১৮৮৬, ১৫ই মার্চ
গুহ্যকথা – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁহার সাঙ্গোপাঙ্গ
ভক্তেরা নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছেন। ঠাকুর ভক্তদের সস্নেহে দেখিতেছেন, নিজের হৃদয়ে হাত রাখিলেন – কি বলিবেন –
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদিকে) – এর ভিতর দুটি আছেন। একটি তিনি।
ভক্তেরা অপেক্ষা করিতেছেন আবার কি বলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – একটি তিনি – আর একটি ভক্ত হয়ে আছে। তারই হাত ভেঙে ছিল – তারই এই অসুখ করেছে। বুঝেছ?
ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কারেই বা বলব কেই বা বুঝবে।
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর আবার কথা কহিতেছেন –
“তিনি মানুষ হয়ে – অবতার হয়ে – ভক্তদের সঙ্গে আসেন। ভক্তেরা তাঁরই সঙ্গে আবার চলে যায়।”
রাখাল – তাই আমাদের আপনি খেন ফেলে না যান।
ঠাকুর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বলিতেছেন, “বাউলের দল হঠাৎ এল, – নাচলে, গান গাইলে; আবার হঠাৎ চলে গেল! এল – গেল, কেউ চিনলে না। (ঠাকুরের ও সকলের ঈষৎ হাস্য)
কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া ঠাকুর আবার বলিতেছেন, –
“দেহধারণ করলে কষ্ট আছেই।
“এক-একবার বলি, আর যেন আসতে না হয়।
“তবে কি, – একটা কথা আছে। নিমন্ত্রণ খেয়ে খেয়ে আর বাড়ির কড়াই-এর ডাল-ভাত ভাল লাগে না।
“আর যে দেহধারণ করা, – এটি ভক্তের জন্য।”
ঠাকুর ভক্তের নৈবেদ্য – ভক্তের নিমন্ত্রণ – ভক্তসঙ্গে বিহার ভালবাসেন, এই কথা কি বলিতেছেন?
[নরেন্দ্রের জ্ঞান-ভক্তি – নরেন্দ্র ও সংসারত্যাগ ]
ঠাকুর নরেন্দ্রকে সস্নেহে দেখিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) – চণ্ডাল মাংসের ভার নিয়ে যাচ্ছিল। শঙ্করাচার্য গঙ্গা নেয়ে কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। চণ্ডাল হঠাৎ তাঁকে ছুঁয়ে ফেলেছিল। শঙ্কর বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই আমায় ছুঁয়ে ফেললি! সে বললে, ‘ঠাকুর তুমিও আমায় ছোঁও নাই, আমিও তোমায় ছুঁই নাই! তুমি বিচার-কর! তুমি কি দেহ, তুমি কি মন, তুমি কি বুদ্ধি; কি তুমি, বিচার কর! শুদ্ধ আত্মা নির্লিপ্ত – সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ; তিনগুণ; – কোন গুণে লিপ্ত নয়।’
“ব্রহ্ম কিরূপ জানিস। যেমন বায়ু। দুর্গন্ধ, ভাল গন্ধ – সব বায়ুতে আসছে, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত।”
নরেন্দ্র – আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ – গুণাতীত। মায়াতীত। অবিদ্যামায়া বিদ্যামায়া দুয়েরই আতীত। কামিনী-কাঞ্চন অবিদ্যা। জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তি – এ-সব বিদ্যার ঐশ্বর্য। শঙ্করাচার্য বিদ্যামায়া রেখেছিলেন। তুমি আর এরা যে আমার জন্যে ভাবছ, এই ভাবনা বিদ্যামায়া!
“বিদ্যামায়া ধরে ধরে সেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। যেমন সিঁড়ির উপরের পইটে – তারপরে ছাদ। কেউ কেউ ছাদে পৌঁছানোর পরও সিঁড়িতে আনাগোনা করে – জ্ঞানলাভের পরও বিদ্যার আমি রাখে। লোকশিক্ষার জন্য। আবার ভক্তি আস্বাদ করবার জন্য – ভক্তের সঙ্গে বিলাস করবার জন্য।”
নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর কি এ-সমস্ত নিজের অবস্থা বলিতেছেন?
নরেন্দ্র – কেউ কেউ রাগে আমার উপর, ত্যাগ করবার কথায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মৃদুস্বরে) – ত্যাগ দরকার।
ঠাকুর নিজের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখাইয়া বলিতেছেন, “একটা জিনিসের পার যদি আর-একটা জিনিস থাকে, প্রথম জিনিসটা পেতে গেলে, ও জিনিসটা সরাতে হবে না? একটা না সরালে আর একটা কি পাওয়া যায়?”
নরেন্দ্র – আজ্ঞা হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রকে, মৃদুস্বরে) – সেই-ময় দেখলে আর কিছু কি দেখা যায়?
নরেন্দ্র – সংসারত্যাগ করতে হবেই?
শ্রীরামকৃষ্ণ – যা বললুম সেই-ময় দেখলে কি আর কিছু দেখা যায়? সংসার-ফংসার আর কিছু দেখা যায়?
“তবে মনে ত্যাগ। এখানে যারা আসে, কেউ সংসারী নয়। কারু কারু একটু ইচ্ছা ছিল – মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকা। (রাখাল, মাস্টার প্রভৃতির ঈষৎ হাস্য) সেই ইচ্ছাটুকু হয়ে গেল।
[নরেন্দ্র ও বীরভাব ]
ঠাকুর নরেন্দ্রকে সস্নেহে দেখিতেছেন। দেখিতে দেখিতে যেন আনন্দে পরিপূর্ণ হইতেছেন। ভক্তদের দিকে তাকাইয়া বলিতেছেন – ‘খুব’! নরেন্দ্র ঠাকুরকে সহাস্যে বলিতেছেন, ‘খুব’ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – খুব ত্যাগ আসছে।
নরেন্দ্র ও ভক্তেরা চুপ করিয়া আছেন ও ঠাকুরকে দেখিতেছেন। এইবার রাখাল কথা কহিতেছেন।
রাখাল (ঠাকুরকে, সহাস্যে) – নরেন্দ্র আপনাকে খুব বুঝছে।
ঠাকুর হাসিতেছেন ও বলিতেছেন, “হাঁ, আবার দেখছি অনেকে বুঝেছে! (মাস্টারের প্রতি) – না গা?”
মাস্টার – আজ্ঞা হাঁ।
ঠাকুর নরেন্দ্র ও মণিকে দেখিতেছেন ও হস্তের দ্বারা ইঙ্গিত করিয়া রাখালাদি ভক্তদিগকে দেখাইতেছেন। প্রথন ইঙ্গিত করিয়া নরেন্দ্রকে দেখাইলেন – তারপর মণিকে দেখাইলেন! রাখাল ইঙ্গিত বুঝিয়াছেন ও কথা কহিতেছেন।
রাখাল (সহাস্যে, শ্রীরামকৃষ্ণর প্রতি) – আপনি বলছেন নরেন্দ্রের বীরভাব? আর এঁর সখীভাব? [ঠাকুর হাসিতেছেন]
নরেন্দ্র (সহাস্যে) – ইনি বেশি কথা কন না, আর লাজুক; তাই বুঝি বলছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে নরেন্দ্রকে) – আচ্ছা, আমার কি ভাব?
নরেন্দ্র – বীরভাব, সখীভাব, – সবভাব।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ – কে তিনি? ]
ঠাকুর এই কথা শুনিয়া যেন ভাবে পূর্ণ হইলেন, হৃদয়ে হাত রাখিয়া কি বলিতেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রাদি ভক্তদিগকে) – দেখছি এর ভিতর থেকেই যা কিছু।
নরেন্দ্রকে ইঙ্গিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “কি বুঝলি?”
নরেন্দ্র – (“যা কিছু” অর্থাৎ) যত সৃষ্ট পদার্থ সব আপনার ভিতর থেকে!
শ্রীরামকৃষ্ণ (রাখালের প্রতি, আনন্দে) – দেখছিস!
ঠাকুর নরেন্দ্রকে একটু গান গাইতে বলিতেছেন। নরেন্দ্র সুর করিয়া গাহিতেছেন। নরেন্দ্রের ত্যাগের ভাব, – গাহিতেছেন:
“নলিনীদলগতজলমতিতরলম্ তদ্বজ্জীবনমতিশয়চপলম্
ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকা, ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা।”
দুই-এক চরণ গানের পরই ঠাকুর নরেন্দ্রকে ইঙ্গিত করিয়া বলিতেছেন, “ও কি! ও-সব ভাব অতি সামান্য!”
নরেন্দ্র এইবার সখী ভাবের গান গাহিতেছেন:
কাহে সই, জিয়ত মরত কি বিধান!
ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই, ব্রজজন টুটায়ল পরাণ।।
মিলি সই নাগরী, ভুলিগেই মাধব, রূপবিহীন গোপকুঙারী।
কো জানে পিয় সই, রসময় প্রেমিক, হেন বঁধু রূপ কি ভিখারি।।
আগে নাহি বুঝুনু, রূপ হেরি ভুলনু, হৃদি কৈনু চরণ যুগল।
যমুনা সলিলে সই, অব তনু ডারব, আন সখি ভখিব গরল।।
(কিবা) কানন বল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই, নবীন তমালে দিব ফাঁস।
নহে শ্যাম শ্যাম শ্যাম শ্যাম শ্যাম নাম-জপই, ছার তনু করিব বিনাশ।।
গান শুনিয়া ঠাকুর ও ভক্তেরা মুগ্ধ হইয়াছেন। ঠাকুর ও রাখালের নয়ন দিয়ে প্রেমাশ্রু পড়িতেছে। নরেন্দ্র আবার ব্রজগোপীর ভাবে মাতোয়ারা হইয়া কীর্তনের সুরে গাহিতেছেন:
তুমি আমার, আমার বঁধু, কি বলি (কি বলি তোমায় বলি নাথ)।
(কি জানি কি বলি আমি অভাগিনী নারীজাতি)।
তুমি হাতোকি দর্পণ, মাথোকি ফুল
(তোমায় ফুল করে কেশে পরব বঁধু)।
(তোমায় কবরীর সনে লুকায়ে লুকায়ে রাখব বঁধু)
(শ্যামফুল পরিলে কেউ নখতে নারবে)।
তুমি নয়নের অঞ্জন, বয়ানের তাম্বুল
(তোমায় শ্যাম অঞ্জন করে এঁখে পরবো বঁধু)
(শ্যাম অঞ্জন পরেছি বলে কেউ নখতে নারবে)
তুমি অঙ্গকি মৃগমদ গিমকি হার।
(শ্যামচন্দন মাখি শীতল হব বঁধু)
তোমার হার কণ্ঠে পরব বঁধু। তুমি দেহকি সর্বস্ব গেহকি সার।।
পাখিকো পাখ মীনকো পানি। তেয়সে হাম বঁধু তুয়া মানি।।