১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
কামিনী-কাঞ্চন ও তীব্র বৈরাগ্য
একজন ভক্ত – আপনার এ-সব ভাব নজিরের জন্য, তাহলে আমাদের কি করতে হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ভগবানলাভ করতে হলে তীব্র বৈরাগ্য দরকার। যা ঈশ্বরের পথে বিরুদ্ধ বলে বোধ হবে তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করতে হয়। পরে হবে বলে ফেলে রাখা উচিত নয়। কামিনী-কাঞ্চন ঈশ্বরের পথে বিরোধী; ও-থেকে মন সরিয়ে নিতে হবে।
“ঢিমে তেতালা হলে হবে না। একজন গামছা কাঁধে স্নান করতে যাচ্ছে। পরিবার বললে, তুমি কোন কাজের নও, বয়স বাড়ছে, এখন এ-সব ত্যাগ করতে পারলে না। আমাকে ছেড়ে তুমি একদিনও থাকতে পার না। কিন্তু অমুক কেমন ত্যাগী!
স্বামী – কেন, সে কি করেছে?
পরিবার – তার ষোলজন মাগ, সে এক-একজন করে তাদের ত্যাগ করছে। তুমি কখনও ত্যাগ করতে পারবে না।
স্বামী – এক-একজন করে ত্যাগ! ওরে খেপী, সে ত্যাগ করতে পারবে না। যে ত্যাগ করে সে কি একটু একটু করে ত্যাগ করে!
পরিবার – (সহাস্যে) – তবু তোমার চেয়ে ভাল।
স্বামী – খেপী, তুই বুঝিস না। তার কর্ম নয়, আমিই ত্যাগ করতে পারব, এই দ্যাখ্ আমি চললুম!
“এর নাম তীব্র বৈরাগ্য। যাই বিবেক এল তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করলে। গামছা কাঁধেই চলে গেল। সংসার গোছগাছ করতে এল না। বাড়ির দিকে একবার পেছন ফিরে চাইলেও না।
“যে ত্যাগ করবে তার খুব মনের বল চাই। ডাকাত পড়ার ভাব। অ্যায়!!! – ডাকাতি করবার আগে যেমন ডাকাতেরা বলে – মারো! লোটো! কাটো!
“কি আর তোমরা করবে? তাঁতে ভক্তি, প্রেম লাভ করে দিন কাটানো। কৃষ্ণের অদর্শনে যশোদা পাগলের ন্যায় শ্রীমতীর কাছে গেলেন। শ্রীমতী তাঁর শোক দেখে আদ্যাশক্তিরূপে দেখা দিলেন। বললেন, মা, আমার কাছে বর নাও। যশোদা বললেন, মা, আর কি লব? তবে এই বল, যেন কায়মনোবাক্যে কৃষ্ণেরই সেবা করতে পারি। এই চক্ষে তার ভক্তদর্শন, – যেখানে যেখানে তার লীলা, এই পা দিয়ে সেখানে যেতে পারি, – এই হাতে তার সেবা আর তার ভক্তসেবা, – সব ইন্দ্রিয়, যেন তারই কাজ করে।”
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আবার ভাবাবেশের উপক্রম হইতেছে। হঠাৎ আপনা-আপনি বলিতেছেন, “সংহারমূর্তি কালী! – না নিত্যকালী!”
ঠাকুর অতি কষ্টে ভাব সম্বরণ করিলেন। এইবার একটু জলপান করিলেন। যশোদার কথা আবার বলিতে যাইতেছেন, শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখুজ্জে আসিয়া উপস্থিত। ইনি ও ইঁহার কনিষ্ঠ শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখুজ্জে ঠাকুরের কাছে নূতন যাওয়া-আসা করিতেছেন। মহেন্দ্রের ময়দার কল ও অন্যান্য ব্যবসা আছে। তাঁহার ভ্রাতা ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করিতেন। ইঁহাদের কাজকর্ম লোকজনে দেখে, নিজেদের খুব অবসর আছে। মহেন্দ্রের বয়স ৩৬।৩৭ হইবে, ভ্রাতার বয়স আন্দাজ ৩৪।৩৫। ইঁহাদের বাটী কেদেটি গ্রামে। কলিকাতা বাগবাজারেও একটি বসতবাটী আছে। তাঁহাদের সঙ্গে একটি ছোকরা ভক্ত আসা-যাওয়া করেন, তাঁহার নাম হরি। তাঁহার বিবাহ হইয়াছে; কিন্তু ঠাকুরের উপর বড় ভক্তি। মহেন্দ্র অনেকদিন দক্ষিণেশ্বরে যান নাই। হরিও যান নাই, আজ আসিয়াছেন। মহেন্দ্র গৌরবর্ণ ও সদা হাস্যমুখ, শরীর দোহারা। মহেন্দ্র ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। হরিও প্রণাম করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন এতদিন দক্ষিণেশ্বরে যাওনি গো?
মহেন্দ্র – আজ্ঞা, কেদেটিতে গিছলাম, কলকাতায় ছিলাম না।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কিগো ছেলেপুলে নাই, – কারু চাকরি করতে হয় না, – তবুও অবসর নাই! ভাল জ্বালা!
ভক্তেরা সকলে চুপ করিয়া আছেন। মহেন্দ্র একটু অপ্রস্তুত।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রের প্রতি) – তোমায় বলি কেন, – তুমি সরল, উদার – তোমার ঈশ্বরে ভক্তি আছে।
মহেন্দ্র – আজ্ঞে, আপনি আমার ভালোর জন্যই বলেছেন।
[বিষয়ী ও টাকাওয়ালা সাধু – সন্তানের মায়া ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – আর এখানকার যাত্রায় প্যালা দিতে হয় না। যদুর মা তাই বলে, ‘অন্য সাধু কেবল দাও দাও করে; বাবা, তোমার উটি নাই’। বিষয়ী লোকের টাকা খরচ হলে বিরক্ত হয়।
“এক জায়গায় যাত্রা হচ্ছিল। একজন লোকের বসে শোনবার ভারী ইচ্ছা। কিন্তু সে উঁকি মেরে দেখলে যে আসরে প্যালা পড়ছে, তখন সেখান থেকে আস্তে আস্তে পালিয়ে গেল। আর-এক জায়গায় যাত্রা হচ্ছিল, সেই জায়গায় গেল। সন্ধান করে জানতে পারলে যে এখানে কেউ প্যালা দেবে না। ভারী ভিড় হয়েছে। সে দুই হাতে কুনুই দিয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে আসরে গিয়ে উপস্থিত। আসরে ভাল করে বসে গোঁপে চাড়া দিয়ে শুনতে লাগল। (হাস্য)
“আর তোমার তো ছেলেপুলে নাই যে মন অন্যমনস্ক হবে। একজন ডেপুটি, আটশো টাকা মাইনে, কেশব সেনের বাড়িতে (নববৃন্দাবন) নাটক দেখতে গিছল। আমিও গিছলাম, আমার সঙ্গে রাখাল আরও কেউ কেউ গিছল। নাটক শুনবার জন্য আমি – যেখানে বসেছি তারা আমার পাশে বসেছে। রাখাল তখন একটু উঠে গিছল। ডেপুটি এসে ওইখানে বসল। আর তার ছোট ছেলেটিকে রাখালের জায়গায় বসালে। আমি বললুম, এখানে বসা হবে না, – আমার এমনি অবস্থা যে, কাছে যে বসবে সে যা বলবে তাই করতে হবে, তাই রাখালকে কাছে বসিয়েছিলাম। যতক্ষণ নাটক হল ডেপুটির কেবল ছেলের সঙ্গে কথা। শালা একবারও কি থিয়েটার দেখলে না! আবার শুনেছি নাকি মাগের দাস – ওঠ বললে ওঠে, বোস বললে বসে, – আবার একটা খাঁদা বানুরে ছেলের জন্য এই … তুমি ধ্যান-ট্যান তো কর?”
মহেন্দ্র – আজ্ঞে, একটু একটু হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ – যাবে এক-একবার?
মহেন্দ্র (সহাস্যে) – আজ্ঞে, কোথায় গাঁট-টাঁট আছে আপনি জানেন, – আপনি দেখবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – আগে যেও। – তবে তো টিপে-টুপে দেখব, কোথায় কি গাঁটি আছে! যাও না কেন?
মহেন্দ্র – কাজকর্মের ভিড়ে আসতে পারি না, – আবার কেদেটির বাড়ি মাঝে মাঝে দেখতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া, মহেন্দ্রের প্রতি) – এদের কি বাড়ি ঘর-দোর নাই? আর কাজকর্ম নাই? এরা আসে কেমন করে?
[পরিবারের বন্ধন ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (হরির প্রতি) – তুই কেন আসিস নাই? তোর পরিবার এসেছে বুঝি?
হরি – আজ্ঞা, না।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তবে কেন ভুলে গেলি?
হরি – আজ্ঞা, অসুখ করেছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের) – কাহিল হয়ে গেছে, – ওর ভক্তি তো কম নয়, ভক্তির চোট দেখে কে! উৎপেতে ভক্তি। (হাস্য)
ঠাকুর একটি ভক্তের পরিবারকে ‘হাবীর মা’ বলতেন। হাবীর মার ভাই আসিয়াছে, কলেজে পড়ে, বয়স আন্দাজ কুড়ি। তিনি ব্যাট খেলিতে যাইবেন, – গাত্রোত্থান করিলেন। ছোট ভাইও ঠাকুরের ভক্ত, সেই সঙ্গে গমন করিলেন। কিয়ৎ পরে দ্বিজ ফিরিয়া আসিলে ঠাকুর বলিলেন, “তুই গেলিনি?”
একজন ভক্ত বলিলেন, “উনি গান শুনিবেন তাই বুঝি ফিরে এলেন।”
আজ ব্রাহ্মভক্ত শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্যের গান হইবে। পল্টু আসিয়া উপস্থিত। ঠাকুর বলিতেছেন, কে রে, – পল্টু যে রে!
আর একটি ছোকরা ভক্ত (পূর্ণ) আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর তাঁহাকে অনেক কষ্টে ডাকাইয়া আনিয়াছেন, বাড়ির লোকেরা কোনও মতে আসিতে দিবেন না। মাস্টার যে বিদ্যালয়ে পড়ান সেই বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে এই ছেলেটি পড়েন। ছেলেটি আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রনাম করিলেন। ঠাকুর নিজের কাছে তাহাকে বসাইয়া আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন – মাস্টার শুধু কাছে বসিয়া আছেন, অন্যান্য ভক্তেরা অন্যমনস্ক হইয়া আছেন। গিরিশ এক পাশে বসিয়া কেশবচরিত পড়িতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ছোকরা ভক্তটির প্রতি) – এখানে এস।
গিরিশ (মাস্টারের প্রতি) – কে এ ছেলেটি?
মাস্টার (বিরক্ত হইয়া) – ছেলে আর কে?
গিরিশ (সহাস্যে) – It needs no ghost to tell me that.
মাস্টারের ভয় হইয়াছে পাছে পাঁচজন জানিতে পারিলে ছেলের বাড়িতে গোলযোগ হয় আর তাঁহার নামে দোষ হয়। ছেলেটির সঙ্গে ঠাকুরও সেইজন্য আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – সে সব কর? – যা বলে দিছিলাম?
ছেলেটি – আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ – স্বপনে কিছু দেখ? – আগুন-শিখা, মশালের আলো? সধবা মেয়ে? – শ্মশান-মশান? এ-সব দেখা বড় ভাল।
ছেলেটি – আপনাকে দেখেছি – বসে আছেন – কি বলছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কি – উপদেশ? – কই, একটা বল দেখি।
ছেলেটি – মনে নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ – তা হোক, – ও খুব ভাল! – তোমার উন্নতি হবে – আমার উপর তো টান আছে?
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর বলিতেছেন – “কই সেখানে যাবে না?” – অর্থাৎ দক্ষিণেশ্বরে। ছেলেটি বলিতেছে, “তা বলতে পারি না।”
শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন, সেখানে তোমার আত্মীয় কে আছে না?
ছেলেটি – আজ্ঞা হাঁ, কিন্তু সেখানে যাবার সুবিধা হবে না।
গিরিশ কেশবচরিত পড়িতেছেন। ব্রাহ্মসমাজের শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্য শ্রীযুক্ত কেশব সেনের ওই জীবনচরিত লিখিয়াছেন। ওই পুস্তকে লেখা আছে যে পরমহংসদেব আগে সংসারের উপর বড় বিরক্ত ছিলেন, কিন্তু কেশবের সহিত দেখাশুনা হবার পরে তিনি মত বদলাইয়াছেন – এখন পরমহংসদেব বলেন যে, সংসারেও ধর্ম হয়। এই কথা পড়িয়া কোন কোন ভক্তরা ঠাকুরকে বলিয়াছেন। ভক্তদের ইচ্ছা যে, ত্রৈলোক্যের সঙ্গে আজ এই বিষয় লইয়া কথা হয়। ঠাকুরকে বই পড়িয়া ওই সকল কথা শোনান হইয়াছিল।
[ঠাকুরের অবস্থা – ভক্তসঙ্গ ত্যাগ ]
গিরিশের হাতে বই দেখিয়া ঠাকুর গিরিশ, মাস্টার, রাম ও অন্যান্য ভক্তদের বলিতেছেন – “ওরা ওই নিয়ে আছে, তাই ‘সংসার সংসার’ করছে! – কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর রয়েছে। তাঁকে লাভ করলে ও কথা বলে না। ঈশ্বরের আনন্দ পেলে সংসার কাকবিষ্ঠা হয়ে যায়, – আবার মাঝে ভক্তসঙ্গ-ফঙ্গও ত্যাগ করেছিলাম! দেখলুম পট্ পট্ মরে যায়, আর শুনে ছট্ফট্ করি! এখন তবু একটু লোক নিয়ে থাকি।”