ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৬, ১৪ই মার্চ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে সাঙ্গোপাঙ্গসঙ্গে
ভক্তের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের দেহধারণ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুরের বাগানে রহিয়াছেন। সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। ঠাকুর অসুস্থ। উপরের হলঘরে উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র ও রাখাল দুইজনে পদসেবা করিতেছেন, মণি কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর ইঙ্গিত করিয়া তাহাকে পদসেবা করিতে বলিলেন। মণি পদসেবা করিতেছেন।

আজ রবিবার, ১৪ই মার্চ, ১৮৮৬; ২রা চৈত্র, ফাল্গুন শুক্লা নবমী। গত রবিবারে ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে বাগানে পূজা হইয়া গিয়াছে। গত বর্ষে জন্মমহোৎসব দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে খুব ঘটা করিয়া হইয়াছিল। এবার তিনি অসুস্থ। ভক্তেরা বিষাদসাগরে ডুবিয়া আছেন। পূজা হইল। নামমাত্র উৎসব হইল।

ভক্তেরা সর্বদাই বাগানে উপস্থিত আছেন ও ঠাকুরের সেবা করিতেছেন। শ্রীশ্রীমা ওই সেবায় নিশিদিন নিযুক্ত। ছোকরা ভক্তেরা অনেকেই সর্বদা থাকেন, নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, শরৎ, বাবুরাম, যোগীন, কালী, লাটু প্রভৃতি।

বয়স্ক ভক্তেরা মাঝে মাঝে থাকেন ও প্রায় প্রত্যহ আসিয়া ঠাকুরকে দর্শন করেন বা তাঁহাঁর সংবাদ লইয়া যান। তারক, সিঁথির গোপাল, ইঁহারা সর্বদা থাকেন। ছোট গোপালও থাকেন।

ঠাকুর আজও বিশেষ অসুস্থ। রাত্রি দুই প্রহর। আজ শুক্ল পক্ষের নবমী তিথি, চাঁদের আলোয় উদ্যানভূমি যেন আনন্দময় হইয়া রহিয়াছে। ঠাকুরের কঠিন পীড়া, চন্দ্রের বিমলকিরণ দর্শনে ভক্তহৃদয়ে আনন্দ নাই। যেমন একটি নগরীর মধ্যে সকলই সুন্দর, কিন্তু শত্রুসৈন্য অবরোধ করিয়াছে। চতুর্দিক নিস্তব্ধ, কেবল বসন্তানিলস্পর্শে বৃক্ষপত্রের শব্দ হইতেছে। উপরের হলঘরে ঠাকুর শুইয়া আছেন। ভারী অসুস্থ, নিদ্রা নাই। দু-একটি ভক্ত নিঃশব্দে কাছে বসিয়া আছেন কখন কি প্রয়োজন হয়। এক-একবার তন্দ্রা আসিতেছে ও ঠাকুরকে নিদ্রাগতপ্রায় বোধ হইতেছে।

এ কি নিদ্রা না মহাযোগ? ‘যস্মিন্‌ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে!’ এ কি সেই যোগাবস্থা?

মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর ইঙ্গিত করিয়া আরও কাছে আসিতে বলিতেছেন। ঠাকুরের কষ্ট দেখিলে পাষাণ বিগলিত হয়! মাস্টারকে আস্তে আস্তে অতি কষ্টে বলিতেছেন “তোমরা কাঁদবে বলে এত ভোগ করছি সব্বাই যদি বল যে ‘এত কষ্ট, তবে দেহ যাক’ তাহলে দেহ যায়!”

কথা শুনিয়া ভক্তদের হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। যিনি তাঁহাদের পিতা মাতা রক্ষাকর্তা তিনি এই কথা বলিতেছেন! সকলে চুপ করিয়া আছেন। কেহ ভাবিতেছেন, এরই নাম কি Crucifixation! ভক্তের জন্য দেহ বিসর্জন!

গভীর রাত্রি। ঠাকুরের অসুখ আরও যেন বাড়িতেছে! কি উপায় করা যায়? কলিকাতায় লোক পাঠানো হইল। শ্রীযুক্ত উপেন্দ্র ডাক্তার আর শ্রীযুক্ত নবগোপাল কবিরাজকে সঙ্গে করিয়া গিরিশ সেই গভীর রাত্রে আসিলেন।

ভক্তেরা কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর একটু সুস্থ হইতেছেন। বলিতেছেন, “দেহের অসুখ, তা হবে, দেখছি পঞ্চভূতের দেহ!”

গিরিশের দিকে তাকাইয়া বলিতেছেন, “অনেক ঈশ্বরীয় রূপ দেখেছি! তার মধ্যে এই রূপটিও (নিজের মূর্তি) দেখছি!”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!