১৮৮৬, ১৫ই মার্চ
সমাধিমন্দিরে
পরদিন সকাল বেলা। আজ সোমবার, ৩রা চৈত্র; ১৫ই মার্চ, (১৮৮৬)। বেলা ৭টা-৮টা হইবে। ঠাকুর একটু সামলাইয়াছেন ও ভক্তদের সহিত আস্তে আস্তে, কখনও ইশারা করিয়া কথা কহিতেছেন। কাছে নরেন্দ্র, রাখাল, মাস্টার, লাটু, সিঁথির গোপাল প্রভৃতি।
ভক্তদের মুখে কথা নাই, ঠাকুরের পূর্বরাত্রির দেহের অবস্থা স্মরণ করিয়া তাঁহারা বিষাদগম্ভীর মুখে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন।
[ঠাকুরের দর্শন, ঈশ্বর, জীব, জগৎ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের দিকে তাকাইয়া, ভক্তদের প্রতি) – কি দেখছি জানো? তিনি সব হয়েছেন! মানুষ আর যা জীব দেখছি, যেন চামড়ার সব তয়েরি – তার ভিতর থেকে তিনিই হাত পা মাথা নাড়ছেন! যেমন একবার দেখেছিলাম – মোমের বাড়ি, বাগান, রাস্তা, মানুষ গরু সব মোমের – সব এক জিনিসে তয়েরি।
“দেখছি – সে-ই কামার, সে-ই বলি, সে-ই হাড়িকাট হয়েছে!”
ঠাকুর কি বলিতেছেন, জীবের দুঃখে কাতর হইয়া তিনি নিজের শরীর জীবের মঙ্গলের জন্য বলিদান দিতেছেন?
ঈশ্বরই কামার, বলি, হাড়িকাট হইয়াছেন। এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর ভাবে বিভোর হইয়া বলিতেছেন – “আহা! আহা!”
আবার সেই ভাববস্থা! ঠাকুর বাহ্যশূন্য হইতেছেন। ভক্তেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছেন।
ঠাকুর একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিতেছেন – “এখন আমার কোনও কষ্ট নাই, ঠিক পূর্বাবস্থা।”
ঠাকুরের এই সুখ-দুঃখের অতীত অবস্থা দেখিয়া ভক্তেরা অবাক্ হইয়া রহিয়াছেন। লাটুর দিকে তাকাইয়া আবার বলিতেছেন –
“ওই লোটো – মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে, – তিনিই (ঈশ্বরই) মাথায় হাত দিয়ে যেন রয়েছেন!”
ঠাকুর ভক্তদের দেখিতেছেন ও স্নেহে যেন বিগলিত হইতেছেন। যেমন শিশুকে আদর করে, সেইরূপ রাখাল ও নরেন্দ্রকে আদর করিতেছেন! তাঁহাদের মুখে হাত বুলাইয়া আদর করিতেছেন!
[কেন লীলা সংবরণ ]
কিয়ৎপরে মাস্টারকে বলিতেছেন, “শরীরটা কিছুদিন থাকত, লোকদের চৈতন্য হত।” ঠাকুর আবার চুপ করিয়া আছেন।
ঠাকুর আবার বলিতেছেন – “তা রাখবে না।”
ভক্তেরা ভাবিতেছেন, ঠাকুর আবার কি বলিবেন। ঠাকুর আবার বলিতেছেন, “তা রাখবে না, – সরল মূর্খ দেখে পাছে লোকে সব ধরে পড়ে। সরল মূর্খ পাছে সব দিয়ে ফেলে! একে কলিতে ধ্যান-জপ নাই।”
রাখাল (সস্নেহে) – আপনি বলুন – যাতে আপনার দেহ থাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সে ঈশ্বরের ইচ্ছা।
নরেন্দ্র – আপনার ইচ্ছা আর ঈশ্বরের ইচ্ছা এক হয়ে গেছে।
ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন – যেন কি ভাবিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্র, রাখালাদি ভক্তের প্রতি) – আর বললে কই হয়?
“এখন দেখছি এক হয়ে গেছে। ননদিনীর ভয়ে কৃষ্ণকে শ্রীমতী বললেন, ‘তুমি হৃদয়ের ভিতর থাকো’। যখন আবার ব্যাকুল হয়ে কৃষ্ণকে দর্শন করিতে চাইলেন; – এমনি ব্যাকুলতা – খেমন বেড়াল আঁচড় পাঁচড় করে, – তখন কিন্তু আর বেরয় না!”
রাখাল (ভক্তদের প্রতি, মৃদুস্বরে) – গৌর অবতারের কথা বলছেন।