ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ৩০শে অক্টোবর

অবতীর্ণ শক্তি বা সদানন্দ
বেলা ৫টা। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই দোতলার ঘরে বসিয়া আছেন। চতুর্দিকে ভক্তেরা চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। তন্মধ্যে অনেকগুলি বাহিরের লোক তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছেন। কোন কথা নাই।

মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। তাঁহার সঙ্গে নিভৃতে এক-একটি কথা হইতেছে। ঠাকুর জামা পরিবেন – মাস্টার জামা পরাইয়া দিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – দেখো, এখন আর বড় ধ্যান-ট্যান করতে হয় না। অখণ্ড একবারে বোধ হয়ে যায়। এখন কেবল দর্শন।

মাস্টার চুপ করিয়া আছেন। ঘরও নিস্তব্ধ।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর তাহাকে আবার একটি কথা বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা, এরা যে সব একাসনে চুপ করে বসে আছে, আর আমায় দেখে – কথা নাই, গান নাই; এতে কি দেখে?

ঠাকুর কি ইঙ্গিত বরিতেছেন যে, সাক্ষাৎ ঈশ্বরের শক্তি অবতীর্ণ – তাই এত লোকের আকর্ষণ, তাই ভক্তেরা অবাক্‌ হইয়া তাঁহার দিকে তাকাইয়া থাকে!

মাস্টার উত্তর করিলেন – আজ্ঞে, এরা সব আপনার কথা অনেক আগে শুনেছে, আর দেখে – যা কখনও ওরা দেখতে পায় না – সদানন্দ বালকস্বভাব, নিরহংকার, ঈশ্বরের পেমে মাতোয়ারা! সেদিন ঈশান মুখুজ্জের বাড়ি আপনি গিছিলেন; সেই বাহিরের ঘরে পায়চারি কচ্ছিলেন; আমরাও ছিলাম, একজন আপনাকে এসে বললে, এমন ‘সদানন্দ পুরুষ’ কোথাও দেখি নাই।

মাস্টার আবার চুপ করিয়া রহিলেন। ঘর আবার নিস্তব্ধ! কিয়ৎকাল পরে ঠাকুর আবার মৃদুস্বরে মাস্টারকে কি বলিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা, ডাক্তারের কিরকম হচ্ছে? এখানকার কথা সব কি বেশ নিচ্ছে?

মাস্টার – এ অমোঘ বীজ কোথায় যাবে, একবার না একবার একদিক দিয়ে বেরোবে। সেদিনকার একটা কথায় হাসি পাচ্ছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি কথা?

মাস্টার – সেদিন বলেছিলেন, যদু মল্লিকের খাবার সময় কোন্‌ ব্যঞ্জনে নুন হয়েছে, কোন্‌ ব্যঞ্জনে হয়নি এ বুঝতে পারে না; এত অন্যমনস্ক! কেউ যদি বলে দেয় এ ব্যঞ্জনে নুন হয় নাই, তখন এ্যাঁ এ্যাঁ করে বলে, ‘নুন হয় নাই?’ ডাক্তারকে এই কথাটি শোনাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন কিনা যে, আমি এত অন্যমনস্ক, হয়ে যাই। আপনি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন যে, সে বিষয়চিন্তা করে অন্যমনস্ক ঈশ্বরচিন্তা করে নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ওগুলো কি ভাববে না?

মাস্টার – ভাববেন বইকি। তবে নানা কাজ, অনেককথা ভুলে যায়। আজকেও বেশ বললেন, তিনি যখন বললেন, ‘ও তান্ত্রিকের উপাসনা। – জননী রমণী।’

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি কি বললুম?

মাস্টার – আপনি বললেন, হেলে গরুওয়ালা ভাগবত পণ্ডিতের কথা। (শ্রীরামকৃষ্ণের হাস্য) আর বললেন, সেই রাজার কথা যে বলেছিল, ‘তুমি আগে বোঝ!’ (শ্রীরামকৃষ্ণের হাস্য)

“আর বললেন, গীতার কথা। গীতার সার কথা কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ, – কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি ত্যাগ। ডাক্তারকে আপনি বললেন যে সংসারী হয় (ত্যাগী না হয়ে) ও আবার কি শিক্ষা দেবে? তাতে তিনি বুঝতে বোধ হয় পারেন নাই। শেষে ‘ধারা’ ‘ধারা’ বলে চাপা দিয়ে গেলেন।”

ঠাকুর ভক্তের জন্য চিন্তা করিতেছেন; – পূর্ণ বালক ভক্ত, তাঁহার জন্য। মণীন্দ্রও বালক ভক্ত; ঠাকুর তাঁহাকে পূর্ণের সঙ্গে আলাপ করিতে পাঠাইলেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!