তপস্যা কি? তপস্যার প্রকারভেদ কি এ নিয়ে নানা মুণির নানা বাণী প্রচারিত আছে। লিখিত-মৌখিক নানা ভাবেই এসব নিয়ে আলোচনা করেছেন জ্ঞানীগুণী জন। তবে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের অনুসারে তপস্যা তিন প্রকার সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক। এই তিন প্রকার তপস্যা কাকে বলে? যথার্থ গীতা এ প্রসঙ্গে কি বলেছে তা নিয়েই মূলত এই রচনা। এ প্রসঙ্গে গীতার শ্লোককে স্বামী অড়গড়ানন্দজী যথার্থ গীতায় অনুবাদ করেছেন-
সাত্ত্বিক তপস্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
দেবদ্বিজগুরুপ্রাজ্ঞপূজনং শৌচমার্জবম্৷
ব্রহ্মচর্যমহিংসা চ শারীরং তপ উচ্যতে।।১৭/১৪।।
পরমদেব পরমাত্মা, দ্বৈতভাব জয়কর্তা দ্বিজ, সদ্গুরু এবং জ্ঞানীগণের পূজা, পরিত্রতা, সরলতা, ব্রহ্মচর্য এবং অহিংসা- এইগুলোকে কায়িক তপস্যা বলে। দেহ সর্বদা বাসনাভিমুখে ধাবিত, একে অন্তঃকরণের উপর্যুক্ত বৃত্তির অনুরূপ গড়ে তোলাই কায়িক তপস্যা।
অনুদ্বেগকরং বাক্যং সত্যং প্রিয়হিতং চ যৎ।
স্বাধ্যায়াভ্যসনং চৈব বাঙ্ময়ং তপ উচ্যতে।।১৭/১৫।।
অনুদ্বেগকর, প্রিয়, হিতকর এবং সত্যবচন ও পরমাত্মায় স্থিতি প্রদান করে যে শাস্ত্রগুলি, সেই শাস্ত্রের চিন্তনের, নামজপকে বাচিক তপস্যা বলে। বাণী বিষয়োন্মুখ বিচারগুলিকেও ব্যক্ত করে থাকে। একে সেদিক থেকে সংযম করে পরমসত্য পরমাত্মার চিন্তনে নিযুক্ত করাকে বাচিক তপস্যা বলে।
মনঃপ্রসাদঃ সৌম্যত্বং মৌনমাত্মবিনিগ্রহঃ৷
ভাবসংশুদ্ধিরিত্যেতত্তপো মানসমুচ্যতে।।১৭/১৬।।
মনের প্রসন্নতা, সৌমভাব, মৌন অর্থাৎ ইষ্টের অতিরিক্ত অন্য বিষয়ের স্মরণও যেন না আসে, মনের নিরোধ, অন্তঃকরণের পরিত্রতা- এই সকলই মানসিক তপস্যা। উপর্যুক্ত তিনটি (কায়িক, বাচিক ও মানসিক) যে তপস্যা করেন, তাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলা হয়।
শ্রদ্ধয়া পরয়া তপ্তং তপস্তৎ ত্রিবিধং নরৈঃ৷
অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যুক্তৈঃ সাত্ত্বিকং পরিচক্ষতে।।১৭/১৭।।
ফলাকাঙ্ক্ষাবিহীন অর্থাৎ নিষ্কাম কর্মে প্রবৃত্ত ব্যক্তিগণ পরমশ্রদ্ধাসহকারে পূর্বোক্ত কায়িক, বাচিক ও মানসিক যে তপস্যা করেন, তাকে সাত্ত্বিক তপস্যা বলে।
রাজসিক তপস্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
সৎকারমানপূজার্থং তপো দম্ভেন চৈব যৎ।
ক্রিয়তে তদিহ প্রোক্তং রাজসং চলমধ্রুবম্।।১৭/১৮।।
সৎকার, সম্মান ও পূজা পাবার আশায় অথবা দম্ভপূর্বক যে তপস্যা করা হয়, সেই অনিশ্চিত এবং ক্ষণিক ফলবিশিষ্ট তপস্যাকে রাজসিক তপস্যা বলে।
তামসিক তপস্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
মূঢ়গ্রাহেণাত্মনো যৎপীড়য়া ক্রিয়তে তপঃ৷
পরস্যোৎসাদনার্থং বা তত্তামসমুদাহৃতম্।।১৭/১৯।।
যে তপস্যা মুর্খতাপূর্বক আগ্রহ দ্বারা, মন, বাণী ও দেহকে কষ্ট দিয়ে অথবা অপরের অনিষ্টের জন্য করা হয়, তাকে তামসিক তপস্যা বলে।
এইরূপ সাত্ত্বিক তপস্যাতে দেহ, মন ও বাণীকে ইষ্টের অনুরূপ তৈরি করা হয়। রাজসিক তপস্যাতে ক্রিয়া সেই একই; কিন্তু দম্ভমান সম্মানের ইচ্ছা নিয়ে তপস্যা করেন। প্রায়ই মহাত্মাগণ গৃহত্যাগ করার পরেও এই বিকারের শিকার হন এবং তামসিক তপস্যা অবিধিপূর্বক সম্পাদন হয়, পরপীড়নের জন্য করা হয়।
পরমদেব পরমাত্মাতে স্থিতি প্রদান করতে যিনি সক্ষম, সেই প্রাজ্ঞ সদ্গুরুর সেবা-অর্চনা এবং অন্তঃকরণ থেকে অহিংসা, ব্রহ্মচর্য এবং পবিত্রতার অনুরূপ দেহ গড়ে তোলাই শারীরিক তপস্যা। সত্য, প্রিয় ও হিতকর বাক্যকে বাচিক তপস্যা বলে এবং মনকে কর্মে প্রবৃত্ত রাখা, ইষ্ট ব্যতীত বিষয়সমূহের চিন্তনে মনকে শান্ত রাখা- এই সকলকে মানসিক তপস্যা বলে। মন, বাণী ও দেহ তিনটি এক করে তপস্যাতে নিযুক্ত করাই সাত্ত্বিক তপস্যা। রাজসিক তপস্যাতে কামনা করে সেই কর্মই অনুষ্ঠিত হয়, শাস্ত্রবিধিরহিত স্বেচ্ছাচারযুক্ত আচরণকে তামসিক তপস্যা বলা হয়।
যথার্থ গীতা থেকে সংগৃহিত…
2 Comments