ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৬, ৫ই জানুয়ারি

ভক্তদের তীব্র বৈরাগ্য – সংসার ও নরক যন্ত্রণা
পরদিন মঙ্গলবার, ৫ই জানুয়ারি ২২শে পৌষ। অনেকক্ষণ অমাবস্যা আছে। বেলা ৪টা বাজিয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শয্যায় বসিয়া আছেন, মণির সহিত নিভৃতে কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ক্ষীরোদ যদি ৺গঙ্গাসাগর যায় তাহলে তুমি কম্বল একখানা কিনে দিও।

মণি – যে আজ্ঞা।

ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা, ছোকরাদের একি হচ্ছে বল দেখি? কেউ শ্রীক্ষেত্রে পালাচ্ছে – কেউ গঙ্গাসাগরে!

“বাড়ি ত্যাগ করে করে সব আসছে। দেখ না নরেন্দ্র। তীব্র বৈরাগ্য হলে সংসার পাতকুয়ো বোধ হয়, আত্মীয়েরা কালসাপ বোধ হয়।”

মণি – আজ্ঞা, সংসারে ভারী যন্ত্রণা!

শ্রীরামকৃষ্ণ – নরকযন্ত্রণা! জন্ম থেকে। দেখছ না। – মাগছেলে নিয়ে কি যন্ত্রণা!

মণি – আজ্ঞা হাঁ। আর আপনি বলেছিলেন, ওদের (সংসারে ঢুকে নাই তাদের) লেনাদেনা নাই, লেনাদেনার জন্য আটকে থাকতে হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখছ না – নিরঞ্জনকে! ‘তোর এই নে আমার এই দে’ – বাস! আর কোনও সম্পর্ক নাই। পেছুটান নাই!

“কামিনী-কাঞ্চনই সংসার। দেখ না, টাকা থাকলেই বাঁধতে ইচ্ছা করে।” মণি হো-হো করিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। ঠাকুরও হাসিলেন।

মণি – টাকা বার করতে অনেক হিসাব আসে। (উভয়ের হাস্য) তবে দক্ষিণেশ্বরে বলেছিলেন, ত্রিগুণাতীত হয়ে সংসারে থাকতে পারলে এক হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ বালকের মতো।

মণি – আজ্ঞা, কিন্তু বড় কঠিন, বড় শক্তি চাই।

ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন।

মণি – কাল ওরা দক্ষিণেশ্বরে ধ্যান করতে গেল। আমি স্বপ্ন দেখলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি দেখলে?

মণি – দেখলাম যেন নরেন্দ্র প্রভৃতি সন্ন্যাসী হয়েছেন – ধুনি জ্বেলে বসে আছেন। আমিও তাদের মধ্যে বসে আছি। ওরা তামাক খেয়ে ধোঁয়া মুখ দিয়ে বার ক’চ্চে, আমি বললাম, গাঁজার ধোঁয়ার গন্ধ।

[সন্ন্যাসী কে – ঠাকুরের পীড়া ও বালকের অবস্থা ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – মনে ত্যাগ হলেই হল, তাহলেও সন্ন্যাসী।

ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কিন্তু বাসনায় আগুন দিতে হয়, তবে তো!

মণি – বড়বাজারে মারোয়াড়ীদের পণ্ডিতজীকে বলেছিলেন, ‘ভক্তিকামনা আমার আছে।‘ – ভক্তিকামনা বুঝি কামনার মধ্যে নয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ – যেমন হিঞ্চেশাক শাকের মধ্যে নয়। পিত্ত দমন হয়।

“আচ্ছা, এত আনন্দ, ভাব – এ-সব কোথায় গেল?”

মণি – বোধ হয় গীতায় যে ত্রিগুণাতীতের কথা বলা আছে সেই অবস্থা হয়েছে। সত্ত্ব রজঃ তমোগুণ নিজে নিজে কাজ করছে, আপনি স্বয়ং নির্লিপ্ত – সত্ত্ব গুণেতেও নির্লিপ্ত।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ; বালকের অবস্থায় রেখেছে।

“আচ্ছা, দেহ কি এবার থাকবে না?”

ঠাকুর ও মণি চুপ করিয়া আছেন। নরেন্দ্র নিচে হইতে আসিলেন। একবার বাড়ি যাইবেন। বন্দোবস্ত করিয়া আসিবেন।

পিতার পরলোক প্রাপ্তির পর তাঁহার মা ও ভাইরা অতি কষ্টে আছেন, – মাঝে মাঝে অন্নকষ্ট। নরেন্দ্র একমাত্র তাঁহাদের ভরসা, – তিনি রোজগার করিয়া তাঁহাদের খাওয়াইবেন। কিন্তু নরেন্দ্রের আইন পরীক্ষা দেওয়া হইল না। এখন তীব্র বৈরাগ্য! তাই আজ বাড়ির কিছু বন্দোবস্ত করিতে কলিকাতায় যাইতেছেন। একজন বন্ধু তাঁহাকে একশত টাকা ধার দিবেন। সেই টাকায় বাড়ির তিন মাসের খাওয়ার যোগাড় করিয়া দিয়া আসিবেন।

নরেন্দ্র – যাই বাড়ি একবার। (মণির প্রতি) মহিম চক্রবর্তীর বাড়ি হয়ে যাচ্ছি, আপনি কি যাবেন?

মণির যাইবার ইচ্ছা নাই; ঠাকুর তাঁহার দিকে তাকাইয়া নরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “কেন”?

নরেন্দ্র – ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, তাঁর সঙ্গে বলসে একটু গল্পটল্প করব।

ঠাকুর একদৃষ্টে নরেন্দ্রকে দেখিতেছেন।

নরেন্দ্র – এখানকার একজন বন্ধু বলেছেন, আমায় একশ টাকা ধার দিবেন। সেই টাকাতে বাড়ির তিন মাসের বন্দোবস্ত করে আসব।

ঠাকুর চুপ করিয়া আছেন। মণির দিকে তাকাইলেন।

মণি (নরেন্দ্রকে) – না, তোমরা এগোও, – আমি পরে যাব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!