যে পেল সেই রূপের সন্ধান: দুই
-ফিরোজ এহতেশাম
টুনটুন: হ্যাঁ, ওই জ্ঞান। জ্ঞান তো ব্রহ্মাণ্ডের নাই। এ হলো যান্ত্রিক জিনিস তৈরী করে দিছে।
ফিরোজ: যান্ত্রিক জিনিসগুলা যখন আমাদের ভিতরে সমন্বিত হইছে তখন জ্ঞান উৎপন্ন হইছে?
টুনটুন: হ্যাঁ।
ফিরোজ: ওই জ্ঞানটা আমাদের অতিরিক্ত। ব্রহ্মাণ্ডের চেয়েও আমাদের তাহলে বেশি?
টুনটুন: অতিরিক্ত।
ফিরোজ: আপনি যেটা বললেন যে, নিজেকে জানতে হবে। তো আত্মতত্ত্বের ব্যাপারটা কি এটাই?
টুনটুন: আত্মার খবর করা। আত্মতত্ত্ব মানে আত্মার ভেতরে আল্লাহ।
ফিরোজ: আত্মার ভেতরে আল্লাহ লুকানো?
টুনটুন: হ্যাঁ। আল্লাহ তো তোমার দেহের বাইরে নাই। ওই যে ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে তা তো মানবভাণ্ডেও। দেহেরই উপাসনা করা, দেহকে সুন্দর রাখা, দেহকে যত্ন করা, দেহকে ভজনা করা, দেহকে… ও তো আল্লাহ। আল্লাহর মতো দেহকে মানো। যখন তুমি তোমার গুরুকে, দেহকে আল্লাহর মতো মানতে পারবে তখন তোমার দেহটা আল্লাহ হয়ে যাবে।
ফিরোজ: সাধনার একটা পর্যায়ে মনসুর হাল্লাজ বলল যে, আনাল হাক্ক?
টুনটুন: আনাল হাক্ক, মানে আমি আল্লাহ।
ফিরোজ: মানে ওই স্তরে সে চলে গেছিল যে আল্লাহর সাথে ফানাফিল্লা, একাত্ম হয়ে গেছিল…
টুনটুন: তাহলে কত কাল আগে বলে থুয়ে গেছে যে আমিই আল্লাহ।
ফিরোজ: আমিই আল্লাহ!
টুনটুন: হে বান্দা, তুমি বলতে শেখো তুমি কে। আল্লাহ বলেছেন, বান্দা তুমি বলতে শেখো তুমি কে। তুমি একজন বান্দা, তোমার ভেতরে যদি আল্লাহি ভাব না থাকে… আল্লাহ তো ধরা খায়নি কোথাও। আল্লাহ একমাত্র ধরা খাইছে আদমের কাছে। কত কোটি শ’ বছর বসে আল্লাহ মানুষকে তৈরী করার যে… এটা কেন? পৃথিবীর কোনো জ্ঞান নাই। পৃথিবী তৈরী করেছে আল্লাহ। পৃথিবীর কোনো জ্ঞান নাই। আছে জ্ঞান এই মানুষের।
ফিরোজ: আত্মতত্ত্বের ব্যাপার তাহলে এটাই?
টুনটুন: এটাই। আত্ম, নিজকে জানো। আত্মার ভেতর থেকে যে হাওয়া বেরুচ্ছে, ঢুকছে। মেশিনটা কি করে হাওয়া উৎপত্তি করাচ্ছে এটা তোমাকে জানতে হবে। তুমি জেনে যাবা।
ফিরোজ: লালনের গানের ভিতরে যে কিছু কিছু শব্দ আছে, যেমন ‘ফুল’, ফুল মানে তো আমরা জানি যার গন্ধ আছে। কিন্তু উনার (লালনের) গানের মধ্যে ফুল তো বিশেষ একটা অর্থ বহন করে।
টুনটুন: ফুল মানেই রহমানুর রহিম, মা। চাঁদ মানে মা। লালন… বাংলা ভাষায় তো আল্লাহ হয় না। বাংলা ভাষায় কী হবে?
ফিরোজ: ঈশ্বর?
টুনটুন: ঈশ্বর, প্রভু, দাতা, পতিত পাবন, পরমেশ্বর- এই সব বাংলা ভাষায়। তো ওই জন্য, প্রত্যেক জাতির জন্য আল্লাহ একটা করে মানুষ হওয়ার, তৈরী করার জন্য মানুষ পাঠায়।
ফিরোজ: মানুষ তৈরী করার জন্য মানুষ পাঠায়?
টুনটুন: পাঠায়। মানুষ ছাড়া তো মানুষের সন্ধান কেউ দিতে পারবে না।
ফিরোজ: পশু-পাখি তো আর মানুষের সন্ধান দিতে পারবে না?
টুনটুন: পারবে না। পারবে? এই জন্য নিজকে জানতে হবে। আমি যে মানুষ, আমি কতটুকু মানুষ হতে পারলাম। মানুষের করণটা কী? কী সাধনা করলে আল্লাহ খুশি হয়ে আমাকে বলবে, ওহ আমার বান্দাটা! এরকম আল্লাহকে খুশি করতে হবে। এই বড় বড় বিল্ডিং, বড় বড় খামার, বড় বড় তৈরী করলে, এসব কিছু না।
ফিরোজ: আচ্ছা, ‘কী ফুল ভেসেছে প্রেমের ঘাটে…’ লালনের এই গানটা আছে, এর মধ্যে এই ফুল কি সেই ফুলই? আপনি যেটা বললেন যে, মা…
টুনটুন: যে ফুলের… যাতে জগতের গঠন সেই ফুলের হয় না যতন। ওই মায়েরই যতন হয় না। মা পয়সা দিতে না পারলে মাকে মেরেই দেয়।
ফিরোজ: লালনের গান কি তাহলে সাধারণ লোকজন সঠিক অর্থেই বুঝতে পারবে?
টুনটুন: না।
ফিরোজ: পারবে না। তাহলে লালনের গান সাধারণ মানুষকে সঠিক অর্থে বুঝাইতে হইলে কী করতে হবে?
টুনটুন: তোমাকে সঠিক ওই, লালন শাহ যে গোত্রে সে গোত্রে তোমাকে আসা যাওয়া করতে হবে। সাধারণ মানুষও বুঝবে। তবে বুঝতে হলে লালনের পথে আসতে হবে। তবে এটা অসাধারণের কাজ। যার জন্য লালন সংগীত, আমি লালন সংগীত করি।
নিজে গান গাইতে গাইতে দেখেছি যে, সাধারণ জ্ঞানের কাজ না এইটা। যাদের পৃথিবীর মধ্যে লোভ রয়ে গেছে, লালসা রয়ে গেছে, পৃথিবীতে আমি কী করব, আমার টাকার দরকার, আমার অমুকের দরকার- এসবগুলা মানুষ না। যারা এটা (লালনের পথ) খুঁজছে তাদের খুব দুর্দিন। তারা অনেক অসহায়। এ ধর্মটা এরকম।
ফিরোজ: তার মানে সাধারণ মানুষের বুঝতে হলে লালনের পথে আসতে হবে, গুরু ধরতে হবে, সাধনা করতে হবে, সাধুসঙ্গ করতে হবে…
টুনটুন: হ্যাঁ। বাহ, বাহ!
ফিরোজ: লালনের গানের আমরা যে অর্থ বুঝি তাহলে সেটা উপরিতলের অর্থ, এক অর্থে সেটা সঠিক অর্থ না, বলা যায় ভুল অর্থই বুঝি?
টুনটুন: হ্যাঁ, তা বলা যায়। এই যে তুমি ধরে আছ হাতটা, তিনটা মোবাইল ধরে আছ, এই হাতটা না থাকলে তুমি কী করতে?
ফিরোজ: না থাকলে তো এইটা করতে পারতাম না।
টুনটুন: তাহলে হাতটা তোমাকে দিয়েছে কেন?
ফিরোজ: এই কাজ করার জন্য।
টুনটুন: তোমার সুবিধার জন্য। তাহলে আদমের সুবিধার জন্য তিনি কী করেননি? কেন করেছেন? তিনি নিজেই আদম হয়ে পৃথিবীতে প্রকাশ হয়েছেন।
ফিরোজ: আদমসুরত যেটা বলে…
টুনটুন: আদমসুরতে তিনি নিজেই প্রকাশ হলেন।
ফিরোজ: মানে তার সুরতের আদলে আদমকে সৃষ্টি করেছেন?
টুনটুন: আদমকে সৃষ্টি করেছেন। এই জন্য তো আদম জানেই না আমি কোথা থেকে এসছি। খালি মনে করে বিয়ে করতে পারলেই হয়, ওহ! ওটাই জীবনের সার হয়, অসার হয়ে যায়।
ফিরোজ: লালনের গানে যেমন নীর, ক্ষীর এইসব শব্দ আছে না…
টুনটুন: নীর। নীর মানে কী?
ফিরোজ: পানি।
টুনটুন: নীর মানে পানি।
ফিরোজ: ক্ষীর মানে তো আমরা জানি যে একটা খাওয়ার বস্তু।
টুনটুন: নীর পানি, ক্ষীরটা খাওয়ার… নীরে ক্ষীরে…
ফিরোজ: নীরে ক্ষীরে…
টুনটুন: নীরে ক্ষীরে আছে জ্যোতি, এ বড় আজব কুদরতি।
ফিরোজ: আঠারো মোকামের মাঝে…
টুনটুন: হ্যাঁ।
এ বড় আজব কুদরতি।
আঠারো মোকামের মাঝে
জ্বলছে একটি রূপের বাতি।।
কিবা কর কুদরতি খেলা
জলের মাঝে অগ্নি-জ্বালা
খবর জানতে হয় নিরালা
নীরে ক্ষীরে আছে জ্যোতি।।
ফণিমনি লাল জহরে
সে বাতি রেখেছে ঘিরে
তিন সময় তিন যোগ সেই ঘরে
যে জানে সে মহারথী।।
থাকতে বাতি উজালাময়
দেখতে যার বাসনা হৃদয়
লালন কয়, কখন কোন সময়
অন্ধকার হবে বসতি।।
নীরে এবং ক্ষীরের মধ্যে তিনি নিহিত আছেন। তোমার কাছে আছে বীজ, সেক্স। তুমি অবৈধভাবে ব্যবহার করলে অবৈধ হবে, বৈধভাবে ব্যবহার করলে বৈধ হবে। যত্ন যে করল সে রত্ন পেল। আর যত্ন যে করল না সে রত্ন পেল না।
ফিরোজ: বাউলদের মধ্যে সাধন-সঙ্গি বেছে নেওয়ার কিছু ব্যাপার আছে, যে, সাধন-সঙ্গি বেছে নিয়ে বাউলরা সিদ্ধি লাভ করে। এই যে সিদ্ধি- এটা কি শুধু পুরুষই লাভ করে, নাকি যে নারী সাধন-সঙ্গি সেও সিদ্ধি লাভ করে?… সাঁইজি? সাঁইজি কি ঘুমাইলেন?
টুনটুন: আমি কী ঘুমাইতে পারি!
ফিরোজ: আপনি কি ঘুমাবেন?
টুনটুন: না, আমি কী ঘুমাইতে পারি! আমি একটা দেশে চলে গিয়েছিলাম…
ফিরোজ: ও আচ্ছা। একটা চিন্তায়, একটা দেশে গেছিলেন? মানে আমি বলতেছিলাম বাউলদের যুগলসাধনার সময় শুধু কি পুরুষই সিদ্ধি লাভ করে, নাকি নারীও করে?
টুনটুন: নারীও করে। উভয়ই করে।
ফিরোজ: যুগলসাধনার যে বিষয়টা…
(চলবে…)
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: তিন>>
………..
আরো পড়ুন:
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: এক
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: দুই
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: তিন
প্রকাশের অপেক্ষায়
যে পেল সেই রূপের সন্ধান: চার
…………
সাক্ষাৎকারটি ফিরোজ এহতেশামের ‘সাধুকথা: ১৩ বাউল-ফকিরের সাথে কথাবার্তা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রিত।
স্থিরচিত্র: সংগৃহিত
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….