১৮৮৬, ৪ঠা জানুয়ারি
ঈশ্বরের জন্য শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রের ব্যাকুলতা ও তীব্র বৈরাগ্য
সন্ধ্যা হইয়াছে, নরেন্দ্র নিচে বসিয়া তামাক খাইতেছেন ও নিভৃতে মণির কাছে নিজের প্রাণ কিরূপ ব্যাকুল গল্প করিতেছেন।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি) – গত শনিবার এখানে ধ্যান করছিলাম। হঠাৎ বুকের ভিতর কিরকম করে এল!
মণি – কুণ্ডলিনী জাগরণ।
নরেন্দ্র – তাই হবে, বেশ বোধ হল – ইড়া-পিঙ্গলা। হাজরাকে বললাম, বুকে হাত দিয়ে দেখতে।
“কাল রবিবার, উপরে গিয়ে এঁর সঙ্গে দেখা কল্লাম, ওঁকে সব বললাম।
“আমি বললাম, ‘সব্বাই-এর হল, আমায় কিছু দিন। সব্বাই-এর হল, আমার হবে না’?”
মণি – তিনি তোমায় কি বললেন?
নরেন্দ্র – তিনি বললেন, ‘তুই বাড়ির একটা ঠিক করে আয় না, সব হবে। তুই কি চাস?’
[Sri Ramakrishna and the Vedanta – নিত্যলীলা দুই গ্রহণ ]
“আমি বললাম, – আমার ইচ্ছা অমনি তিন-চারদিন সমাধিস্থ হয়ে থাকব! কখন কখন এক-একবার খেতে উঠব!
“তিনি বললেন, ‘তুই তো বড় হীনবুদ্ধি! ও অবস্থার উঁচু অবস্থা আছে। তুই তো গান গাস, ‘যো কুছ্ হ্যায় সো তুঁহি হ্যায়’।”
মণি – হাঁ, উনি সর্বদাই বলেন যে, সমাধি থেকে নেমে এসে দেখে – তিনিই জীবজগৎ, এই সমস্ত হয়েছেন। ঈশ্বরকোটির এই অবস্থা হতে পারে। উনি বলেন, জীবকোটি সমাধি অবস্থা যদিও লাভ করে আর নামতে পারে না।
নরেন্দ্র – উনি বললেন, – তুই বাড়ির একটা ঠিক করে আয়, সমাধিলাভের অবস্থার চেয়েও উঁচু অবস্থা হতে পারবে।
“আজ সকালে বাড়ি গেলাম। সকলে বকতে লাগল, – আর বললে, ‘কি হো-হো করে বেড়াচ্ছিস? আইন একজামিন (বি. এল.) এত নিকটে, পড়াশুনা নাই, হো-হো করে বেড়াচ্ছে’।”
মণি – তোমার মা কিছু বললেন?
নরেন্দ্র – না, তিনি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত, হরিণের মাংস ছিল; খেলুম, – কিন্তু খেতে ইচ্ছা ছিল না।
মণি – তারপর?
নরেন্দ্র – দিদিমার বাড়িতে, সেই পড়বার ঘরে পড়তে গেলাম। পড়তে গিয়ে পড়াতে একটা ভয়ানক আতঙ্ক এল, – পড়াটা যেন কি ভয়ের জিনিস! বুক আটুপাটু করতে লাগল! – অমন কান্না কখনও কাঁদি নাই।
“তারপর বই-টই ফেলে দৌড়! রাস্তা দিয়ে ছুট! জুতো-টুতো রাস্তায় কোথায় একদিকে পড়ে রইল! খড়ের গাদার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম, – গায়েময়ে খড়, আমি দৌড়ুচ্চি, – কাশীপুরের রাস্তায়।”
নরেন্দ্র একটু চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র – বিবেক চূড়ামণি শুনে আরও মন খারাপ হয়েছে! শঙ্করাচার্য বলেন – যে, এই তিনটি জিনিস অনেক তপস্যায়, অনেক ভাগ্যে মেলে, – মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাওপুরুষসংশ্রয়ঃ।
“ভাবলাম আমার তো তিনটিই হয়েছে! – অনেক তপস্যার ফলে মানুষ জন্ম হয়েছে, অনেক তপস্যার ফলে মুক্তির ইচ্ছা হয়েছে, – আর অনেক তপস্যার ফলে এরূপ মহাপুরুষের সঙ্গ লাভ হয়েছে।”
মণি – আহা!
নরেন্দ্র – সংসার আর ভাল লাগে না। সংসারে যারা আছে তাদেরও ভাল লাগে না। দুই-একজন ভক্ত ছাড়া।
নরেন্দ্র অমনি আবার চুপ করিয়া আছেন। নরেন্দ্রের ভিতর তীব্র বৈরাগ্য! এখনও প্রাণ আটুপাটু করিতেছে। নরেন্দ্র আবার কথা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি) – আপনাদের শান্তি হয়েছে, আমার প্রাণ অস্থির হচ্ছে! আপনারাই ধন্য!
মণি কিছু উত্তর করিলেন না, চুপ করিয়া আছেন। ভাবিতেছেন, ঠাকুর বলিয়াছিলেন, ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল হতে হয়, তবে ঈশ্বরদর্শন হয়। সন্ধ্যার পরেই মণি উপরের ঘরে গেলেন। দেখলেন, ঠাকুর নিদ্রিত।
রাত্রি প্রায় ৯টা। ঠাকুরের কাছে নিরঞ্জন, শশী। ঠাকুর জাগিয়াছেন। থাকিয়া থাকিয়া নরেন্দ্রের কথাই বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – নরেন্দ্রের অবস্থা কি আশ্চর্য! দেখো, এই নরেন্দ্র আগে সাকার মানত না! এর প্রাণ কিরূপ আটুপাটু হয়েছে দেখছিল। সেই যে আছে – একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, ঈশ্বরকে কেমন করে পাওয়া যায়। গুরু বললেন, ‘এস আমার সঙ্গে; তোমায় দেখিয়ে দিই কি হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।’ এই বলে একটা পুকুরে নিয়ে গিয়ে তাকে জলে চুবিয়ে ধরলেন! খানিকক্ষণ পরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার পর শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার প্রাণটা কি-রকম হচ্ছিল?’ সে বললে, ‘প্রাণ যায় যায় হচ্ছিল!’
“ঈশ্বরের জন্য প্রাণ আটুবাটু করলে জানবে যে দর্শনের আর দেরি নাই। অরুণ উদয় হলে – পূর্বদিক লাল হলে – বুঝা যায় সূর্য উঠবে।”
ঠাকুরের আজ অসুখ বাড়িয়াছে। শরীরের এত কষ্ট। তবুও নরেন্দ্র সম্বন্ধে এই সকল কথা, – সঙ্কেত করিয়া বলিতেছেন।
নরেন্দ্র এই রাত্রেই দক্ষিণেশ্বর চলিয়া গিয়াছেন। গভীর অন্ধকার – অমাবস্যা পড়িয়াছে। নরেন্দ্রের সঙ্গে দু-একটি ভক্ত। মণি রাত্রে বাগানেই আছেন। স্বপ্নে দেখিতেছেন, সন্ন্যাসীমণ্ডলের ভিতর বসিয়া আছেন।