-ড. হাসান রাজা
‘গণনাকৃত সময়সমূহ সিয়াম, অতএব তোমাদের মধ্যে যে পীড়িত অথবা ভ্রমণের উপর আছে তাহার গণনা পরবর্তী কালসমূহের প্রতিটি হইতে (গ্রহণীয়)। এবং যে শরাঘাত খাওয়া তাহার উপর মুক্তিপণ রহিল একজন মিসকিনকে আহার্য দান। তারপর যে ব্যক্তি ততোধিক সৎকর্ম স্বেচ্ছায় করে উহা তাহার জন্য কল্যাণকর। এবং যদি সিয়াম কর, তোমাদের জন্য (তাহা) কল্যাণকর যদি তোমরা বুঝিয়া থাক।’ (আল কোরান ২:১৮৪ )
গণনাকৃত সময়সমূহই সিয়াম কাল। এই কথার মধ্যেই মূল সিয়ামের নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত আছে। সপ্ত ইন্দ্রিয় পথে ধর্মরাশীরূপে যেসব বিষয়বস্তু মস্তিষ্কের দিকে আসে তাহার প্রত্যেকটি বিষয় এক এক করে হিসাব মতো বর্জন করার পদ্ধতির নাম ‘সিয়াম’।
পীড়িত এবং ভ্রমণরত অবস্থায় বিষয়গুলির প্রত্যেকটির আগমণকে গণনা করে বর্জন করা সম্ভব হয় না। এইজন্য এইরকম দুই অবস্থায় সিয়াম করা নিষেধ করা হয়েছে। তবে অবশ্য পালণীয় সিয়াম হিসাবে পরবর্তী সময়ে ইহা পূরণ করার নির্দেশ রয়েছে।
সৎগুরু তাঁর নিজ থেকে আগত কোরান শিক্ষা দিয়ে অধীনস্থ ভক্ত জীবগণকে ইনসান বানিয়ে থাকেন (৫৫:১)। এই রকম ইনসান তথা মোত্তাকীদের জন্যই কোরান হেদায়েত। জীব প্রকৃতির মানুষের জন্য কোরান বোধগম্য বা যোগ্য নয়।
যে ব্যক্তি গুরুভক্ত কিন্তু এখনও জীব পর্যায়ভুক্ত অর্থাৎ আমানু হয় নি সে ব্যক্তি সিয়াম সাধনা করতে যেয়ে বিষয়বস্তুর তীরাঘাত এতো বেশী খায় যে, প্রকৃত সিয়াম সাধনা তার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে তার জন্য ব্যবস্থা হলো একজন গুরুভক্ত মিসকিনকে খাদ্যবস্তু দান করা।
মিসকিন তাকেই বলে যিনি গুরুভক্ত এবং আল্লাহপ্রাপ্তির জন্য সংসার ও সকল দুনিয়াবী সংশ্লিষ্টতা তথা সকল বিষয়বস্তুর মোহ ত্যাগ করে সর্বহারা হয়েছেন। যদি কেহ একজন মিসকিনকে খাদ্যবস্তু দানের পরেও অন্যান্য প্রকার সৎকর্ম করে তবে সেটা বেশী কল্যাণকর।
অপরপক্ষে যদি কেহ সিয়ামের প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্ধি করে সকল প্রকার প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও সিয়াম সাধনায় দৃঢ়ভাবে লিপ্ত থাকে তবে সেটা তার জন্য অবশ্য কল্যাণকর।
‘রমজান মাস ইহাতে কোরান নাজেল হয় যাহা মানুষের জন্য একটি হেদায়েত এবং হেদায়েতেরে একটি ব্যাখ্যা এবং ফোরকান। অতএব তোমাদের মধ্যে যে এই মাসকে প্রত্যক্ষ করে সে-ই সিয়াম করে। এবং তোমাদের মধ্যে যে পীড়িত অথবা ভ্রমণের উপরে আছে তাহার গণনা পরবর্তী কালসমূহের হইতে গ্রহণীয়।
তোমাদের সহিত যাহা সহজ তাহাই আল্লাহ ইচ্ছা করেন এবং তোমাদের সহিত যাহা কঠিন আল্লাহ তাহা ইচ্ছা করেন না; এবং গণনাটিকে কৃতকার্য করিয়া তোলার জন্য এবং যে হেদায়েত তোমাদিগকে দেওয়া হইয়াছে তাহার (আদর্শের) উপরে আল্লাহকে বড় করিয়া তোলার জন্য এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে পার।’ (আল কোরান ২:১৮৫)
‘কোরান নাজেল হওয়া’ কথাটি সর্বকালীন এবং সর্বজনীন একটি বিষয়। সাধকের কাছে তাঁর আলোকিত সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক থেকে আত্মদর্শনের পূর্ণাঙ্গ যে পাঠ নাজেল হয় বা বের হয় তাকেই বলা হয়েছে কোরান। পূর্ণাঙ্গ সাধকের আত্মদর্শনের পাঠকে অর্থাৎ অভিব্যক্তিকেই কোরান বলে। আরবি কোরান এ সকলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।
কোরানই খোদাভক্ত মুত্তাকি মানুষের জন্য একমাত্র হেদায়েত বা সুপথ প্রদর্শনকারী। কোরান সাধকের ‘রমজান মাস’ অর্থাৎ শিরিক পরিত্যাক্ত কাল ব্যতীত অন্য সময় নাজেল হয় না। চরম সাধক থেকে আগত কোরান অর্থাৎ পরম একজন গুরু থেকে আগত কোরান ইনসানের জন্য হেদায়েত। ইনসান থেকে নিম্নপর্যায়ের মানুষের জন্য কোরান হেদায়েত নয় (২:২)
সৎগুরু তাঁর নিজ থেকে আগত কোরান শিক্ষা দিয়ে অধীনস্থ ভক্ত জীবগণকে ইনসান বানিয়ে থাকেন (৫৫:১)। এই রকম ইনসান তথা মোত্তাকীদের জন্যই কোরান হেদায়েত। জীব প্রকৃতির মানুষের জন্য কোরান বোধগম্য বা যোগ্য নয়।
এর ফলে বস্তুবাদের মোহের ছাপ তথা শিরিক বা সংস্কার মস্তিষ্কে আবদ্ধ হয়ে থাকে না, সকলই পরিত্যক্ত (Rejected) হয়ে যায়। এটাই সিয়ামের মূল কথা। সিয়ামের অভ্যন্তরীণ কথাটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও দৈহিকভাবে অসুস্থ এবং দৈহিক ভ্রমণকারীর সিয়াম পালন নিষিদ্ধ করে তা পরে পালন করা ওয়াজেব অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় করা হয়েছে।
কামেল গুরু থেকে শিক্ষালাভের পর শিষ্যগণ কোরানের প্রকৃত জ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করে ইনসানে পরিণত হয়ে থাকেন। যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত প্রতিনিধিগণই গুরুরূপে মানব জাতীর শিক্ষক হিসেবে সুপথ প্রদর্শনকারী মাহ্দী।
সায়েমের কাছে তাঁর সিয়ামের কালে হেদায়েতের ব্যাখ্যা এবং ফোরকান নাজেল হয়। মানব জীবন সার্থকভাবে মুক্তির দিকে পরিচালনার জন্য সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে যত প্রকার হেদায়েতের (Guidence) প্রয়োজন হয় তার সব ধরণের জ্ঞানে একজন সায়েম পরিপূর্ণ হয়ে থাকেন।
সিয়াম সাধনার সময়ে সিয়ামের ফলশ্রুতি স্বরূপ সায়েমের কাছে ফোরকান অর্থাৎ ভাল-মন্দ প্রভেদ জ্ঞান তথা সকল বিষয়ের পার্থক্যকারী জ্ঞান নাজেল হয়, যার দ্বারা বস্তুর বন্ধন থেকে মুক্তিপথের সঠিক দিক্ নির্দেশনা পাওয়া যায়। সিয়াম করা অর্থ সপ্ত ইন্দ্রিয় পথে যে সকল বিষয়াশয় মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তার মোহ বর্জন করা।
এইরকম মোহ বর্জনের গুরুত্ব যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় অর্থাৎ উপলব্ধি করে সেই ব্যক্তিই কেবল এই মাসে সিয়াম করে। অন্য লোকরা কেবল পানাহারের সময়সূচির বিধান পালন করেই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। অনেকে আবার রসনা সংযমের পরিবর্তে রসনা বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েন।
পীড়া এবং ভ্রমণ, এসব দৈহিক এবং মানসিক উভয় প্রকারের হয়ে থাকে। মানসিকভাবে পীড়িত এবং বিষয়বস্তুর উপর মানসিক ভ্রমণে রত ব্যক্তির পক্ষে সিয়াম পালন করা সম্ভবপর হয় না বিধায় তাদের প্রতি নির্দেশ হচ্ছে, যেন তারা সিয়াম পালনের উপযুক্ত মানসিক যোগ্যতা অর্জনের পর তা ‘পালন করিতে’ যত্নবান হয়।
‘পালন করা’ কথাটি এখানে নাই, রয়েছে গণনা করার কথা। কোরানের কথা হচ্ছে- পরবর্তী কালসমূহের অর্থাৎ প্রতিটি ধর্ম আগমণের কালসমূহ থেকে আগমণকারী সকল ধর্মকে এক এক করে গণনা করা। এর অর্থ আগমণকারী প্রতিটি ধর্মই যেন তার জ্ঞাতসারে আগমণ করে এবং বিদায় গ্রহণ করে।
এর ফলে বস্তুবাদের মোহের ছাপ তথা শিরিক বা সংস্কার মস্তিষ্কে আবদ্ধ হয়ে থাকে না, সকলই পরিত্যক্ত (Rejected) হয়ে যায়। এটাই সিয়ামের মূল কথা। সিয়ামের অভ্যন্তরীণ কথাটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আনুষ্ঠানিক সিয়াম পালনের ক্ষেত্রেও দৈহিকভাবে অসুস্থ এবং দৈহিক ভ্রমণকারীর সিয়াম পালন নিষিদ্ধ করে তা পরে পালন করা ওয়াজেব অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় করা হয়েছে।
একজন প্রকৃত সাধক মানুষের পরিপূর্ণ সিয়াম পালনের জন্য সমাজে প্রচলিত সহায়ক অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে-
১. সেহেরি : To take a morning meal বা ঊষাকালের পূর্ববর্তী নাস্তা। হযরত আনাস হতে বর্ণিত আছে, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ বলেছেন, ‘সেহেরি কর, কারণ নিশ্চয় সেহ্রীর মধ্যে বরকত আছে।’
‘বরকত’ অর্থ বৃদ্ধি বা বর্ধিষ্ণু, প্রাচুর্য আনয়নকারী, প্রাচুর্যদাতা। সেহেরি গ্রহণের ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে না। এতে সায়েম মস্তিষ্কে আগত বিষয়রাশীর সাথে জড়িত চিন্তাগুলিকে বিশ্লেষণ করে তার মধ্য থেকে দুনিয়ার মোহকে বিচ্ছিন্ন করার আত্মিক শক্তি অর্জন করেন।
২. তারাবীহ : ‘তারাবীয়াৎ’ থেকে ‘তারাবীহ’। ‘তারাবীয়াৎ’ অর্থ ধীরতা, স্থিরতা। একাকী ধীরে সুস্থে, আপন মর্জি মাফিক (With free style) পালন করার সালাত তারাবীহ। তারাবীহ সালাত সাধারণত ৪ রাকাত থেকে ৮ রাকাত দীর্ঘ করে পড়া যায়।
মসজিদে জামাত করে ২০ রাকাত তারাবীহ সালাত মাওলানা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ দেহত্যাগের ৭ বছর পর হযরত ওমর নববিধান (বেদাত) হিসাবে প্রচলন করেন। মওলা আলী তাঁর শাসনামলে এটি বন্ধ করেন এবং আমির মাবিয়া তার আমলে এটি আবার প্রচলন করেন।
৩. বেসাল : রাত দিন ২৪ ঘণ্টায় একটি একদিনের সিয়াম হয়। ৭২ ঘণ্টা অর্থাৎ একাধারে তিন দিন দুই রাত পানাহার ত্যাগ করে ধ্যানের গভীরতা সৃষ্টির জন্য যে সিয়াম পালন করা হয় তাকে সিয়ামে বেসাল বলা হয়। রমজানের দীর্ঘ একমাস পানাহার বর্জন করেও সত্যিকার সিয়াম পালনের আদর্শগত ব্যবস্থা হিসাবে রাসুলুল্লাহ্ ‘সিয়ামে বেসাল’ পালনের মাধ্যমে নমুনা স্বরূপ দেখিয়েছেন।
ইফতার দুই প্রকার। যথা- জাহেরী ইফতার ও বাতেনী ইফতার। গুরুর তত্ত্বাবধানে আপন অস্তিত্বের দিকে আগত বিষয়রাশীকে বিষমুক্ত করে মন থেকে দেহের আকর্ষণকে বিচূর্ণ করার ম্যাধমে যে আত্মমুক্তি ঘটে মূলত তাই ইফতার। সাধারণভাবে আমরা রমজান মাসে যখন যা পানাহার করি তাই বস্তুগত বা জাহেরী ইফতার।
যাতে মানুষ আনুষ্ঠানিক সিয়ামের মৌলিকত্ব ভুলে না যায়। কারণ সাধনাকালীন সময়ে খাদ্যগ্রহণ প্রভুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের পথে বাঁধাস্বরূপ। বেসাল পালনের এই আদর্শ এখন আর এজিদপন্থী ওহাবী-সালাফি মোল্লাদের মুখে কোনভাবেই শোনা যায় না।
সকল প্রকার বিষয়াশয়, ক্ষুধা-তৃষ্ণা জয় করে একমাত্র মহান রবের গুণাবলী অর্জনের লক্ষ্যে, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সকল কিছু থেকে বিরত থাকার এই প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত বৃদ্ধির জন্যই রাসুলে করিম রমজান মাসের ৩০ দিনকে দশ দিন করে করে ভাগ করেছিলেন।
তিঁনি রমজানের প্রথম দশ দিনকে রহমত, পরের দশ দিনকে মাগফেরাত এবং শেষ দশ দিনকে নাজাত লাভের সময় হিসেবে বর্ণনা করেন। তাই প্রথম দশ দিন সকালে সন্ধ্যায় খাদ্য গ্রহণ, পরের দশ দিন পরপর তিন দিন বা বাহাত্তর ঘণ্টা পরপর খাদ্য গ্রহণ পরিশেষে শেষ দশ দিনে একবার বা দুই বার খাদ্য গ্রহণ করে সকলের কাছে থেকে, সবকিছু থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর দর্শন লাভের জন্য নির্জনে বা মসজিদের এক কোণে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হওয়ার নাম এতেকাফ।
৪. এতেকাফ : ‘এতেকাফ’ এর শাব্দিক সাধারণ অর্থ কোনো জায়গায় অবস্থান করা বা থাকা। ধর্মীয় পরিভাষায় সংসার কর্তব্য থেকে দূরে থেকে দুনিয়া হতে মনের সংশ্লিষ্টতাকে বিচ্ছিন্ন করে নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন, বিশেষ করে চলতি নিয়মানুসারে রমজানের শেষ দশ দিন নির্জনে বা মসজিদে থেকে আল্লাহ্ দর্শন লাভের জন্য গভীর ধ্যান সাধনায় আত্মনিমগ্ন থাকায় এতেকাফ।
৫. লাইলাতুল ক্বদর : ‘লাইলাতুল ক্বদর’ অর্থ শক্তিশালী রাত (মনের মহাশূন্য অবস্থা)। সিয়াম সাধনার গভীরতার মধ্যে বিষয়বস্তুর বিষাক্ততাকে দর্শন ও বর্জনের নিরবচ্ছিন্ন সাধনার মাধ্যমে সাধক এই শক্তিশালী মানসিক অবস্থা লাভ করেন। একাগ্রভাবে গুরুমুখী ধারায় সঠিকভাবে সিয়াম পালন করলে ক্বদর রাত্রীর সন্ধান পাওয়া যায়।
যার ফলে সাধকের কাছে নাজেল বা স্পষ্ট হয় কোরান, হেদায়েতের ব্যাখ্যা এবং ফুরকান। রমজানের নৈসর্গীক একটি রাত্রীকে ক্বদর রাত্রী হিসাবে পালন করা চলমান সমাজে একটি প্রতীকি ব্যাপার মাত্র। সাধকের জীবনে যে কোনও সময়ই ক্বদর রাত্রীর আবির্ভাব হতে পারে।
৬. ইফতার : ‘ফাতারা’ শব্দ থেকে ‘ইফতার’ শব্দটি এসেছে। ‘ফাতারা’ অর্থ দেহমন ভেঙ্গে ফেলা। যাতে করে পুনরায় দেহমনের সমন্বয়ে নবজন্ম লাভ না হয়। এই জন্য প্রকৃত মুসলমান হতে পারলে তার জন্য আর কোন নবজন্মে রূপান্তর সৃষ্টি নেই।
২৪ ঘণ্টা বা একদিন, ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন অথবা একমাস কিংবা জীবনভর সিয়াম সাধনার একটাই লক্ষ ইফতার লাভ করা। ইফতারের মাধ্যমে ক্ষণস্থায়ী বন্দি জীবন থেকে চিরমুক্তি লাভ করে সাধক মহান রব্বুল আলামিনের গুণাবলী অর্জন করে চিরমুক্ত লা-মোকামে অবস্থান করতে পারেন।
ইফতার দুই প্রকার। যথা- জাহেরী ইফতার ও বাতেনী ইফতার। গুরুর তত্ত্বাবধানে আপন অস্তিত্বের দিকে আগত বিষয়রাশীকে বিষমুক্ত করে মন থেকে দেহের আকর্ষণকে বিচূর্ণ করার ম্যাধমে যে আত্মমুক্তি ঘটে মূলত তাই ইফতার। সাধারণভাবে আমরা রমজান মাসে যখন যা পানাহার করি তাই বস্তুগত বা জাহেরী ইফতার।
যার ফলে মৃত্যু তাকে আর পুনরায় বিরক্ত করতে পারে না। কোরানের ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় ‘মুতু ক্বাবলা আনতা মুতু’ বা মরার পূর্বেই মরিয়া যাওয়া। একজন প্রকৃত সায়েম সিয়ামের পরিপূর্ণতায় পরিশেষে মহান রবের দর্শনলাভের মধ্যদিয়ে মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুকে জয়লাভ করার শক্তি অর্জন করে জগৎবাসীর হেদায়েতের অধিকার লাভ তথা অলিত্ব বা মুমিনত্ব অর্জন করেন।
আর সকল প্রকার কামনা বাসনাকে জয় করে ‘কামালিয়াৎ’ অর্জন করা তথা সৃষ্টির মোহবন্ধন থেকে মুক্তিলাভের আত্মিক শক্তি অর্জন করার নামই হলো প্রকৃত ইফতার। কামেল মুর্শেদ বা গুরুর তত্ত্বাবধান ছাড়া একা একা এই ইফতার লাভ করা যায় না।
যিনি নিজে কামালিয়াৎ লাভ কোরে ইফতার প্রাপ্ত হয়েছেন তিনিই কেবল তার একনিষ্ট অনুসারীকে পূর্ণ ইফতার করাতে পারেন। নিজে ইফতার প্রাপ্ত অর্থাৎ কামেল না হলে অন্যকে ইফতার করানো সম্ভব নয়। তাই মহান আল্লাহ্তায়ালা নিজে বলেছেন, ‘রমজান আমার জন্য, তাই আমি নিজ হাতে ইহার প্রতিফল দান করি এবং আমি নিজেই রমজানের সিয়াম সাধনার প্রতিফল তথা ইফতার।’
এইজন্য পৃথিবীতে সৃষ্ট দেহধারী প্রতিটি মানুষের দেহমনের সঙ্গে সিয়াম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তথা দেখা, শোনা, বলা, করা, খাওয়া, চলা-ফেরা, চিন্তা-ফিকিরসহ সকল পর্যায়ে সবধরণের সংস্কারের মোহত্যাগসহ খারাপ চিন্তা ও বিষয়বস্তু থেকে নিজেকে বিরত রেখে মহান আল্লাহর অসীম ও পবিত্র গুলাবলীর মধ্যে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার নাম সিয়াম।
এই সিয়াম মানবজীবনকে সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে ক্রমশ সুরক্ষা দেয়। এবং বিশেষ পর্যায়ে সাধক বা সায়েম সকল বস্তুগত নির্ভরতা পরিত্যাগ করে মহান রবের রবুবিয়াতের মধ্যে তথা আল্লাহর পবিত্র গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মৃত্যুকে জয় করে মহান রবের চিরস্থায়ী রেজেক লাভ করেন। একজন প্রকৃত সায়েম তাই সকল ক্ষণভঙ্গুর বস্তুগত নির্ভরতা ত্যাগের মাধ্যমে মৃত্যুর পূর্বেই মরিয়া যান।
যার ফলে মৃত্যু তাকে আর পুনরায় বিরক্ত করতে পারে না। কোরানের ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় ‘মুতু ক্বাবলা আনতা মুতু’ বা মরার পূর্বেই মরিয়া যাওয়া। একজন প্রকৃত সায়েম সিয়ামের পরিপূর্ণতায় পরিশেষে মহান রবের দর্শনলাভের মধ্যদিয়ে মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুকে জয়লাভ করার শক্তি অর্জন করে জগৎবাসীর হেদায়েতের অধিকার লাভ তথা অলিত্ব বা মুমিনত্ব অর্জন করেন। যা মানবজীবনের পরম পাথেয়। সাধকের সর্বোচ্চ অধ্যায়।
সুতরাং পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষের জন্য এই সিয়াম তথা বস্তু নির্ভরতা থেকে আত্মমুক্তিলাভের এই সাধনা সর্বকালীন ও সর্বজনীন। জগতের যে কোন প্রান্তের যে কোন আত্মমুক্তিকামী মানুষ তাই সিয়াম সাধনা করে মানব জীবনের সর্বোত্তম আরাধ্য স্থরকে অর্জন করতে পারেন।
মাওলা আমাদের সকলকে পবিত্র রমজানের হাক্বিকতলাভের মাধ্যমে মানবজীবনের সর্বোচ্চ স্থর ইনসানে কামেল হওয়ার তৌফিক দান করুন। পৃথিবীতে আগত অনাগত সকল সৃষ্টির কল্যাণ হোক।
………………………………….
ড. হাসান রাজা
লেখক ও গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………………….
আরো পড়ুন:
রমজান: সংযোমের সাধন:: এক
রমজান: সংযোমের সাধন:: দুই
রমজান: সংযোমের সাধন:: তিন
মানুষের জন্য সিয়াম: এক
মানুষের জন্য সিয়াম: দুই
শবে বরাত: নাজাতে ফিকির
শবে মেরাজ: ঊদ্ধলোকের রহস্যযাত্রা
মেরাজতত্ত্ব
মেরাজ