ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ৩১শে অক্টোবর

শ্যামপুকুর বাটীতে হরিবল্লভ নরেন্দ্র, মিশ্র প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
শ্রীযুক্ত বলরামের জন্য চিন্তা – শ্রীযুক্ত হরিবল্লভ বসু
শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরের বাটীতে ভক্তসঙ্গে চিকিৎসার্থ বাস করিতেছেন। আজ শনিবার। আশ্বিন, কৃষ্ণা অষ্টমী তিথি, ১৬ই কার্তিক। ৩১শে অক্টোবর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। বেলা নয়টা।

এখানে ভক্তেরা দিবারাত্রি থাকেন – ঠাকুরের সেবার্থ! এখনও কেহ সংসার ত্যাগ করেন নাই।

বলরাম সপরিবারে ঠাকুরের সেবক। তিনি যে বংশে জন্মিয়াছেন, সে অতি ভক্তবংশ। পিতা বৃদ্ধ হইয়াছেন, বৃন্দাবনে একাকী বাস করেন – তাঁহাদের প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীশ্যামসুন্দরের কুঞ্জে। তাঁহার পিতৃব্যপুত্র শ্রীযুক্ত হরিবল্লভ বসু ও বাটীর অন্যান্য সকলেই বৈষ্ণব।

হরিবল্লভ কটকের প্রধান উকিল। পরমহংসদেবের কাছে বলরাম যাতায়াত করেন – বিশেষতঃ মেয়েদের লইয়া যান – শুনিয়া বিরক্ত হইয়াছেন। দেখা হইলে, বলরাম বলিয়াছিলেন, তুমি তাঁহাকে একবার দর্শন কর – তারপর যা হয় বলো!

আজ হরিবল্লভ আসিয়াছেন, তিনি ঠাকুরকে দর্শন করিয়া অতি ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি করে ভাল হবে! – আপনি কি দেখছো, শক্ত ব্যামো?

হরিবল্লভ – আজ্ঞা, ডাক্তারেরস বলতে পারেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – মেয়েরা পায়ের ধুলা লয়। তা ভাবি একরূপে তিনিই (ঈশ্বর) ভিতরে আছেন – হিসাব আনি।

হরিবল্লভ – আপনি সাধু! আপনাকে সকলে প্রণাম করবে, তাতে দোষ কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ – সে ধ্রুব, প্রহ্লাদ, নারদ, কপিল, এরা কেউ হলে হত। আমি কি! আপনি আবার আসবেন।

হরি – আজ্ঞা, আমাদের টানেই আসব – আপনি বলছেন কেন।

হরিবল্লভ বিদায় লইবেন – প্রণাম করিতেছেন। পায়ের ধুলা লইতে যাইতেছেন – ঠাকুর পা সরাইয়া লইতেছেন। কিন্তু হরিবল্লভ ছাড়িলেন না – জোর করিয়া পায়ের ধুলা লইলেন।

হরিবল্লভ গাত্রোত্থান করিলেন। ঠাকুর যেন তাঁহাকে খাতির করিবার জন্য দাঁড়াইলেন। বলিতেছেন, “বলরাম অনেক দুঃখ করে। আমি মনে কল্লাম, একদিন যাই – গিয়ে তোমাদের সঙ্গে দেখা করি। তা আবার ভয় হয়! পাছে তোমরা বল, একে কে আনলে!”

হরি – ও-সব কথা কে বলেছে। আপনি কিছু ভাববেন না।

হরিবল্লভ চলিয়া গেলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – ভক্তি আছে – তা না হলে জোর করে পায়ের ধুলা নিলে কেন?

“সেই যে তোমায় বলেছিলাম, ভাবে দেখলাম ডাক্তার ও আর-একজনকে, – এই সেই আর-একজন। তাই দেখ, এসেছে।”

মাস্টার – আজ্ঞে, ভক্তিরই ঘর।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি সরল!

ডাক্তার সরকারের কাছে ঠাকুরের অসুখের সংবাদ দিবার জন্য মাস্টার শাঁখারিটোলায় আসিয়াছেন। ডাক্তার আজ আবার ঠাকুরকে দেখিতে যাইবেন।

ডাক্তার ঠাকুরের ও মহিমাচরণ প্রভৃতি ভক্তদের কথা বলিতেছেন।

ডাক্তার – কই, তিনি (মহিমাচরণ) সে বইতো আনেন নাই – যে বই আমাকে দেখাবেন বলেছিলেন! বললে, ভুল হয়েছে। তা হতে পারে – আমারও হয়।

মাস্টার – তাঁর বেশ পড়াশুনা আছে।

ডাক্তার – তাহলে এই দশা!

ঠাকুরের সম্বন্ধে ডাক্তার বলিতেছেন, “শুধু ভক্তি নিয়ে কি হবে – জ্ঞান যদি না থাকে।”

মাস্টার – কেন, ঠাকুর তো বলেন – জ্ঞানের পর ভক্তি। তবে তাঁর ‘জ্ঞান, ভক্তি’ আর আপনাদের ‘জ্ঞান, ভক্তি’র মানে অনেক তফাত।

“তিনি যখন বলেন – ‘জ্ঞানের পর ভক্তি’ তার মানে – তত্ত্বজ্ঞানের পর ভক্তি, ব্রহ্মজ্ঞানের পর ভক্তি – ভগবানকে জানার পর ভক্তি। আপনাদের জ্ঞান মানে সেন্স্‌ নলেজ্‌ (ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে পাওয়া জ্ঞান।) প্রথমটি not verifiable by our standard; তত্ত্বজ্ঞান ইন্দ্রিয়লভ্য জ্ঞানের দ্বারা ঠিক করা যায় না। দ্বিতিয়টি – verifiable (জড়জ্ঞান)।”

ডাক্তার চুপ করিয়া, আবার অবতার সম্বন্ধে কথা কহিতেছেন।

ডাক্তার – অবতার আবার কি? আর পায়ের ধুলো লওয়া কি!

মাস্টার – কেন, আপনি তো বলেন একস্‌পেরিমেন্ট্‌ সময় তাঁর সৃষ্টি দেখে ভাব হয়, মানুষ দেখলে ভাব হয়। তা যদি হয়, ঈশ্বরকে কেন না মাথা নোয়াব? মানুষের হৃদয় মধ্যে ঈশ্বর আছেন।

“হিন্দুধর্মে দেখে সর্বভূতে নারায়ণ! এটা তত আপনার জানা নাই। সর্বভূতে যদি থাকেন তাঁকে প্রণাম করতে কি?

“পরমহংসদেব বলেন, কোনও কোনও জিনিসে তিনি বেশি প্রকাশ। সূর্যের প্রকাশ জলে, আরশিতে। জল সব জায়গায় আছে – কিন্তু নদীতে, পুষ্করিণীতে, বেশি প্রকাশ। ঈশ্বরকেই নমস্কার করা হয় – মানুষকে নয়। God is God – not, man is God.

“তাঁকে তো রীজ্‌নিং (সামান্য বিচার) করে জানা যায় না – সমস্ত বিশ্বাসের উপর নির্ভর। এই সব কথা ঠাকুর বলেন।”

আজ মাস্টারকে ডাক্তার তাঁহার রচিত একখানি বই উপহার দিলেন –

Physiological Basis of Psychology – ‘as a token of brotherly regards’.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!