১৮৮৫, ২৩শে অক্টোবর
পূর্ণজ্ঞান – দেহ ও আত্মা আলাদা – শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত
সন্ধ্যা হইল। শ্রীরামকৃষ্ণ শয্যায় বসিয়া মার চিন্তা ও নাম করিতেছেন। ভক্তেরা অনেকে তাঁহার কাছে নিঃশব্দে বসিয়া আছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে ডাক্তার সরকার আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘরে লাটু, শশী, শরৎ, ছোট নরেন, পল্টু, ভূপতি, গিরিশ প্রভৃতি অনেক ভক্তেরা আসিয়াছেন। গিরিশের সঙ্গে স্টার থিয়েটারের শ্রীযুক্ত রামতারণ আসিয়াছেন – গান গাইবেন।
ডাক্তার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – কাল রাত তিনটার সময় আমি তোমার জন্য বড় ভেবেছিলাম। বৃষ্টি হল, ভাবলুম দোর-টোর খুলে রেখেছে – না কি করেছে, কে জানে!
শ্রীরামকৃষ্ণ ডাক্তারের স্নেহ দেখিয়া প্রসন্ন হইয়াছেন। আর বলিতেছেন, বল কিগো!
“যতক্ষণ দেহটা আছে ততক্ষণ যত্ন করতে হয়।
“কিন্তু দেখছি যে এটা আলাদা। কামিনী-কাঞ্চনের উপর ভালবাসা যদি একেবারে চলে যায়, তাহলে ঠিক বুঝতে পারা যায় যে দেহ আলাদা আর আত্মা আলাদা। নারকেলের জল সব শুকিয়ে গেলে মালা আলাদা, আঁস আলাদা হয়ে যায়। তখন নারকেল টের পাওয়া যায় – ঢপর ঢপর করছে। যেমন খাপ আর তরবার – খাপ আলাদা, তরবার আলাদা।
“তাই দেহের অসুখের জন্য তাঁকে বেশি বলতে পারি না।”
গিরিশ – পণ্ডিত শশধর বলেছিলেন, ‘আপনি সমাধি অবস্থায় দেহের উপর মনটা আনবেন, – তাহলে অসুখ সেরে যাবে। ইনি ভাবে ভাবে দেখলেন যে শরীরটা যেন ধ্যাড় ধ্যাড় করছে।
[পূর্বকথা – মিয়জিয়াম দর্শন ও পীড়ার সময় প্রার্থনা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ – অনেকদিন হল, – আমার তখন খুব ব্যামো। কালীঘরে বসে আছি, – মার কাছে প্রার্থনা করতে ইচ্ছা হল! কিন্তু ঠিক আপনি বলতে পাল্লাম না। বললুম, – মা হৃদে বলে তোমার কাছে ব্যামোর কথা বলতে। আর বেশি বলতে পাল্লাম না – বলতে বলতে অমনি দপ্ করে মনে এলো সুসাইট্ (Asiatic Society’s Museum) সেখানকার তারে বাঁধা মানুষের হাড়ের দেহ (Skeleton) অমনি বললুম, মা, তোমার নামগুণ করে বেড়াব – দেহটা একটু তার দিয়ে এঁটে দাও, সেখানকার মতো! সিদ্ধাই চাইবার জো নাই!
“প্রথম প্রথম হৃদে বলেছিল, – হৃদের অণ্ডার (under) ছিলাম কি না – ‘মার কাছে একটু ক্ষমতা চেও।’ কালীঘরে ক্ষমতা চাইতে গিয়ে দেখলাম – ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের রাঁড় – কাপড় তুলে ভড়ভড় করে হাগছে। তখন হৃদের উপর রাগ হল – কেন সে সিদ্ধাই চাইতে শিখিয়ে দিলে।”
[শ্রীযুক্ত রামতারণের গান – ঠাকুরের ভাবাবস্থা ]
গান:
আমার এই সাধের বীণে, যত্নে গাঁথা তারের হার ৷
যে যত্ন জানে, বাজায় বীণে, উঠে সুধা অনিবার ৷৷
তানে মানে বাঁধলে ডুরী, শত ধারে বয় মাধুরী ৷
বাজে না আলগা তারে, টানে ছিঁড়ে কোমল তার ৷৷
ডাক্তার (গিরিশের প্রতি) – গান এ-সব কি অরিজিন্যাল (নূতন)?
গিরিশ – না, Edwin Arnold-এর thought (আর্নল্ড সাহেবের ভাব লয়ে গান)।
রামতারণ প্রথমে বুদ্ধরচিত হইতে গান গাহিতেছেন:
জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই ৷৷
কর হে চেতন, কে আছে চেতন,
কত দিনে আর ভাঙিবে স্বপন?
কে আছে চেতন, ঘুমায়ো না আর,
দারুণ এ-ঘোর নিবিড় আঁধার,
কর তম নাশ, হও হে প্রকাশ,
তোমা বিনা আর নাহিক উপায়,
তব পদে তাই শরণ চাই ৷৷
এই গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন।
গান – কোঁ কোঁ কোঁ বহরে ঝড়।
[সূর্যের অন্তর্যামী দেবতাদর্শন ]
এই গানটি সমাপ্ত হইলে ঠাকুর বলিতেছেন, “এ কি করলে! পায়েসের পর নিম ঝোল! –
“যাই গাইলে – ‘কর তম নাশ’, অমনি দেখলাম সূর্য – উদয় হবা মাত্র চারদিকের অন্ধকার ঘুচে গেল! আর সেই সূর্যের পায়ে সব শরণাগত হয়ে পড়ছে!”
রামতারণ আবার গাইতেছেন:
(১) দীনতারিণী দূরিতবারিণী, সত্ত্বরজঃতমঃ ত্রিগুণধারিণী,
সৃজন পালন নিধনকারিণী, সগুণা নির্গুণা সর্বস্বরূপিণী।
(২) ধরম করম সকলি গেল, শ্যামাপূজা বুঝি হল না!
মন নিবারিত নারি কোন মতে, ছি, ছি, কি জ্বালা বল না ৷৷
এই গান শুনিয়া ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইলেন।
রাঙা জবা কে দিলে তোর পায়ে মুঠো মুঠো।