ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ১লা মার্চ

শ্রীশ্রীদোলযাত্রা ও শ্রীরামকৃষ্ণের ৺রাধাকান্ত ও মা-কালীকে ও ভক্তদিগের গায়ে আবির প্রদান
নবাই চৈতন্য গান গাহিতেছেন। ভক্তেরা সকলেই বসিয়া আছেন। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়াছিলেন, হঠাৎ উঠিলেন। ঘরের বাহিরে গেলেন। ভক্তেরা সকলে বসিয়া রহিলেন, গান চলিতে লাগিল।

মাস্টার ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। ঠাকুর পাকা উঠান দিয়া কালীঘরের দিকে যাইতেছেন। ৺রাধাকান্তের মন্দিরে আগে প্রবেশ করিলেন। ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। তাঁহার প্রণাম দেখিয়া মাস্টারও প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের সম্মুখের থালায় আবির ছিল। আজ শ্রীশ্রীদোলযাত্রা – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাহা ভুলেন নাই। থালার ফাগ লইয়া শ্রীশ্রীরাধাশ্যামকে দিলেন। আবার প্রণাম করিলেন।

এইবার কালীঘরে যাইতেছেন। প্রথম সাতটি ধাপ ছাড়াইয়া চাতালে দাঁড়াইলেন মাকে দর্শন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। মাকে আবির দিলেন। প্রণাম করিয়া কালীঘর হইতে চলিয়া আসিতেছেন। কালীঘরের সম্মুখের চাতালে দাঁড়াইয়া মাস্টারকে বলিতেছেন, – বাবুরামকে আনলে না কেন?

ঠাকুর আবার পাকা উঠান দিয়া যাইতেছেন। সঙ্গে মাস্টার ও আর-একজন আবিরের থালা হাতে করিয়া আসিতেছেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া সব পটকে ফাগ দিলেন – দু-একটি পট ছাড়া – নিজের ফটোগ্রাফ ও যীশুখ্রীষ্টের ছবি। এইবার বারান্দায় আসিলেন নরেন্দ্র ঘরে ঢুকিতে বারান্দায় বসিয়া আছেন। কোন কোন ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন। ঠাকুর নরেন্দ্রের গায়ে ফাগ দিলেন। ঘরে ঢুকিতেছেন, মাস্টার সঙ্গে আসিতেছেন, তিনিও আবির প্রসাদ পাইলেন।

ঘরে প্রবেশ করিলেন। যত ভক্তদের গায়ে আবির দিলেন। সকলেই প্রণাম করিতে লাগিলেন।

অপরাহ্ন হইল। ভক্তেরা এদিক-ওদিক বেড়াইতে লাগিলেন। ঠাকুর মাস্টারের সঙ্গে চুপিচুপি কথা কহিতেছেন। কাছে কেহ নাই। ছোকরা ভক্তদের কথা কহিতেছেন। বলছেন, “আচ্ছা, সব্বাই বলে, বেশ ধ্যান হয়, পল্টুর ধ্যান হয় না কেন?”

“নরেন্দ্রকে তোমার কিরকম মনে হয়? বেশ সরল; তবে সংসারের অনেক তাল পড়েছে, তাই একটু চাপা; ও থাকবে না।”

ঠাকুর মাঝে মাঝে বারান্দায় উঠিয়া যাইতেছেন। নরেন্দ্র একজন বেদান্তবাদীর সঙ্গে বিচার করছেন।

ক্রমে ভক্তেরা আবার ঘরে আসিয়া জুটিতেছেন। মহিমাচরণকে স্তব পাঠ করিতে বলিলেন। তিনি মহানির্বাণ তন্ত্র, তৃতীয় উল্লাস হইতে স্তব বলিতেছেন –

হৃদয়কমল মধ্যে নির্বিশেষং নিরীহং,
হরিহর বিধিবেদ্যং যোগিভির্ধ্যানগম্যম্‌।
জননমরণভীতিভ্রংশি সচ্চিৎস্বরূপম্‌,
সকলভুবনবীজং ব্রহ্মচৈতন্যমীড়ে।

[গৃহস্থের প্রতি অভয় ]

আরও দু-একটি স্তবের পর মহিমাচরণ শঙ্করাচার্যের স্তব বলিতেছেন, তাহাতে সংসারকূপের, সংসারগহনের কথা আছে। মহিমাচরণ সংসারী ভক্ত।

হে চনদ্রচূড় মদনান্তক শূলপাণে, স্থাণো গিরিশ গিরিজেশ মহেশ শম্ভো।
ভূতেশ ভীতভয়সূদনং মামনাথং, সংসারদুঃখগহনাজ্জগদীশ রক্ষ ৷৷
হে পার্বতী-হৃদয়বল্লভ চন্দ্রমৌলে, ভূতাধিপ প্রমথনাথ গিরিশজাপ।
হে বামদেব ভব রুদ্র পিনাকপাণে, সংসারদুঃখগহনাজ্জগদীশ রক্ষ ৷৷ . . . . ইত্যাদি

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) – সংসারকূপ, সংসারগহন, কেন বল? ও প্রথম প্রথম বলতে হয়। তাঁকে ধরলে আর ভয় কি? তখন –

এই সংসার মজার কুটি।
আমি খাই দাই আর মজা লুটি।
জনক রাজা মহাতেজা তার কিসে ছিল ত্রুটি!
সে যে এদিক-ওদিক দুদিক রেখে ফেয়েছিল দুধের বাটি!

“কি ভয়? তাঁকে ধর। কাঁটাবন হলেই বা। জুতো পায়ে দিয়ে কাঁটাবনে চলে যাও। কিসের ভয়? যে বুড়ি ছোঁয় সে কি আর চোর হয়?

“জনক রাজা দুখানা তলোয়ার ঘোরাত। একখানা জ্ঞানের, একখানা কর্মের। পাকা খেলোয়াড়ের কিছু ভয় নাই।”

এইরূপ ঈশ্বরীয় কথা চলিতেছে। ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিয়া আছেন। খাটের পাশে মাস্টার বসিয়া আছেন।

ঠাকুর (মাস্টারকে) – ও যা বললে, তাইতে টেনে রেখেছে!

ঠাকুর মহিমাচরণের কথা বলিতেছেন ও তাঁহার কথিত ব্রহ্মজ্ঞান বিষয়ক শ্লোকের কথা। নবাই চৈতন্য ও অন্যান্য ভক্তেরা আবার গাইতেছেন। এবার ঠাকুর যোগদান করিলেন, আর ভাবে মগ্ন হইয়া সংকীর্তন মধ্যে নৃত্য করিতে লাগিলেন।

কীর্তনান্তে ঠাকুর বলিতেছেন, “এই কাজ হল, আর সব মিথ্যা। প্রেম ভক্তি – বস্তু, আর সব – অবস্তু।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!