১৮৮৭, ২৫শে মার্চ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম মঠ – নরেন্দ্রাদি ভক্তের বৈরাগ্য ও সাধন
বরাহনগরের মঠ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অদর্শনের পর নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা একত্র হইয়াছেন। সুরেন্দ্রের সাধু ইচ্ছায় বরাহনগরে তাঁহাদের থাকিবার একটি বাসস্থান হইয়াছে। সেই স্থান আজি মঠে পরিণত। ঠাকুরঘরে গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নিত্যসেবা। নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা বলিলেন, আর সংসারে ফিরিব না, তিনি যে কামিণী-কাঞ্চন ত্যাগ করিতে বলিয়াছেন, আমরা কি করে আর বাড়িতে ফিরিয়া যাই!
শশী নিত্যপূজার ভার লইয়াছেন। নরেন্দ্র ভাইদের তত্ত্বাবধান করিতেছেন। ভাইরাও তাঁহার মুখ চাহিয়া থাকেন। নরেন্দ্র বলিলেন সাধন করিতে হইবে, তাহা না হইলে ভগবানকে পাওয়া যাইবে না। তিনি নিজে ও ভাইরাও নানাবিধ সাধন আরম্ভ করিলেন। বেদ, পুরাণ ও তন্ত্রমতে মনের খেদ মিটাইবার জন্য অনেক প্রকার সাধনের প্রবৃত্ত হইলেন। কখনও কখনও নির্জনে বৃক্ষতলে, কখনও একাকী শ্মশানমধ্যে, কখনও গঙ্গাতীরে সাধন করেন।
মঠের মধ্যে কখনও বা ধ্যানের ঘরে একাকী জপ-ধ্যানে দিন যাপন করেন। আবার কখনও ভাইদের সঙ্গে একত্র মিলিত হইয়া সংকীর্তনানন্দে নৃত্য করিতে থাকেন। সকলেই, বিশেষতঃ নরেন্দ্র, ঈশ্বরলাভের জন্য ব্যাকুল। কখনও বলেন প্রায়োপবেশন কি করিব? কি উপায়ে তাঁহাকে লাভ করিব?
লাটু, তারক ও বুড়োগোপাল ইঁহাদের থাকিবার স্থান নাই, এঁদের নাম করিয়াই সুরেন্দ্র প্রথম মঠ করেন। সুরেন্দ্র বলিলেন, “ভাই! তোমরা এই স্থানে ঠাকুরের গদি লইয়া থাকিবে, আর আমরা সকলে মাঝে মাঝে এখানে জুড়াইতে আসিব।” দেখিতে দেখিতে কৌমারবৈরাগ্যবান ভক্তেরা যাতায়াত করিতে করিতে আর বাড়িতে ফিরিলেন না। নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, বাবুরাম, শরৎ, শশী, কালী রহিয়া গেলেন। কিছুদিন পরে সুবোধ ও প্রসন্ন আসিলেন।
যোগীন ও লাটু বৃন্দাবনে ছিলেন, একবৎসর পরে আসিয়া জুটিলেন। গঙ্গাধর সর্বদাই মঠে যাতায়াত করিতেন। নরেন্দ্রকে না দেখিলে তিনি থাকিতে পারিতেন না। তিনি “জয় শিব ওঙ্কারঃ” এই আরতির স্তব আনিয়া দেন। মঠের ভাইরা “বা গুরুজী কি ফতে” এই জয়জয়কার ধ্বনি যে মাঝে মাঝে করিতেন, তাহাও গঙ্গাধর শিখাইয়াছিলেন। তিব্বত হইতে ফিরিবার পর তিনি মঠে রহিয়া গিয়াছিলেন। ঠাকুরের আর দুটি ভক্ত হরি ও তুলসী, নরেন্দ্র ও তাঁহার মঠের ভাইদের সর্বদা দর্শন করিতে আসিতেন। কিছুদিন পরে অবশেষে তাঁহারা মঠে থাকিয়া যান।
[নরেন্দ্রের পূর্বকথা ও শ্রীরামকৃষ্ণের ভালবাসা ]
আজ শুক্রবার, ২৫শে মার্চ, ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দ (১২ই চৈত্র, ১২৯৩, শুক্লা প্রতিপদ) – মাস্টার মঠের ভাইদের দর্শন করিতে আসিয়াছেন। দেবেন্দ্রও আসিয়াছেন। মাস্টার প্রায় দর্শন করিতে আসেন ও কখন কখন থাকিয়া যান। গত শনিবারে আসিয়া শনি, রবি ও সোম – তিনদিন ছিলেন। মঠের ভাইদের, বিশেষতঃ নরেন্দ্রের, এখন তীব্র বৈরাগ্য। তাই তিনি উৎসুক হইয়া সর্বদা তাঁহাদের দেখিতে আসেন।
রাত্রি হইয়াছে। আজ রাত্রে মাস্টার থাকিবেন।
সন্ধ্যার পর শশী মধুর নাম করিতে করিতে ঠাকুরঘরে আলো জ্বালিলেন ও ধুনা দিলেন। সেই ধুনা লইয়া যত ঘরের পট আছে, প্রত্যেকের কাছে গিয়া প্রণাম করিতেছেন।
এইবার আরতি হইতেছে। শশী আরতি করিতেছেন। মঠের ভাইরা, মাস্টার ও দেবেন্দ্র সকলে হাতজোড় করিয়া আরতি দেখিতেছেন ও সঙ্গে সঙ্গে আরতির স্তব গাইতেছেন – “জয় শিব ওঙ্কার। ভজ শিব ওঙ্কার। ব্রহ্মা বিষ্ণু সদাশিব! হর হর হর মহাদেব!!”
নরেন্দ্র ও মাস্টার দুইজনে কহিতেছেন। নরেন্দ্র ঠাকুরের কাছে যাওয়া অবধি অনেক পূর্বকথা মাস্টারের কাছে বলিতেছেন। নরেন্দ্রের এখন বয়স ২৪ বৎসর ২ মাস হইবে।
নরেন্দ্র – প্রথম প্রথম যখন যাই, তখন একদিন ভাবে বললেন, ‘তুই এসেছিস!’
“আমি বাবলাম, ‘কি আশ্চর্য! ইনি যেন আমায় অনেকদিন থেকে চেনেন।’ তারপর বললেন, ‘তুই কি একটা জ্যোতি দেখতে পাস?’
“আমি বললাম, আজ্ঞে হাঁ। ঘুমাবার আগে কপালের কাছে কি যেন একটি জ্যোতি ঘুরতে থাকে।”
মাস্টার – এখনও কি দেখ?
নরেন্দ্র – আগে খুব দেখতাম। যদু মল্লিকের রান্নাবড়িতে একদিন আমায় স্পর্শ করে কি মনে মনে বললেন, আমি অজ্ঞান হয়ে গেলুম! সেই নেশায় অমন একমাস ছিলুম!
“আমার বিবাহ হবে শুনে মা-কালীর পা ধরে কেঁদেছিলেন। কেঁদে বলেছিলেন, ‘মা ও-সব ঘুরিয়ে দে মা। নরেন্দ্র যেন ডুবে না!’
“যখন বাবা মারা গেলেন, মা-ভাইরা খেতে পাচ্ছে না, তখন একদিন অন্নদা গুহর সঙ্গে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল।
“তিনি অন্নদা গুহকে বললেন, ‘নরেন্দ্রের বাবা মারা গেছে, ওদের বড় কষ্ট, এখন বন্ধুবান্ধবরা সাহাজ্য করে তো বেশ হয়।’
“অন্নদা গুহ চলে গেলে আমি তাঁকে বকতে লাগলাম। বললাম, কেন আপনি ওর কাছে ও-সব কথা বললেন? তিনি তিরস্কৃত হয়ে কাঁদতে লাগলেন ও বললেন, ‘ওরে তোর জন্য যে আমি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে পারি!’
“তিনি ভালবেসে আমাদের বশীভূত করেছিলেন। আপনি কি বলেন?”
মাস্টার – অণুমাত্র সন্দেহ নাই। ওঁর অহেতুক ভালবাসা।
নরেন্দ্র – আমায় একদিন একলা একটি কথা বললেন। আর কেহ ছিল না। এ-কথা আপনি (আমাদের ভিতরে) আর কারুকে বলবেন না।
মাস্টার – না, কি বলেছিলেন?
নরেন্দ্র – তিনি বললেন, আমার তো সিদ্ধাই করবার জো নাই। তোর ভিতর দিয়ে করব, কি বলিস? আমি বললাম – ‘না, তা হবে না।’
“ওঁর কথা উড়িয়ে দিতাম, – ওঁর কাছে শুনেছেন। ঈশ্বরের রূপদর্শন করেন, এ বিষয়ে আমি বলেছিলাম, ‘ও-সব মনের ভুল।’
“তিনি বললেন, ওরে, আমি কুঠির উপর চেঁচিয়ে বলতাম, ওরে কোথায় কে ভক্ত আছিস আয়, – তোদের না দেখে আমার প্রাণ যায়! মা বলেছিলেন, ভক্তেরা সব আসবে, – তা দেখ, সব তো মিলছে!
“আমি তখন আর কি বলব, চুপ করে রইলাম।”
[নরেন্দ্রের অখণ্ডের ঘর – নরেন্দ্রের অহংকার ]
“একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবেন্দ্রবাবু ও গিরিশবাবুকে আমার বিষয় বলেছিলেন, ‘ওর ঘর বলে দিলে ও দেহ রাখবে না।’ ”
মাস্টার – হাঁ, শুনেছি। আর আমাদের কাছেও অনেকবার বলেছিলেন। কাশীপুরে থাকতে তোমার একবার সে অবস্থা হয়েছিল, না?
নরেন্দ্র – সেই অবস্থায় বোধ হল যে, আমার শরীর নাই, শুধু মুখটি দেখতে পাচ্ছি। ঠাকুর উপরের ঘরে ছিলেন। আমার নিচে ওই অবস্থাটি হল! আমি সেই অবস্থাতে কাঁদতে লাগলাম। বলতে লাগলাম আমার কি হল! বুড়োগোপাল উপরে গিয়ে ঠাকুরকে বললেন, ‘নরেন্দ্র কাঁদছে।’
“তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, তিনি বললেন, ‘এখন টের পেলি, চাবি আমার কাছে রইল!’ – আমি বললাম, ‘আমার কি হল!’
“তিনি অন্য ভক্তদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ও আপনাকে জানতে পারলে, দেহ রাখবে না; আমি ভুলিয়ে রেখেছি।’
“একদিন বলেছিলেন, তুই যদি মনে করিস কৃষ্ণকে হৃদয়মধ্যে দেখতে পাস। আমি বললাম, আমি কিষ্টফিষ্ট মানি না। (মাস্টার ও নরেন্দ্রের হাস্য)
“আর একটা দেখেছি, এক-একটি জায়গা, জিনিস বা মানুষ দেখলে, বোধ হয় যেন আগে জন্মান্তরে দেখেছি। যেন চেনা চেনা! আমহার্স্ট্ স্ট্রীট-এ যখন শরতের বাড়িতে গেলাম, শরতকে একবার বললাম, ওই বাড়ি যেন আমার সব জানা! বাড়ির ভিতরের পথগুলি, ঘরগুলি, যেন অনেক দিনের চেনা চেনা।
“আমি নিজের মতো কাজ করতাম, তিনি (ঠাকুর) কিছু বলতেন না। আমি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মেম্বার হয়েছিলাম, জানেন তো?”
মাস্টার – হাঁ, তা জানি।
নরেন্দ্র – তিনি জানতেন, ওখানে মেয়েমানুষেরা যায়। মেয়েদের সামনে রেখে ধ্যান করা যায় না, তাই নিন্দা করতেন। আমায় কিন্তু কিছু বলতেন না! একদিন শুধু বললেন, রাখালকে ও-সনব কথা কিছু বলিস নি – যে তুই সমাজের মেম্বার হয়েছিস। ওরও, তাহলে হতে ইচ্ছা যাবে।
মাস্টার – তোমার বেশি মনের জোর, তাই তোমায় বারণ করেন নাই।
নরেন্দ্র – অনেক দুঃখকষ্ট পেয়ে তবে এই অবস্থা হয়েছে। মাস্টার মশাই, আপনি দুঃখকষ্ট পান নাই তাই, – মানি দুঃখকষ্ট না পেলে Resignation (ঈশ্বরে সমস্ত সমর্পণ) হয় না – Absolute Dependence on God.
“আচ্ছা … এত নম্র ও নিরহংকার; কত বিনয়! আমায় বলতে পারেন, আমার কিসে বিনয় হয়?”
মাস্টার – তিনি বলেছেন, তোমার অহংকার সম্বন্ধে, – এ ‘অহং’ কার?
নরেন্দ্র – এর মানে কি?
মাস্টার – অর্থাৎ রাধিকাকে একজন সখী বলছেন, তোর অহংকার হয়েছে – তাই কৃষ্ণকে অপমান করলি। আর এক সখী উত্তর দিছিল, হাঁ, অহংকার শ্রীমতীর হয়েছিল বটে, কিন্তু এ অহং কার? অর্থাৎ কৃষ্ণ আমার পতি – এই অহংকার, – কৃষ্ণই এ ‘অহং’ রেখে দিয়েছিলেন। ঠাকুরের কথার মানে এই, ঈশ্বরই এই অহংকার তোমার ভিতরে রেখে দিয়েছেন, অনেক কাজ করিয়ে নেবেন এই জন্য!
নরেন্দ্র – কিন্তু আমি হাঁকডেকে বোলে আমার দুঃখ নাই!
মাস্টার (সহাস্যে) – তবে সখ করে হাঁকডাক করো। (উভয়ের হাস্য)
এইবার অন্য অন্য ভক্তদের কথা পড়িল – বিজয় গোস্বামীর প্রভৃতির।
নরেন্দ্র – তিনি বিজয় গোস্বামীর কথা বলেছিলেন, ‘দ্বারে ঘা দিচ্ছে।’
মাস্টার – অর্থাৎ ঘরের ভিতর এখনও প্রবেশ করিতে পারেন নাই।
“কিন্তু শ্যামপুকুর বাটীতে বিজয় গোস্বামী ঠাকুরকে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে ঢাকাতে এই আকারে দর্শন করেছি, এই শরীরে।’ তুমিও সেইখানে উপস্থিত ছিলে।
নরেন্দ্র – দেবেন্দ্রবাবু, রামবাবু এরা সব সংসারত্যাগ করবে – খুব চেষ্টা করছে। রামবাবু, Privately বলেছে, দুই বছর পরে ত্যাগ করবে।
মাস্টার – দুই বছর পরে? মেয়েছেলেদের বন্দোবস্ত হলে বুঝি?
নরেন্দ্র – আর ও বাড়িটা ভাড়া দেবে। আর একটা ছোট বাড়ি কিনবে। মেয়ের বিয়ে-টিয়ে ওরা বুঝবে।
মাস্টার – গোপালের বেশ অবস্থা, না?
নরেন্দ্র – কি অবস্থা!
মাস্টার – এত ভাব, হরিনামে অশ্রু, রোমাঞ্চ!
নরেন্দ্র – ভাব হলেই কি বড় লোক হয়ে গেল!
কালী, শরৎ, শশী সারদা এরা – গোপালের চেয়ে কত বড়লোক! এদের ত্যাগ কত! গোপাল তাঁকে (ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে) মানে কই?”
মাস্টার – তিনি বলেছিলেন বটে, ও এখানকার লোক নয়। তবে ঠাকুরকে তো খুব ভক্তি করতেন দেখেছি।
নরেন্দ্র – কি দেখেছেন?
মাস্টার – যখন প্রথম প্রথম দক্ষিণেশ্বরে যাই, ঠাকুরের ঘরে ভক্তদের দরবার ভেঙে গেলে পর, ঘরের বাহিরে এসে একদিন দেখলাম – গোপাল হাঁটু গেড়ে বাগানের লাল সুরকির পথে হাতজোড় করে আছেন – ঠাকুর সেইখানে দাঁড়িয়ে। খুব চাঁদের আলো। ঠাকুরের ঘরের ঠিক উত্তরে যে বারান্দাটি আছে তারই ঠিক উত্তর গায়ে লাল সুরকির রাস্তা। সেখানে আর কেউ ছিল না। বোধ হল যেন – গোপাল শরণাগত হয়েছেন ও ঠাকুর আশ্বাস দিচ্ছেন।
নরেন্দ্র – আমি দেখি নাই।
মাস্টার – আর মাঝে মাঝে বলতেন, ‘ওর পরমহংস অবস্থা।’ তবে এও বেশ মনে আছে, ঠাকুর তাঁকে মেয়ে মানুষ ভক্তদের কাছে আনাগোনা করতে বারণ করেছিলেন। অনেকবার সাবধান করে দিছলেন।
নরেন্দ্র – আর তিনি আমার কছে বলেছেন, – ওর যদি পরমহংস অবস্থা তবে টাকা কেন! আর বলেছেন, ‘ও এখানকার লোক নয়। যারা আমার আপনার লোক তারা এখানে সর্বদা আসবে।’
“তাইত – বাবুর উপর তিনি রাগ করতেন। সে সর্বদা সঙ্গে থাকত বলে, আর ঠাকুরের কাছে বেশি আসত না।
“আমায় বলেছিলেন – ‘গোপাল সিদ্ধ – হঠাৎ সিদ্ধ; ও এখানকার লোক নয়। যদি আপনার হত, ওকে দেখবার জন্য আমি কাঁদি নাই কেন?’
“কেউ কেউ ওঁকে নিত্যানন্দ বলে খাড়া করেছেন। কিন্তু তিনি (ঠাকুর) কতবার বলেছেন, ‘আমিই অদ্বৈত-চৈতন্য-নিত্যানন্দ একাধারে তিন।’ ”