ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৪, ৯ই মার্চ
দক্ষিণেশ্বরে মণিলাল প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে

আজ রবিবার, ৯ই মার্চ, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ (২৭শে ফাল্গুন, শুক্লা ত্রয়োদশী)। শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে অনেকগুলি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন; মণিলাল মল্লিক, সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজ, বলরাম, মাস্টার, ভবনাথ, রাখাল, লাটু, হরিশ, কিশোরী (গুপ্ত), শিবচন্দ্র প্রভৃতি। এখনও গিরিশ, কালী, সুবোধ প্রভৃতি আসিয়া জুটেন নাই। শরৎ, শশী ইঁহারা সবে দু-একবার দেখিয়াছেন। পূর্ণ, ছোট নরেন প্রভৃতিও তাঁহাকে এখনও দেখেন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণের হাতে বাড় বাঁধা। রেলের ধারে পড়িয়া গিয়া হাত ভাঙিয়াছে – তখন ভাবে বিভোর হইয়াছিলেন। সবে হাত ভাঙিয়া গিয়াছে, সর্বদাই হাতে যন্ত্রণা।

কিন্তু এই অবস্থাতেই প্রায় সমাধিস্থ থাকেন ও ভক্তদের গভীর তত্ত্বকথা বলেন।

একদিন যন্ত্রণায় কাঁদিতেছেন, এমন সময় সমাধিস্থ হইলেন। সমাধির পর প্রকৃতিস্থ হইয়া মহিমাচরণ প্রভৃতি ভক্তগণকে বলিতেছেন, বাবু, সচ্চিদানন্দ লাভ না হলে কিছুই হল না। ব্যাকুলতা না হলে হবে না। আমি কেঁদে কেঁদে ডাকতাম আর বলতাম, ওহে দীননাথ, আমি ভজন-সাধনহীন, আমায় দেখা দিতে হবে।

সেই দিন রাত্রে আবার মহিমাচরণ, অধর, মাস্টার প্রভৃতি বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণের প্রতি) – একরকম আছে অহেতুকী ভক্তি, এইটি যদি সাধতে পার।

আবার অধরকে বলিতেছেন – এই হাতটাতে একটু হাত বুলিয়ে দিতে পার?

আজ ৯ই মার্চ, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। মণিলাল মল্লিক ও ভবনাথ এগ্‌জিবিশনের কথা বলিতেছেন – ১৮৮৩-৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, এশিয়াটিক মিউজিয়াম্‌-এর কাছে হইয়াছিল। তাঁহারা বলিতেছেন – কত রাজারা বহুমূল্য জিনিস সব পাঠাইয়াছেন! সোনার খাট ইত্যাদি – একটা দেখবার জিনিস।

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ধন, ঐশ্বর্য ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি সহাস্যে) – হ্যাঁ, গেলে একটা বেশ লাভ হয়। ওইসব সোনার জিনিস, রাজরাজড়ার জিনিস দেখে সব ছ্যা হয়ে যায়। সেটাও অনেক লাভ। হৃদে, কলকাতায় যখন আমি আসতাম, লাট সাহেবের বাড়ি আমাকে দেখাত – মামা, ওই দেখ, লাট সাহেবের বাড়ি, বড় বড় থাম। মা দেখিয়ে দিলেন, কতকগুলি মাটির ইট উঁচু করে সাজান।

“ভগবান ও তাঁর ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্য দুদিনের জন্য, ভগবানই সত্য; বাজিকর আর তার বাজি! বাজি দেখে সব অবাক্‌, কিন্তু সব মিথ্যা; বাজিকরই সত্য। বাবু আর তাঁর বাগান। বাগান দেখে বাগানের মালিক বাবুকে সন্ধান করতে হয়।”

মণি মল্লিক (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – আবার কত বড় ইলেক্‌ট্রিক লাইট দিয়েছে। তখন আমাদের মনে হয় তিনি কত বড় যিনি ইলেকট্রিক লাইট করেছেন!

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণিলালের প্রতি) – আবার একমতে আছে, তিনি এইসব হয়ে রয়েছেন; আবার যে বলছে সেও তিনি। ঈশ্বর মায়া, জীব, জগৎ।

মিউজিয়ামের কথা পড়িল।

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও সাধুসঙ্গ – যোগীর ছবি ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – আমি একবার মিয়জিয়ামে গিছলুম; তা দেখালে ইট, পাথর হয়ে গেছে, জানোয়ার পাথর হয়ে গিয়েছে। দেখলে, সঙ্গের গুণ কি! তেমনি সর্বদা সাধুসঙ্গ করলে তাই হয়ে যায়।

মণি মল্লিক (সহাস্যে) – আপনি ওখানে একবার গেলে আমাদের ১০/১৫ বৎসর উপদেশ চলত।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – কি, উপমার জন্য?

বলরাম – না; এখানে ওখানে গেলে হাত সারবে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমার ইচ্ছা যে দুখানি ছবি যদি পাই। একটি ছবি; যোগী ধুনি জ্বেলে বসে আছে; আর-একটি ছবি, যোগী গাঁজার কলকে মুখ দিয়ে টানছে আর সেটা দপ্‌ করে জ্বলে উঠছে।

“এ-সব ছবিতে বেশ উদ্দীপন হয়। যেমন সোলার আতা দেখলে সত্যকার আতার উদ্দীপন হয়।

“তবে যোগের বিঘ্ন – কামিনী-কাঞ্চন। এই মন শুদ্ধ হলে যোগ হয়। মনের বাস কপালে (আজ্ঞা চক্রে) কিন্তু দৃষ্টি লিঙ্গ, গুহ্য, নাভিতে – অর্থাৎ কামিনী-কাঞ্চনে! সাধন করলে ওই মনের ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়।

“কি সাধন করলে মনের ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়? সর্বদা সাধুসঙ্গ করলে সব জানতে পারা যায়।

“ঋষিরা সর্বদা হয় নির্জনে, নয় সাধুসঙ্গে থাকতেন – তাই তাঁরা অনায়াসে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করে ঈশ্বরেতে মন যোগ করেছিলেন – নিন্দা, ভয় কিছু নাই।

“ত্যাগ করতে হলে ঈশ্বরের কাছে পুরুষকারের জন্য প্রার্থনা করতে হয়। যা মিথ্যা বলে বোধ হবে তা তৎক্ষণাৎ ত্যাগ।

“ঋষিদের এই পুরুষকার ছিল। এই পুরুষকারের দ্বারা ঋষিরা ইন্দ্রিয় জয় করেছিলেন।

“কচ্ছপ যদি হাত-পা ভিতরে সাঁধ করে দেয়, চারখানা করে কাটলেও হাত-পা বার করবে না!

“সংসারী লোক কপট হয় – সরল হয় না। মুখে বলে ঈশ্বরকে ভালবাসি, কিন্তু বিষয়ে যত টান, কামিনী-কাঞ্চনে যত ভালবাসা, তার অতি অল্প অংশও ঈশ্বরের দিকে দেয় না। অথচ মুখে বলে ঈশ্বরকে ভালবাসি।

(মণি মল্লিকের প্রতি) – “কপটতা ছাড়ো।”

মণিলাল – মানুষ সম্বন্ধে না ঈশ্বর সম্বন্ধে?

শ্রীরামকৃষ্ণ – সবরকম। মানুষ সম্বন্ধেও বটে, আর ঈশ্বর সম্বন্দেও বটে; কপটতা করতে নাই।

“ভবনাথ কেমন সরল! বিবাহ করে এসে আমায় বলছে, স্ত্রীর উপর আমার এত স্নেহ হচ্ছে কেন? আহা! সে ভারী সরল!

“তা স্ত্রীর উপর ভালবাসা হবে না? এটি জগন্মাতার ভুবনমোহিনী মায়া। স্ত্রীকে বোধ হয় যে পৃথিবীতে অমন আপনার লোক আর হবে না – আপনার লোক, জীবনে মরণে, ইহকালে পরকালে।

“এই স্ত্রী নিয়ে মানুষ কি না দুঃখ ভোগ করছে, তবু মনে করে যে এমন আত্মীয় আর কেউ নাই। কি দুরবস্থা! কুড়ি টাকা মাইনে – তিনটে ছেলে হয়েছে – তাদের ভাল করে খাওয়াবার শক্তি নেই, বাড়ির ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, মেরামত করবার পয়সা নাই – ছেলের নতুন বই কিনে দিতে পারে না। – ছেলের পৈতে দিতে পারে না – এর কাছে আট আনা, ওর কাছে চার আনা ভিক্ষে করে।

“বিদ্যারূপিণী স্ত্রী যথার্থ সহধর্মিণী। স্বামীকে ঈশ্বরের পথে যেতে বিশেষ সহায়তা করে। দু-একটি ছেলের পর দুজনে ভাই-ভগিনীর মতো থাকে। দুজনেই ঈশ্বরের ভক্ত – দাস-দাসী। তাদের সংসার, বিদ্যার সংসার। ঈশ্বরকে ও ভক্তদের লয়ে সর্বদা আনন্দ। তারা জানে ঈশ্বরই একমাত্র আপনার লোক – অনন্তকালের আপনার। সুখে-দুঃখে তাঁকে ভুলে না – যেমন পাণ্ডবেরা।”

[সংসারীভক্ত ও ত্যাগীভক্ত ]

“সংসারীদের ঈশ্বরানুরাগ ক্ষণিক – যেমন তপ্ত খোলায় জল পড়েছে, ছ্যাঁক করে উঠল – তারপরই শুকিয়ে গেল।

“সংসারী লোকদের ভোগের দিকে মন রয়েছে – তাই জন্য সে অনুরাগ, সে ব্যাকুলতা হয় না।

“একাদশী তিনপ্রকার। প্রথম – নির্জলা একাদশী, জল পর্যন্ত খাবে না। তেমনি ফকির পূর্ণত্যাগী, একেবারে সব ভোগ ত্যাগ। দ্বিতীয় – দুধ সন্দেশ খায় – ভক্ত যেমন গৃহে সামান্য ভোগ রেখে দিয়ে দিয়েছে। তৃতীয় – লুচি ছক্কা খেয়ে একাদশী – পেট ভরে খাচ্ছে; হল দুখানা রুটি দুধে ভিজছে, পরে খাবে।

“লোকে সাধন-ভজন করে, কিন্তু মন কামিনী-কাঞ্চনে, মন ভোগের দিকে থাকে তাই সাধন-ভজন ঠিক হয় না।

“হাজরা এখানে অনেক জপতপ করত, কিন্তু বাড়িতে স্ত্রী ছেলেপুলে জমি – এ-সব ছিল, কাজে কাজেই জপতপও করে; ভিতরে ভিতরে দালালিও করে। এ-সব লোকের কথার ঠিক থাকে না। এই বলে মাছ খাব না। আবার খায়।

“টাকার জন্য লোকে কি না করতে পারে! ব্রাহ্মণকে, সাধুকে মোট বহাতে পারে।

“সন্দেশ পচে যেত, তবু এ-সব লোককে দিতে পারতুম না। অন্য লোকের হেগো ঘটির জল নিতে পারতুম, এ-সব লোকের ঘটি ছুঁতুম না।

“হাজরা টাকাওয়ালা লোক দেখলে কাছে ডাকত – ডেকে লম্বা লম্বা কথা শোনাত; আবার তাদের বলত রাখাল-টাখাল যা সব দেখছ – ওরা জপতপ করতে পারে না – হো-হো করে বেড়ায়।

“আমি জানি যে যদি কেউ পর্বতের গুহায় বাস করে, গায়ে ছাই মাখে, উপবাস করে, নানা কঠোর করে কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিষয়ী মন – কামিনী-কাঞ্চনে মন – সে লোককে আমি বলি ধিক্‌ আর যার কামিনী-কাঞ্চনে মন নাই – খায় দায় বেড়ায় তাকে বলি ধন্য।

(মণি মল্লিককে দেখাইয়া) – “এঁর বাড়িতে সাধুর ছবি নাই। সাধুদের ছবি রাখলে ঈশ্বরের উদ্দীপন হয়।”

মণিলাল – আছে, নন্দিনীর১ ঘরে ভক্ত মেমের ছবি আছে। মেম ভজনা (Prayer) করছে। আর-একখানা ছবি আছে – বিশ্বাস পাহাড় ধরে একজন আছে – নিচে অতলস্পর্শ সমুদ্র, বিশ্বাস ছেড়ে দিলে একেবারে অতল জলে পড়ে যাবে।

“আর-একটি ছবি আছে – কয়টি বালিকা বর আসবে বলে প্রদীপে তেল ভরে জেগে বসে আছে। যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সে দেখতে পাবে না। ঈশ্বরকে বর বলে বর্ণনা করেছে।”২

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) – এটি বেশ।

মণিলাল – আরও ছবি আছে – বিশ্বাসের বৃক্ষ! আর পাপ-পুণ্যের ছবি।৩

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভবনাথের প্রতি) – বেশ সব ছবি; তুই দেখতে যাস।

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর বলিতেছেন, “এক-একবার ভাবি – তখন ও-সব ভাল লাগে না। প্রথমে একবার পাপ পাপ করতে হয়, কিসে পাপ থেকে মুক্তি হয়, কিন্তু তাঁর কৃপায় একবার ভালবাসা যদি আসে, একবার রাগভক্তি যদি আসে, তাহলে পাপ-পুণ্য সব ভুলে যায়। তখন আইনের সঙ্গে, শাস্ত্রের সঙ্গে তফাত হয়ে যায়। অনুতাপ করতে হবে, প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, এ-সব ভাবনা আর থাকে না।

“যেমন বাঁকা নদী দিয়ে অনেক কষ্টে এবং অনেকক্ষণ পরে গন্তব্য স্থানে যাচ্ছ। কিন্তু যদি বন্যে হয় তাহলে সোজা পথ দিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে গন্তব্যস্থানে পোঁছানো যায়। তখন ড্যাঙাতেই একবাঁশ জল।

“প্রথম অবস্থায় অনেক ঘুরতে হয়, অনেক কষ্ট করতে হয়।

“রাগভক্তি এলে খুব সোজা। যেমন মাঠের উপর ধান কাটার পর যেদিক দিয়ে যাও। আগে আলের উপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হত এখন যেদিক দিয়ে যাও। যদি কিছু কিছু খড় থাকে – জুতা পায়ে দিয়ে চলে গেলে আর কোন কষ্ট নাই। বিবেক, বৈরাগ্য, গুরুবাক্যে বিশ্বাস – এ-সব থাকলে আর কোন কষ্ট নাই।”

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও ধ্যানযোগ, শিবযোগ, বিষ্ণুযোগ – নিরাকার ধ্যান ও সাকার ধ্যান ]

মণিলাল (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – আচ্ছা, ধ্যানের কি নিয়ম? কোথায় ধ্যান করতে হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হৃদয় ডঙ্কাপেটা জায়গা। হৃদয়ে ধ্যান হতে পারে, অথবা সহস্রধারে, এগুলি আইনের ধ্যান – শাস্ত্রে আছে। তবে তোমার যেখানে অভিরুচি ধ্যান করতে পার। সব স্থানই তো ব্রহ্মময়; কোথায় তিনি নাই?

“যখন বলির কাছে তিন পায়ে নারায়ণ স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ঢেকে ফেললেন, তখন কি কোন স্থান বাকী ছিল? গঙ্গাতীরও যেমন পবিত্র আবার যেখানে খারাপ মাটি আছে সে-ও তেমনি পবিত্র। আবার আছে এ-এমস্ত তাঁরই বিরাটমূর্তি।

“নিরাকার ধ্যান ও সাকার ধ্যান। নিরাকার ধ্যান বড় কঠিন। সে ধ্যানে যা কিছু দেখছ শুনছ – লীন হয়ে যাবে; কেবল স্ব-স্বরূপ চিন্তা। সেই স্বরূপ চিন্তা করে শিব নাচেন। ‘আমি কি’, ‘আমি কি’ এই বলে নাচেন।

“একে বলে শিবযোগ। ধ্যানের সময় কপালে দৃষ্টি রাখতে হয়। ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে জগৎ ছেড়ে স্ব-স্বরূপ চিন্তা।

“আর এক আছে বিষ্ণুযোগ। নাসাগ্রে দৃষ্টি; অর্ধেক জগতে, অর্ধেক অন্তরে। সাকার ধ্যানে এইরূপ হয়।

“শিব কখন কখন সাকার চিন্তা করে নাচেন। ‘রাম’, ‘রাম’ বলে নাচেন।”

………………………………………
১ নন্দিনী – মণি মল্লিকের বিধবা কন্যা, ঠাকুরের ভক্ত।
২ Parable of the Ten Virgins
৩ Sin and Virtue


Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!