১৮৮৬, ২৩শে – ২৪শে এপ্রিল
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রাদি ভক্তের মজলিশ
[সুরেন্দ্র, শরৎ, শশী, লাটু, নিত্যগোপাল, কেদার, গিরিশ, রাম, মাস্টার ]
বৈকাল হইয়াছে। উপরের হলঘরে অনেকগুলি ভক্ত বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র, শরৎ, শশী, লাটু, নিত্যগোপাল, কেদার, গিরিশ, রাম, মাস্টার, সুরেশ অনেকেই আছেন।
সকলের অগ্রে নিত্যগোপাল আসিয়াছেন ও ঠাকুরকে দেখিবামাত্র তাঁহার চরণে মস্তক দিয়া বন্দনা করিয়াছেন। উপবেশনানন্তর নিত্যগোপাল বালকের ন্যায় বলিতেছেন কেদারবাবু এসেছে।
কেদার অনেকদিন পরে ঠাকুরকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। তিনি বিষয়কর্ম উপলক্ষে ঢাকায় ছিলেন। সেখানে ঠাকুরের অসুখের কথা শুনিয়া আসিয়াছেন। কেদার ঘরে প্রবেশ করিয়াই ঠাকুরের ভক্তসম্ভাষণ দেখিতেছেন।
কেদার ঠাকুরের পদধূলি নিকে মস্তকে গ্রহণ করিলেন ও আনন্দে সেই ধূলি লইয়া সকলেকে বিতরণ করিতেছেন। ভক্তেরা মস্তক অবনত করিয়া সেই ধূলি গ্রহণ করিতেছেন।
শরৎকে দিতে যাইতেছেন, এমন সময় তিনি নিজেই ঠাকুরের চরণধূলি লইলেন। মাস্টার হাসিলেন। ঠাকুরও মাস্টারের দিকে চাহিয়া হাসিলেন। ভক্তেরা নিঃশব্দে বসিয়া আছেন। ঠাকুরের ভাব-লক্ষণ দেখা যাইতেছে। মাঝে মাযে নিঃশ্বাস ত্যাগ করিতেছেন, যেন ভাব চাপিতেছেন। অবশেষে কেদারকে ইঙ্গিত করিতেছেন – গিরিশ ঘোষের সহিত তর্ক কর। গিরিশ কান-নাক মলিতেছেন আর বলিতেছেন, “মহাশয় নাক-কান মলছি! আগে জানতাম না, আপনি কে! তখন তর্ক করেছি; সে এক!” (ঠাকুরের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কেদারকে দেখাইতেছেন ও বলিতেছেন, “সব ত্যাগ করেছে! (ভক্তদের প্রতি) কেদার নরেন্দ্রকে বলেছিল, এখন তর্ক কর বিচার কর, কিন্তু শেষে হরিনামে গড়াগড়ি দিতে হবে। (নরেন্দ্রের প্রতি) – কেদারের পায়ের ধুলা নাও।”
কেদার (নরেন্দ্রকে) – ওঁর পায়ের ধুলা নাও; তাহলেই হবে।
সুরেন্দ্র ভক্তদের পশ্চাতে বসিয়া আছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ হাস্য করিয়া তাঁহার দিকে তাকাইলেন। কেদারকে বলিতেছেন, আহা, কি স্বভাব! কেদার ঠাকুরের ইঙ্গিত বুঝিয়া সুরেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হইয়া বসিলেন।
সুরেন্দ্র একটু অভিমানী। ভক্তেরা কেহ কেহ বাগানের খরচের জন্য বাহিরের ভক্তদের কাছে অর্থ সংগ্রহ করিতে গিয়াছিলেন। তাই বড় অভিমান হইয়াছে। সুরেন্দ্র বাগানের অধিকাংশ খরচ দেন।
সুরেন্দ্র (কেদারের প্রতি) – অত সাধুদের কাছে কি আমি বসতে পারি! আবার কেউ কেউ (নরেন্দ্র) কয়দিন হইল, সন্ন্যাসীর বেশে বুদ্ধগয়া দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। বড় বড় সাধু দেখতে!
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সুরেন্দ্রকে ঠাণ্ডা করিতেছেন। বলছেন, হাঁ, ওরা ছেলেমানুষ, ভাল বুঝতে পারে না।
সুরেন্দ্র (কেদারের প্রতি) – গুরুদেব কি জানেন না, কার কি ভাব। উনি টাকাতে তুষ্ট নন; উনি ভাব নিয়ে তুষ্ট!
ঠাকুর মাথা নাড়িয়া সুরেন্দ্রের কথায় সায় দিতেছেন। “ভাব নিয়ে তুষ্ট”, এই কথা শুনিয়া কেদারও আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন।
ভক্তেরা খাবার আনিয়াছেন ও ঠাকুরের সামনে রাখিয়াছিলেন। ঠাকুর জিহ্বাতে কণিকামাত্র ঠেকাইলেন। সুরেন্দ্রের হাতে প্রসাদ দিতে বলিলেন ও অন্য সকলকে দিতে বলিলেন।
সুরেন্দ্র নিচে গেলেন। নিচে প্রসাদ বিতরণ হইবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেদারের প্রতি) – তুমি বুঝিয়ে দিও। যাও একবার – বকাবকি করতে মানা করো।
মণি হাওয়া করিতেছেন। ঠাকুর বলিলেন, “তুমি খাবে না?” মণিকেও নিচে প্রসাদ পাইতে পাঠাইলেন।
সন্ধ্যা হয় হয়! গিরিশ ও শ্রীম – পুকুরধারে বেড়াইতেছেন।
গিরিশ – ওহে তুমি ঠাকুরের বিষয় – কি নাকি লিখেছো?
শ্রীম – কে বললে?
গিরিশ – আমি শুনেছি। আমায় দেবে?
শ্রীম – না; আমি নিজে না বুঝে কারুকে দেব না – ও আমি নিজের জন্য লিখেছি।
অন্যের জন্য নয়!
গিরিশ – বল কি!
শ্রীম – আমার দেহ যাবার সময় পাবে।
[ঠাকুর অহেতুক-কৃপাসিন্ধু – ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত অমৃত ]
সন্ধ্যার পর ঠাকুরের ঘরে আলো জ্বালা হইয়াছে। ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত অমৃত (বসু) দেখিতে আসিয়াছেন। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন। মাস্টার ও দুই-চারিজন ভক্ত বসিয়া আছেন। ঠাকুরের সম্মুখে কলাপাতায় বেল ও জুঁই ফুলের মালা রহিয়াছে। ঘর নিস্তব্ধ। যেন একটি মহাযোগী নিঃশব্দে যোগে বসিয়া আছেন। ঠাকুর মালা লইয়া এক-একবার তুলিতেছেন। যেন গলায় পরিবেন।
অমৃত (স্নেহপূর্ণস্বরে) – মালা পরিয়ে দেব?
মালা পরা হইলে, ঠাকুর অমৃতের সহিত অনেক কথা কহিলেন। অমৃত বিদায় লইবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি আবার এসো।
অমৃত – আজ্ঞে, আসবার খুব ইচ্ছা। অনেক দুর থেকে আসতে হয় – তাই সব সময় পারি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি এসো। এখান থেকে গাড়িভাড়া নিও।
অমৃতের প্রতি ঠাকুরের অহেতুক স্নেহ দেখিয়া সকলে অবাক্।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তের স্ত্রী পুত্র ]
পরদিন শনিবার, ২৪শে এপ্রিল। একটি ভক্ত আসিয়াছেন। সঙ্গে পরিবার ও একটি সাত বছরের ছেলে। একবৎসর হইল একটি অষ্টমবর্ষীয় সন্তান দেহত্যাগ করিয়াছে। পরিবারটি সেই অবধি পাগলের মতো হইয়াছেন। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে মাঝে মাঝে আসিতে বলেন।
খাইতে খাইতে, ঠাকুর তাঁহাকে ঘরকন্নার কথা অনেক জিজ্ঞাসা করিলেন ও কিছুদিন ওই বাগানে আসিয়া শ্রীশ্রীমার কাছে থাকিতে বলিলেন। তাহা হইলে শোক অনেক কম পড়িবে। তাঁহার একটি কোলের মেয়ে ছিল। পরে শ্রীশ্রীমা তাহাকে মানময়ী বলিয়া ডাকিতেন। ঠাকুর ইঙ্গিত করিয়া বলিলেন, তাকেও আনবে।
ঠাকুরের খাওয়ার পর ভক্তটির পরিবার স্থানটি পরিষ্কার করিয়া লইলেন। ঠাকুরের সঙ্গে কিয়ৎক্ষণ কথাবার্তার পর, শ্রীশ্রীমা যখন নিচের ঘরে গেলেন, তিনি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া সেই সঙ্গে গমন করিলেন।
রাত্রি প্রায় নয়টা হইল। ঠাকুর ভক্তসঙ্গে সেই ঘরে বসিয়া আছেন। ফুলের মালা পরিয়াছেন। মণি হাওয়া করিতেছেন।
ঠাকুর গলদেশ হইতে মালা লইয়া হাতে করিয়া আপন মনে কি বলিতেছেন। তারপর যেন প্রসন্ন হইয়া মণিকে মালা দিলেন।
শোকসন্তপ্তা ভক্তের পত্নীকে ঠাকুর শ্রীশ্রীমার কাছে ওই বাগানে আসিয়া কিছুদিন থাকিতে বলিয়াছেন, মণি সমস্ত শুনিলেন।