১৮৮৬, ১৮ই এপ্রিল
বুদ্ধদেব কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানতেন? নরেন্দ্রকে শিক্ষা
বেলা নয়টা হইয়াছে, ঠাকুর মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন, ঘরে শশীও আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – নরেন্দ্র আর শশী কি বলছিল – কি বিচার করছিল?
মাস্টার (শশীর প্রতি) – কি কথা হচ্ছিল গা?
শশী – নিরঞ্জন বুঝি বলেছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ‘ঈশ্বর নাস্তি অস্তি’, এই সব কি কথা হচ্ছিল?
শশী (সহাস্যে) – নরেন্দ্রকে ডাকব?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ডাক। [নরেন্দ্র আসিয়া উপবেশন করিলেন।]
(মাস্টারের প্রতি) – “তুমি কিছু জিজ্ঞাসা কর। কি কথা হচ্ছিল, বল।”
নরেন্দ্র – পেট গরম হয়েছে। ও আর কি বলবো।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সেরে যাবে।
মাস্টার (সহাস্যে) – বুদ্ধ অবস্থা কিরকম?
নরেন্দ্র – আমার কি হয়েছে, তাই বলবো।
মাস্টার – ঈশ্বর আছেন – তিনি কি বলেন?
নরেন্দ্র – ঈশ্বর আছেন কি করে বলছেন? তুমিই জগৎ সৃষ্টি করছো। Berkely কি বলেছেন, জানো তো?
মাস্টার – হাঁ, তিনি বলেছেন বটে – Their esse is percipii (The existence of external objects depends upon their perception.) – “যতক্ষণ ইন্দ্রিয়ের কাজ চলেছে, ততক্ষণই জগৎ!’
[পূর্বকথা – তোতাপুরীর ঠাকুরকে উপদেশ – “মনেই জগৎ” ]
শ্রীরামকৃষ্ণ – ন্যাংটা বলত, “মনেই জগৎ, আবার মনেতেই লয় হয়।’
“কিন্তু যতক্ষণ আমি আছে, ততক্ষণ সেব্য-সেবকই ভাল।”
নরেন্দ্র (মাস্টারের প্রতি) – বিচার যদি কর, তাহলে ঈশ্বর আছেন, কেমন করে বলবে? আর বিশ্বাসের উপর যদি যাও, তাহলে সেব্য-সেবক মানতেই হবে। তা যাদি মানো – আর মানতেই হবে – তাহলে দয়াময়ও বলতে হবে।
“তুমি কেবল দুঃখটাই মনে করে রেখেছো। তিনি যে এত সুখ দিয়েছেন – তা ভুলে যাও কেন? তাঁর কত কৃপা! তিনটি বড় বড় জিনিস আমাদের দিয়েছেন – মানুষজন্ম, ঈশ্বরকে জানবার ব্যাকুলতা, আর মহাপুরুষের সঙ্গ দিয়েছেন। মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ।”
সকলে চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) – আমার কিন্তু বেশ বোধ হয়, ভিতরে একটি আছে।
রাজেন্দ্রলাল দত্ত আসিয়া বসিলেন। হোমিওপ্যাথিক মতে ঠাকুরের চিকিৎসা করিতেছেন। ঔষধাদির কথা হইয়া গেলে, ঠাকুর অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মনোমোহনকে দেখাইতেছেন।
ডাক্তার রাজেন্দ্র – উনি আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে।
নরেন্দ্র নিচে আসিয়াছেন। আপনা-আপনি গান গাহিতেছেন:
সব দুঃখ দূর করিলে দরশন দিয়ে, মোহিলে প্রাণ।
সপ্তলোক ভুলে শোক, তোমারে পাইয়ে,
কোথা আমি অতি দীন-হীন।
নরেন্দ্রের একটু পেটের অসুখ করিয়াছে। মাস্টারকে বলিতেছেন – “প্রেম-ভক্তির পথে থাকলে দেহে মন আসে। তা না হলে আমি কে? মানুষও নই – দেবতাও নই – আমার সুখও নাই, দুঃখও নাই।”
[ঠাকুরের আত্মপূজা – সুরেন্দ্রকে প্রসাদ – সুরেন্দ্রের সেবা ]
রাত্রি নয়টা হইল। সুরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা ঠাকুরের কাছে পুষ্পমালা আনিয়া নিবেদন করিয়াছেন! ঘরে বাবুরাম, সুরেন্দ্র, লাটু, মাস্টার প্রভৃতি আছেন।
ঠাকুর সুরেন্দ্রের মালা নিজে গলায় ধারণ করিয়াছেন, সকলেই চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। যিনি অন্তরে আছেন, ঠাকুর তাঁহারই বুঝি পূজা করিতেছেন!
হঠাৎ সুরেন্দ্রকে ইঙ্গিত করিয়া ডাকিতেছেন। সুরেন্দ্র শয্যার কাছে আসিলে প্রসাদীমালা (যে মালা নিজে পরিয়াছিলেন) লইয়া নিজে তাঁহার গলায় পরাইয়া দিলেন!
সুরেন্দ্র মালা পাইয়া প্রণাম করিলেন। ঠাকুর আবার তাঁহাকে ইঙ্গিত করিয়া পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে বলিতেছেন। সুরেন্দ্র কিয়ৎক্ষণ ঠাকুরের পদসেবা করিলেন।
[কাশীপুর উদ্যানে ভক্তগণের সংকীর্তন ]
ঠাকুর যে ঘরে আছেন, তাহার পশ্চিমদিকে একটি পুষ্করিণী আছে। এই পুষ্করিনীর ঘাটের চাতালে কয়েকটি ভক্ত খোল-করতাল লইয়া গান গাইতেছেন। ঠাকুর লাটুকে দিয়া বলিয়া পাঠাইলেন – “তোমরা একটু হরিনাম কর।”
মাস্টার, বাবুরাম প্রভৃতি এখনও ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছেন। তাঁহারা শুনিতেছেন, ভক্তেরা গাইতেছেন:
হরি বোলে আমার গৌর নাচে।
ঠাকুর গান শুনিতে শুনিতে বাবুরাম, মাস্টার প্রভৃতিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিতেছেন – “তোমরা নিচে যাও। ওদের সঙ্গে গান কর, – আর নাচবে।”
তাঁহারা নিচে আসিয়া কীর্তনে যোগদান করিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর আবার লোক পাঠাইয়াছেন। বলেছেন, এই আখরগুলি দেবে – “গৌর নাচতেও জানে রে! গৌরের ভাবের বালাই যাই রে! গৌর আমার নাচে দুই বাহু তুলে!”
কীর্তন সমাপ্ত হইল। সুরেন্দ্র ভাবাবিষ্টপ্রায় হইয়া গাইতেছেন –
আমার পাগল বাবা, পাগলী আমার মা।
আমি তাদের পাগল ছেলে, আমার মায়ের নাম শ্যামা।।
বাবা বব বম্ বলে, মদ খেয়ে মা গায়ে পড়ে ঢলে,
শ্যামার এলোকেশে দোলে;
রাঙা পায়ে ভ্রমর গাজে, ওই নূপুর বাজে শুন না।