিক মানুষকে ভালবাসে। যারা ভগবানকে ভালবাসে না, তারা মানুষকেও ঠিক ঠিক ভালবাসতে পারে না।

কৃপা করা না করা তাঁর ইচ্ছা। সেক্ষেত্রে ঠাকুরের কাছে এই বলে Order বা হুকুম করা চলবে না— আমি এত করেছি তাই এত দিতে হবে। প্রার্থনা আর Order এক নয়। কৃপার রাজ্যের কথা আলাদা। ঠাকুর যে কখন কাকে কিভাবে কৃপা করবেন, তা কেউ বলতে পারে না। ভালবাসতে গেলে আঘাত পেতেই হবে। ভগবানের ভালবাসা নিঃস্বার্থ ভালবাসা। ভগবান যখন মানুষরূপে আসেন তাঁকে আঘাত পেতে হয়। অবতার আসেন ভালবাসার চরম আদর্শ দেখাতে।

অন্তরের ক্ষোভ বা বাসনা পুষে রাখলে কখনও সার্থক মানুষ হওয়া যায় না। মনকে সব সময় শান্ত রাখতে হবে। লক্ষ্য রাখবে যাতে কোনও বাসনা ঢুকে মনকে অশান্ত করতে না পারে। সন্ন্যাসী যে হবে তাকে করতে হবে সব কিছুর সম্যক ন্যাস। যার অন্তরের বাসনার সম্যক্‌ ন্যাস হয়েছে সে-ই সার্থক সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর কোনও ক্ষোভ থাকবে না। তীব্র বৈরাগ্য না নিয়ে এলে আশ্রমে কেউ ঠিক ঠিক ভাবে থাকতে পারে না। আশ্রমে থাকতে গেলে চাই তীব্র বৈরাগ্য।

একমাত্র আধ্যাত্মিক পথই মানুষকে শান্তি দিতে পারে। যার যেমন সামর্থ্য তার তেমনই চলা উচিত। অন্যের অনুকরণ করে নিজের সামর্থ্যের বাইরে কখনই চলা উচিত নয়। এতে গৃহে অশান্তির সৃষ্টি হয়, মনে বাসনা জেগে ওঠে, তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। যে যার নিজের পথে ঠিকমত চললেই সংসারে শান্তি আসবে। এজন্য তীব্র প্রার্থনা করতে হয়।

………………………………………….
‘শ্রীঅর্চনামায়ের বাণী’ বর্তমান পত্রিকা থেকে
পুণঃপ্রচারে বিনীত
প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!