১৮৮৭, ৭ই মে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তহৃদয়ে
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম মঠ ও নরেন্দ্রাদির সাধনা ও তীব্র বৈরাগ্য
আজ বৈশাখী পূর্ণিমা (২৫শে বৈশাখ, ১২৯৪)। ৭ই মে, ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দ। শনিবার অপরাহ্ন। নরেন্দ্র মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন। কলিকাতা গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে, একটি বাড়ির নিচের ঘরে, তক্তপোশের উপর উভয়ে বসিয়া আছেন।
মণি সেই ঘরে পড়াশুনা করেন। Merchant of Venice, Comus, Blackie’s self-culture এই সব বই পড়িতেছেন। পড়া তৈয়ার করিতেছেন। স্কুলে পড়াইতে হইবে।
কয়মাস হইল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের অকূল পাথারে ভাসাইয়া স্বধামে চলিয়া গিয়াছেন। অবিবাহিত ও বিবাহিত ভক্তেরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেবাকালে যে স্নেহসূত্রে বাঁধা হইয়াছেন তাহা আর ছিন্ন হইবার নহে। হঠাৎ কর্ণধারের অদর্শনে আরোহিগণ ভয় পাইয়াছেন বটে, কিন্তু সকলেই যে এক প্রাণ, পরস্পরের মুখ চাহিয়া রহিয়াছেন। এখন পরস্পরকে না দেখিলে আর তাঁহারা বাঁচেন না। অন্য লোকের সঙ্গে আলাপ আর ভাল লাগে না।
তাঁহার কথা বই আর কিছু ভাল লাগে না। সকলে ভাবেন তাঁকে কি আর দেখতে পাব না? তিনি তো বলে গেছেন, ব্যাকুল হয়ে ডাকলে আন্তরিক ডাক শুনলে ঈশ্বর দেখা দেবেন। বলে গেছেন, আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। যখন নির্জনে থাকেন, তখন সেই আনন্দময় মূর্তি মনে পড়ে। রাস্তায় চলেন, উদ্দেশ্যহীন, একাকী কেঁদে কেঁদে বেড়ান। ঠাকুর তাই বুঝি মণিকে বলেছিলেন,
‘তোমরা রাস্তায় কেঁদে কেঁদে বেড়াবে, তাই শরীরত্যাগ করতে একটু কষ্ট হচ্ছে!’ কেউ ভাবছেন, কই তিনি চলে গেলেন, আমি এখনও বেঁচে রইছি। এই অনিত্য সংসারে এখনও থাকতে ইচ্ছা! নিজে মনে করলে তো শরীরত্যাগ করতে পারি, তা কই করছি!
ছোকরা ভক্তেরা কাশীপুরের বাগানে থাকিয়া রাত্রিদিন সেবা করিয়াছিলেন। তাঁহার অদর্শনের পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও কলের পুত্তলিকার ন্যায় নিজের নিজের বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। ঠাকুর কাহাকেও সন্ন্যাসীর বাহ্য চিহ্ন (গেরুয়া বস্ত্র ইত্যাদি) ধারণ করিতে অথবা গৃহীর উপাধি ত্যাগ করিতে অনুরোধ করেন নাই। তাঁহারা লোকের কাছে দত্ত, ঘোষ, চক্রবর্তী, ঘোষাল ইত্যাদি উপাধিযুক্ত হইয়া পরিচয়, ঠাকুরের অদর্শনের পরও কিছুদিন দিয়াছিলেন। কিন্তু ঠাকুর তাঁহাদের অন্তরে ত্যাগী করিয়া গিয়াছিলেন।
দু-তিন জনের ফিরিয়া যাইবার বাড়ি ছিল না; সুরেন্দ্র তাঁহাদের বলিলেন, ভাই তোমরা আর কোথা যাবে; একটা বাসা করা যাক। তোমরাও থাকবে আর আমাদেরও জুড়াবার একটা স্থান চাই; তা না হলে সংসারে এরকম রাতদিন কেমন করে থাকব। সেইখানে তোমরা গিয়ে থাক। আমি কাশীপুরের বাগানে ঠাকুরের সেবার জন্য যৎকিঞ্চিৎ দিতাম। এক্ষণে তাহাতে বাসা খরচা চলিবে। সুরেন্দ্র প্রথম প্রথম দুই-একমাস টাকা ত্রিশ করিয়া দিতেন।
ক্রমে যেমন মঠে অন্যান্য ভাইরা যোগ দিতে লাগিলেন, পঞ্চাশ-ষাট করিয়া দিতে লাগিলেন। শেষে ১০০ টাকা পর্যন্ত দিতেন। বরাহনগরে যে বাড়ি লওয়া হইল, তাহার ভাড়া ও ট্যাক্স ১১ টাকা। পাচক ব্রাহ্মণের মাহিয়ানা ৬৲ টাকা, আর বাকী ডালভাতের খরচ। বুড়ো গোপাল, লাটু ও তারকের বাড়ি নাই। ছোট গোপাল প্রথমে কাশীপুরের বাগান হইতে ঠাকুরের গদি ও জিনিসপত্র লইয়া সেই বাসা বাড়িতে গেলেন।
সঙ্গে পাচক ব্রাহ্মণ শশী। রাত্রে শরৎ আসিয়া থাকিলেন। তারক বৃন্দাবন গিয়াছিলেন। কালী একমাসের মধ্যে, রাখাল কয়েক মাস পরে, যোগীন একবৎসর পরে ফিরিলেন।
কিছুদিনের মধ্যে নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, শরৎ, শশী, বাবুরাম, যোগীন, কালী, লাটু রহিয়া গেলেন আর বাড়িতে ফিরিলেন না। ক্রমে প্রসন্ন ও সুবোধ আসিয়া রহিলেন। গঙ্গাধর ও হরিও পরে আসিয়া জুটিলেন।
ধন্য সুরেন্দ্র! এই প্রথম মঠ তোমারি হাতে গড়া! তোমার সাধু ইচ্ছায় এই আশ্রম হইল! তোমাকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার মূলমন্ত্র কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ মূর্তিমান করিলেন। কৌমারবৈরাগ্যেবান শুদ্ধাত্মা নরেন্দ্রাদি ভক্তের দ্বারা আবার সনাতন হিন্দু ধর্মকে জীবের সম্মুখে প্রকাশ করিলেন। ভাই, তোমার ঋণ কে ভুলিবে? মঠের ভাইরা মাতৃহীন বালকের ন্যায় থাকিতেন – তোমার অপেক্ষা করিতেন, তুমি কখন আসিবে।
আজ বাড়ি-ভাড়া দিতে সব টাকা গিয়াছে – আজ খাবার কিছু নাই – কখন তুমি আসিবে – আসিয়া ভাইদের খাবার বন্দোবস্ত করিয়া দিবে! তোমার অকৃত্রিম স্নেহ স্মরণ করিলে কে না অশ্রুবারি বিসর্জন করিবে।
[নরেন্দ্রাদির ঈশ্বর জন্য ব্যাকুলতা ও প্রায়োপবেশন-প্রসঙ্গ ]
কলিকাতার সেই নিচের ঘরে নরেন্দ্র মণির সহিত কথা কহিতেছেন। নরেন্দ্র এখন ভক্তদের নেতা। মঠের সকলের অন্তরে তীব্র বৈরাগ্য। ভগবান দর্শন জন্য সকলে ছটফট করিতেছেন।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি) – আমার কিছু ভাল লাগছে না। এই আপনার সঙ্গে কথা কচ্ছি, ইচ্ছা হয় এখনি উঠে যাই।
নরেন্দ্র কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে আবার বলিতেছেন – প্রায়োপবেশন করব?
মণি – তা বেশ! ভগাবনের জন্য সবই তো করা যায়।
নরেন্দ্র – যদি খিদে সামলাতে না পারি?
মণি – তাহলে খেয়ো, আবার লাগতে হবে।
নরেন্দ্র আবার কিয়ৎক্ষণ চুপ করিলেন।
নরেন্দ্র – ভগবান নাই বোধ হচ্ছে! যত প্রার্থনা করছি, একবারও জবাব পাই নাই।
“কত দেখলাম মন্ত্র সোনার অক্ষরে জ্বল জ্বল করছে!
“কত কালীরূপ; আরও অন্যান্য রূপ দেখলুম! তবু শান্তি হচ্ছে না।
“ছয়টা পয়সা দেবেন?”
নরেন্দ্র শোভাবাজার হইতে শেয়ারের গাড়িতে বরাহনগরের মাঠে যাইতেছেন, তাই ছয়টা পয়সা।
দেখিতে দেখিতে সাতু (সাতকড়ি) গাড়ি করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সাতু নরেন্দ্রের সমবয়স্ক। মঠের ছোকরাদের বড় ভালবাসেন ও সর্বদা মঠে যান। তাঁহার বাড়ি বরাহনগরের মঠের কাছে। কলিকাতার আফিসে কর্ম করেন। তাঁদের ঘরের গাড়ি আছে। সেই গাড়ি করিয়া আফিস হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
নরেন্দ্র মণিকে পয়সা ফিরাইয়া দিলেন, বলিলেন, আর কি, সাতুর সঙ্গে যাব। আপনি কিছু খাওয়ান। মণি কিছু জলখাবার খাওয়ালেন।
মণিও সেই গাড়িতে উঠিলেন, তাহাদের সঙ্গে মঠে যাইবেন। সন্ধ্যার সময় সকলে মঠে পৌঁছিলেন। মঠের ভাইরা কিরূপে দিন কাটাইতেছেন ও সাধনা করিতেছেন, মণি দেখিবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদদের হৃদয়ে কিরূপ প্রতিবিম্বিত হইতেছেন, তাহা দেখিতে মণি মাঝে মাঝে মঠ দর্শন করিতে যান। মঠে নিরঞ্জন নাই। তাঁহার একমাত্র মা আছেন; তাঁহাকে দেখিতে বাড়ি গিয়াছেন। বাবুরাম, শরৎ, কালী, ৺পুরীক্ষেত্রে গিয়াছেন। সেখানে আরও কিছুদিন থাকিয়া শ্রীশ্রীরথযাত্রা দর্শন করিবেন।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বিদ্যার সংসার ও নরেন্দ্রের তত্ত্বাবধান ]
নরেন্দ্র মঠের ভাইদের তত্ত্বাবধান করিতেছেন। প্রসন্ন কয়দিন সাধন করিতেছিলেন। নরেন্দ্র তাঁহার কাছেও প্রায়োপবেশনের কথা তুলিয়াছিলেন। নরেন্দ্র কলিকাতায় গিয়াছেন দেখিয়া সেই অবসরে তিনি কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়া চলিয়া গিয়াছেন। নরেন্দ্র আসিয়া সমস্ত শুনিলেন। রাজা কেন তাহাকে যাইতে দিয়াছেন? কিন্তু রাখাল ছিলেন না। তিনি মঠ হইতে দক্ষিণেশ্বরে বাগানে একটু বেড়াইতে গিয়াছিলেন। রাখালকে সকলে রাজা বলিয়া ডাকিতেন। অর্থাৎ ‘রাখালরাজ’ শ্রীকৃষ্ণের আর একটি নাম।
নরেন্দ্র – রাজা আসুক, একবার বকব! কেন তারে যেতে দিলে? (হরিশের প্রতি) – তুমি তো পা ফাঁক করে লেকচার দিচ্ছিলে; তাকে বারণ করতে পার নাই।
হরিশ (অতি মৃদুস্বরে) – তারকদা বলেছিলেন, তবু সে চলে গেল।
নরেন্দ্র (মাস্টারের প্রতি) – দেখুন আমার বিষম মুশকিল। এখানেও এক মায়ার সংসারে পড়েছি। আবার ছোঁড়াটা কোথায় গেল।
রাখাল দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়াছেন। ভবনাথ তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।
রাখালকে নরেন্দ্র প্রসন্নের কথা বলিলেন। প্রসন্ন নরেন্দ্রকে একখানা পত্র লিখিয়াছেন; সেই পত্র পড়া হইতেছে। পত্র এই মর্মে লিখিয়াছেন, “আমি হাঁটিয়া বৃন্দাবনে চলিলাম। এখানে থাকা আমার পক্ষে বিপদ। এখানে ভাবের পরিবর্তন হচ্ছে; আগে বাপ, মা ও বাড়ির সকলের স্বপন দেখতাম। তারপর মায়ার মূর্তি দেখলাম। দুবার খুব কষ্ট পেয়েছি; বাড়িতে ফিরে যেতে হয়েছিল। তাই এবার দূরে যাচ্ছি। পরমহংসদেব আমায় বলেছিলেন, তোর বাড়ির ওরা সব করতে পারে; ওদের বিশ্বাস করিস না।”
রাখাল বলিতেছেন, সে চলে গেছে ওই সব নানা কারণে। আবার বলেছে, ‘নরেন্দ্র প্রায় বাড়ি যায় – মা ও ভাই ভগিনীদের খবর নিতে; আর মোকদ্দমা করতে। ভয় হয়, পাছে তার দেখাদেখি আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছা হয়।’
নরেন্দ্র এই কথা শুনিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
রাখাল তীর্থে যাইবার গল্প করিতেছেন। বলিতেছেন, “এখানে থাকিয়া তো কিছু হল না। তিনি যা বলেছিলেন, ভগবানদর্শন, কই হল” রাখাল শুইয়া আছেন। নিকটে ভক্তেরা কেহ শুইয়া কেহ বসিয়া আছেন।
রাখাল – চল নর্মদায় বেরিয়ে পড়ি।
নরেন্দ্র – বেরিয়ে কি হবে? জ্ঞান কি হয়? তাই জ্ঞান জ্ঞান করছিস?
একজন ভক্ত – তাহলে সংসারত্যাগ করলে কেন?
নরেন্দ্র – রামকে পেলাম না বলে শ্যামের সঙ্গে থাকব – আর ছেলেমেয়ের বাপ হব – এমন কি কথা!
এই বলিয়া নরেন্দ্র একটু উঠিয়া গেলেন। রাখাল শুইয়া আছেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে নরেন্দ্র আবার আসিয়া বসিলেন।
একজন ভাই শুইয়া শুইয়া রহস্যভাবে বলিতেছেন – যেন ঈশ্বরের অদর্শনে বড় কাতর হয়েছেন – “ওরে আমায় একখানা ছুরি এনে দে রে! আর কাজ নাই! আর যন্ত্রণা সহ্য হয় না।”
নরেন্দ্র (গম্ভীরভাবে) – ওইখানেই আছে হাত বাড়িয়ে নে। (সকলের হাস্য)
প্রসন্নের কথা আবার হইতে লাগিল।
নরেন্দ্র – এখানেও মায়া! তবে আর সন্ন্যাস কেন?
রাখাল – ‘মুক্তি ও তাহার সাধন’ সেই বইখানিতে আছে, সন্ন্যাসীদের একসঙ্গে থাকা ভাল নয়। ‘সন্ন্যাসী নগরের’ কথা আছে।
শশী – আমি সন্ন্যাস-ফন্ন্যাস মানি না। আমার অগম্য স্থান নাই। এমন জায়গা নাই যেখানে আমি থাকতে না পারি।
ভবনাথের কথা পড়িল। ভবনাথের স্ত্রীর সঙ্কটাপন্ন পীড়া হইয়াছিল।
নরেন্দ্র (রাখালের প্রতি) – ভবনাথের মাগটা বুঝি বেঁচেছে; তাই সে ফুর্তি করে দক্ষিণেশ্বরে বেড়াতে গিছিল।
কাঁকুড়গাছির বাগানের কথা হইল। রাম মন্দির করিবেন।
নরেন্দ্র (রাখালের প্রতি) – রামবাবু মাস্টার মহাশয়কে একজন ট্রাস্টি (Trustee) করছেন।
মাস্টার (রাখালের প্রতি) – কই, আমি কিছু জানি না।
সন্ধ্যা হইল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে শশী ধুনা দিলেন। অন্যান্য ঘরে যত ঠাকুরের পট ছিল, সেখানে ধুনা দিলেন ও মধুর স্বরে নাম করিতে করিতে প্রণাম করিলেন।
এইবার আরতি হইতেছে। মঠের ভায়েরা ও অন্যান্য ভক্তেরা সকলে করজোড়ে দাঁড়াইয়া আরতি দর্শন করিতেছেন। কাঁসর ঘণ্টা বাজিতেছে। ভক্তেরা সমস্বরে আরতির গান সেই সঙ্গে সঙ্গে গাইতেছেন:
জয় শিব ওঁকার, ভজ শিব ওঁকার।
ব্রহ্মা বিষ্ণু সদা শিব হর হর হর মহাদেব।।
নরেন্দ্র এই গান ধরিয়াছেন। কাশীধামে ৺বিশ্বনাথের সম্মুখে এই গান হয়।
মণি মঠের ভক্তদের দর্শন করিয়া পরম প্রীতিলাভ করিয়াছেন।
মঠে খাওয়া দাওয়া শেষ হইতে ১১টা বাজিল। ভক্তেরা সকলে শয়ন করিলেন। তাঁহারা যত্ন করিয়া মণিকে শয়ন করাইলেন।
রাত্রি দুই প্রহর। মণির নিদ্রা নাই। ভাবিতেছেন, সকলেই রহিয়াছে; সেই অযোধ্যা কেবল রাম নাই। মণি নিঃশব্দে উঠিয়া গেলেন। আজ বৈশাখী পূর্ণিমা। মণি একাকী গঙ্গাপুলিনে বিচরণ করিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা ভাবিতেছেন!
[নরেন্দ্রাদি মঠের ভাইদের বৈরাগ্য ও যোগবাশিষ্ঠ পাঠ –
সংকীর্তনানন্দ ও নৃত্য ]
মাস্টার শনিবারে আসিয়াছেন। বুধবার পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ দিন মঠে থাকিবেন। আজ রবিবার (৮ই মে, ১৮৮৭)। গৃহস্থ ভক্তেরা প্রায় রবিবারে মঠে দর্শন করিতে আসেন। আজকাল যোগবাশিষ্ঠ প্রায় পড়া হয়। মাস্টার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যোগবাশিষ্ঠের কথা কিছু কিছু শুনিয়াছিলেন। দেহবুদ্ধি থাকিতে যোগবাশিষ্ঠের সোঽহম্ ভাব আশ্রয় করিতে ঠাকুর বারণ করিয়াছিলেন। আর বলিয়াছিলেন, সেব্য-সেবকভাবই ভাল। মাস্টার দেখিবেন মঠের ভাইদের সহিত মেলে কি না। যোগবাশিষ্ঠের সম্বন্ধেই কথা পাড়িলেন।
মাস্টার – আচ্ছা, যোগবাশিষ্ঠে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা কিরূপ আছে?
রাখাল – ক্ষুধা, তৃষ্ণা, সুখ, দুঃখ, এ সব মায়া! মনের নাশই উপায়!
মাস্টার – মনের নাশের পর যা থাকে, তাই ব্রহ্ম। কেমন?
রাখাল – হাঁ।
মাস্টার – ঠাকুরও ওই কথা বলতেন। ন্যাংটা তাঁকে ওই কথা বলেছিলেন। আচ্ছা রামকে কি বশিষ্ঠ সংসার করতে বলেছেন, এমন কিছু দেখলে?
রাখাল – কই, এ পর্যন্ত তো পাই নাই। রামকে অবতার বলেই মানছে না।
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে নরেন্দ্র, তারক ও আর-একটি ভক্ত গঙ্গাতীর হইতে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহাদের কোন্নগরে বেড়াইতে যাইবার ইচ্ছা ছিল – নৌকা পাইলেন না। তাঁহারা আসিয়া বসিলেন। যোগবাশিষ্ঠের কথা চলিতে লাগিল।
নরেন্দ্র (মাস্টারের প্রতি) – বেশ সব গল্প আছে। লীলার কথা জানেন?
মাস্টার – হাঁ, যোগবাশিষ্ঠে আছে, একটু একটু দেখেছি। লীলার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছিল।
নরেন্দ্র – হাঁ, আর ইন্দ্র-অহল্যা – সংবাদ? আর বিদুরথ রাজা চণ্ডাল হল?
মাস্টার – হাঁ, মনে পড়ছে।
নরেন্দ্র – বনের বর্ণনাটি কেমন চমৎকার!১
[মঠের ভাইদের প্রত্যহ গঙ্গাস্নান ও গুরুপূজা ]
নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা গঙ্গাস্নান করিতে যাইতেছেন। মাস্টারও স্নান করিবেন। রৌদ্র দেখিয়া মাস্টার ছাতি লইয়াছেন। বরাহনগরনিবাসী শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্রও এই সঙ্গে স্নান করিতে যাইতেছেন। ইনি সদাচারনিষ্ঠ গৃহস্থ ব্রাহ্মণ যুবক। মঠে সর্বদা আসেন। কিছুদিন পূর্বে ইনি বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করিয়াছেন।
মাস্টার (শরতের প্রতি) – ভারী রৌদ্র!
নরেন্দ্র – তাই বল, ছাতিটা লই। (মাস্টারের হাস্য)
ভক্তেরা গামছা স্কন্ধে মঠ হইতে রাস্তা দিয়া পরামাণিক ঘাটের উত্তরের ঘাটে স্নান করিতে যাইতেছেন। সকলে গেরুয়া পরা। আজ ২৬শে বৈশাখ। প্রচণ্ড রৌদ্র।
মাস্টার – (নরেন্দ্রের প্রতি) – সর্দিগর্মি হবার উদ্যোগ!
নরেন্দ্র – আপনাদের শরীরই বৈরাগ্যের প্রতিবন্ধক, না? আপনার, দেবেনবাবুর –
মাস্টার হাসিতে লাগিলেন ও ভাবিতে লাগিলেন, “শুধু কি শরীর?” স্নানান্তে ভক্তেরা মঠে ফিরিলেন ও পা ধুইয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে প্রবেশ করিলেন। প্রণামপূর্বক ঠাকুরের পাদপদ্মে এক এক জন পুষ্পাঞ্জলি দিলেন।
পূজার ঘরে আসিতে নরেন্দ্রের একটু বিলম্ব হইয়াছিল। গুরুমহারাজকে প্রণাম করিয়া ফুল লইতে যান, দেখেন যে পুষ্পপাত্রে ফুল নাই। তখন বলিয়া উঠিলেন, ফুল নাই। পুষ্পপাত্রে দু-একটি বিল্বপত্র ছিল, তাই চন্দনে ডুবাইয়া নিবেদন করিলেন। একবার ঘণ্টাধ্বনি করিলেন। আবার প্রণাম করিয়া দানাদের ঘরে গিয়া বসিলেন।
[দানাদের ঘর, ঠাকুরঘর ও কালী তপস্বীর ঘর ]
মঠের ভাইরা আপনাদের দানা দৈত্য বলিতেন; যে ঘরে সকলে একত্র বসিতেন, সেই ঘরকে ‘দানাদের ঘর’ বলিতেন। যাঁরা নির্জনে ধ্যান, ধারণা ও পাঠাদি করিতেন, সর্বদক্ষিণের ঘরটিতে তাঁহারাই থাকিতেন। দ্বার রুব্ধ করিয়া কালী ওই ঘরে অধিকাংশ সময় থাকিতেন বলিয়া মঠের ভাইরা বলিতেন “কালী তপস্বীর ঘর!” কালী তপস্বীর ঘরের উত্তরেই ঠাকুরঘর। তাহার ইত্তরে ঠাকুরদের নৈবেদ্যের ঘর।
ওই ঘরে দাঁড়াইয়া আরতি দেখা যাইত ও ভক্তেরা আসিয়া ঠাকুর প্রণাম করিতেন। নৈবেদ্যের ঘরের উত্তরে দানাদের ঘর। ঘরটি খুব লম্বা। বাহিরের ভক্তেরা আসিলে এই ঘরেই তাহাদের অভ্যর্থনা করা হইত। দানাদের ঘরের উত্তরে একটি ছোট ঘর। ভাইরা পানের ঘর বলিতেন। এখানে ভক্তেরা আহার করিতেন।
দানাদের ঘরের পূর্বকোণে দালান। উৎসব হইলে এই দালানে খাওয়া দাওয়া হইত। দালানের ঠিক উত্তরে রান্নাঘর।
ঠাকুরঘরে ও কালী তপস্বীর ঘরের পূর্বে বারান্দা। বারান্দার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বরাহনগরের একটি সমিতির লাইব্রেরী ঘর। এ-সমস্ত ঘর দোতলার উপর। কালী তপস্বীর ঘর ও সমিতির লাইব্রেরী ঘরের মাঝখানে একতলা হইতে দোতলায় উঠিবার সিঁড়ি। ভক্তদের আহারের ঘরের উত্তরদিকে দোতলার ছাদে উঠিবার সিঁড়ি; নরেন্দ্রাদি মঠের ভাইরা ওই সিঁড়ি দিয়া সন্ধ্যার সময় মাঝে মাঝে ছাদে উঠিতেন।
সেখানে উপবেশন করিয়া তাঁহারা ঈশ্বর সম্বন্ধে নানা বিষয়ে কথা কহিতেন। কখনও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা; কখনও বা শঙ্করাচার্যের, রামানুজের বা যীশুখ্রীষ্টের কথা; কখনও হিন্দু দর্শনের কথা; কখনও বা ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্রের কথা; বেদ, পুরাণ, তন্ত্রের কথা।
দানাদের ঘরে বসিয়া নরেন্দ্র তাঁহার দেবদুর্লভ কণ্ঠে ভগবানের নাম গুণগান করেন। শরৎ ও অন্যান্য ভাইদের গান শিখাইতেন। কালী বাজনা শিখিতেন। এই ঘরে নরেন্দ্র ভাইদের সঙ্গে কতবার হরিনাম-সংকীর্তনে আনন্দ করিতেন ও আনন্দে একসঙ্গে নৃত্য করিতেন।
[নরেন্দ্র ও ধর্মপ্রচার – ধ্যানযোগ ও কর্মযোগ ]
নরেন্দ্র দানাদের ঘরে বসিয়া আছেন। ভক্তেরা বসিয়া আছেন; চুনিলাল, মাস্টার ও মঠের ভাইরা। ধর্মপ্রচারের কথা পড়িল।
মাস্টার (নরেন্দ্রের প্রতি) – বিদ্যাসাগর বলেন, আমি বেত খাবার ভয়ে ঈশ্বরের কথা কারুকে বলি না।
নরেন্দ্র – বেত খাবার ভয়?
মাস্টার – বিদ্যাসাগর বলেন, মনে কর, মরবার পর আমরা সকলে ঈশ্বরের কাছে গেলুম। মনে কর, কেশব সেনকে, যমদূতেরা ঈশ্বরের কাছে নিয়ে গেল। কেশব সেন অবশ্য সংসারে পাপ-টাপ করেছে। যখন প্রমাণ হল তখন ঈশ্বর হয়তো বলবেন, ওঁকে পঁচিশ বেত মার্! তারপর মনে কর, আমাকে নিয়ে গেল। আমি হয়তো কেশব সেনের সমাজে যাই। অনেক অন্যায় করিছি। তার জন্য বেতের হুকুম হল।
তখন আমি হয়তো বললাম, কেশব সেন আমাকে এইরূপ বুঝিয়েছিলেন, তাই এইরূপ কাজ করেছি। তখন ঈশ্বর আবার দূতদের হয়তো বলবেন, কেশব সেনকে আবার নিয়ে আয়। এলে পর হয়তো তাকে বলবেন, তুই একে উপদেশ দিছিলি? তুই নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু জানিস না, আবার পরকে উপদেশ দিছিলি? ওরে কে আছিস – একে আর পঁচিশ বেত দে। (সকলের হাস্য)
“তাই বিদ্যাসাগর বলেন নিজেই সামলাতে পারি না, আবার পরের জন্য বেত খাওয়া! (সকলের হাস্য) আমি নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু বুঝি না, আবার পরকে কি লেকচার দেব?”
নরেন্দ্র – যে এটা বোঝেনি, সে আর পাঁচটা বুঝলে কেমন করে?
মাস্টার – আর পাঁচটা কি?
নরেন্দ্র – যে এটা বোঝে নাই, সে দয়া, পরোপকার বুঝলে কেমন করে? স্কুল বুঝলে কেমন করে?
“যে একটা ঠিক বোঝে, সে সব বোঝে।”
মাস্টার (স্বগত) – ঠাকুর বলতেন বটে ‘যে ঈশ্বরকে জেনেছে, সে সব বোঝে।’ আর সংসার করা, স্কুল করা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন যে, ‘ও-সব রজোগুণে হয়।’ বিদ্যাসাগরের দয়া আছে বলে বলেছিলেন, ‘এ রজোগুণের সত্ত্ব। এ রজোগুণে দোষ নাই।’
খাওয়া-দাওয়ার পর মঠের ভাইরা বিশ্রাম করিতেছেন। মণি ও চুনিলাল নৈবেদ্যের ঘরের পূর্বদিকে যে অন্দরমহলের সিঁড়ি আছে, তাহার চাতালের উপর বসিয়া গল্প করিতেছেন। চুনিলাল বলিতেছেন, কি প্রকারে ঠাকুরের সহিত দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার প্রথম দর্শন হইল। সংসার ভাল লাগে নাই বলিয়া তিনি একবার বাহিরে চলিয়া গিয়াছিলেন ও তীর্থে ভ্রমণ করিয়াছিলেন, সেই সকল গল্প করিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে নরেন্দ্র আসিয়া বসিলেন। যোগবাশিষ্ঠের কথা হইতে লাগিল।
নরেন্দ্র (মণির প্রতি) – আর বিদুরথের চণ্ডাল হওয়া?২
মণি – কি লবণের কথা বলছো?
নরেন্দ্র – ও! আপনি পড়েছেন?
মণি – হাঁ, একটু পড়েছি।
নরেন্দ্র – কি, এখানকার বই পড়েছেন?
মণি – না, বাড়িতে একটু পড়েছিলাম।
নরেন্দ্র ছোট গোপালকে তামাক আনিতে বলিতেছেন। ছোট গোপাল একটু ধ্যান করিতেছিলেন।
নরেন্দ্র (গোপালের প্রতি) – ওরে আমাক সাজ্। ধ্যান কি রে! আগে ঠাকুর ও সাধুসেবা করে Preparation কর। তারপর ধ্যান। আগে কর্ম তারপর ধ্যান। (সকলের হাস্য)
মঠের বাড়ির পশ্চিমে সংলগ্ন অনেকটা জমি আছে। সেখানে অনেকগুলি গাছপালা আছে। সেখানে অনেকগুলি গাছপালা আছে। মাস্টার গাছতলায় একাকী বসিয়া আছেন, এমন সময় প্রসন্ন আসিয়া উপস্থিত। বেলা ৩টা হইবে।
মাস্টার – এ কয়দিন কোথায় গিছিলে? তোমার জন্য সকলে ভাবিত হয়েছে।
ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে? কখন এলে?
প্রসন্ন – এই এলাম, এসে দেখা করিছি।
মাস্টার – তুমি বৃন্দাবনে চললুম বলে চিঠি লিখেছ! আমরা মহা ভাবিত! কত দূর গিছিলে?
প্রসন্ন – কোন্নগর পর্যন্ত গিছিলাম। (উভয়ের হাস্য)
মাস্টার – বসো, একটু গল্প বল, শুনি। প্রথমে কোথায় গিছিলে?
প্রসন্ন – দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে, সেখানে একরাত্রি ছিলাম।
মাস্টার (সহাস্যে) – হাজরা মহাশয়ের এখন কি ভাব?
প্রসন্ন – হাজরা বলে, আমাকে কি ঠাওরাও (উভয়ের হাস্য)
মাস্টার (সহাস্যে) – তুমি কি বললে?
প্রসন্ন – আমি চুপ করে রইলাম। মাস্টার – তারপর?
প্রসন্ন – আবার বলে, আমার জন্য তামাক এনেছ? (উভয়ের হাস্য) খাটিয়ে নিতে চায়! (হাস্য)
মাস্টার – তারপর কোথায় গেলে?
প্রসন্ন – ক্রমে কোন্নগরে গেলাম। একটা জায়গায় রাত্রে পড়েছিলাম। আরও চলে যাব ভাবলাম। পশ্চিমের রেলভাড়ার জন্য ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম যে, এখানে পাওয়া যেতে পারে কি না?
মাস্টার – তারা কি বললে?
প্রসন্ন – বলে টাকাটা সিকেটা পেতে পার। অত রেলভাড়া কে দিবে? (উভয়ের হাস্য)
মাস্টার সঙ্গে কি ছিল?
প্রসন্ন – এক আধখানা কাপড়। পরমহংসদেবের ছবি ছিল। ছবি কারুকে দেখাই নাই।
[পিতা-পুত্র সংবাদ – আগে মা-বাপ – না আগে ঈশ্বর? ]
শ্রীযুক্ত শশীর বাবা আসিয়াছেন। বাবা মঠ থেকে ছেলেকে লইয়া যাইবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অসুখের সময় প্রায় নয় মাস ধরিরা অনন্যচিত্ত হইয়া শশী তাঁহার সেবা করিয়াছিলেন। ইনি কলেজে বি. এ. পর্যন্ত পড়িয়াছিলেন।
এন্ট্রান্সে জলপানি পাইয়াছিলেন। বাপ দরিদ্র ব্রাহ্মণ, কিন্তু সাধক ও নিষ্ঠাবান। ইনি বাপ-মায়ের বড় ছেলে। তাঁহাদের বড় আশা যে, ইনি লেখাপড়া শিখিয়া রোজগার করিয়া তাঁদের দুঃখ দূর করিবেন। কিন্তু ভগবানকে পাইবার জন্য ইনি সব ত্যাগ করিয়াছেন। বন্ধুদের কেঁদে কেঁদে বলতেন, “কি করি, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হায়! মা বাপের কিছু সেবা করতে পারলাম না! তাঁরা কত আশা করেছিলেন।
মা আমার গয়না পরতে পান নাই; আমি কত সাধ করেছিলাম, আমি তাঁকে গয়না পরাব! কিছুই হল না! বাড়িতে ফিরে যাওয়া যেন ভার বোধ হয়! গুরুমহারাজ কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে বলেছেন; আর যাবার জো নাই!”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের স্বধামে গমন করিবার পর শশীর পিতা ভাবিলেন, এবারে বুঝি বাড়ি ফিরিবে। কিন্তু কিছুদিন বাড়ি থাকার পর, মঠ স্থাপিত হইবার কিছুদিনের মধ্যেই মঠে কিছুদিন যাতায়াতের পর, শশী আর মঠ হইতে ফিরিলেন না। তাই পিতা মাঝে মাঝে তাঁহাকে লইতে আসেন। তিনি কোন মতে যাবেন না। আজ বাবা আসিয়াছেন শুনিয়া আর একদিক দিয়া পলায়ন করিলেন, হাতে তাঁহার সঙ্গে দেখা না হয়।
পিতা মাস্টারকে চিনিতেন। তাঁর সঙ্গে উপরের বারান্দায় বেড়াইতে বেড়াইতে কথা কহিতে লাগিলেন।
পিতা – এখানে কর্তা কে? এই নরেন্দ্রই যত নষ্টের গোড়া! ওরা তো বেশ বাড়িতে ফিরে গিছিল। পড়াশুনা আবার কচ্ছিল।
মাস্টার – এখানে কর্তা নাই; সকলেই সমান। নরেন্দ্র কি করবেন? নিজের ইচ্ছা না থাকলে কি মানুষ চলে আসে? আমরা কি বাড়ি ছেড়ে আসতে পেরেছি?
পিতা – তোমরা তো বেশ করছো গো। দুদিক রাখছো। তোমরা যা কচ্ছ, এতে কি ধর্ম হয় না? তাই তো আমাদেরও ইচ্ছা। এখানেও থাকুক, সেখানেও যাক। দেখ দেখি, ওর গর্ভধারিণী কত কাঁদছে।
মাস্টার দুঃখিত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন।
পিতা – আর সাধু খুঁজে খুঁজে এত বেড়ানো! আমি ভাল সাধুর কাছে নিয় যেতে পারি। ইন্দ্রনারায়ণের কাছে একটি সাধু এসেছে – চমৎকার লোক। সেই সাধুকে দেখুক না।
[রাখালের বৈরাগ্য, – সন্ন্যাসী ও নারী ]
রাখাল ও মাস্টার কালী তপস্বীর ঘরের পূর্বদিকের বারান্দায় বেড়াইতেছেন। ঠাকুর ও ভক্তদের বিষয় গল্প করিতেছেন।
রাখাল (ব্যস্ত হইয়া) – মাস্টার মশায়, আসুন, সকলে সাধন করি।
“তাই তো আর বাড়িতে ফিরে গেলাম না। যদি কেউ বলে, ঈশ্বরকে পেলে না, তবে আর কেন। তা নরেন্দ্র বেশ বলে, রামকে পেলুম না বলে কি শ্যামের সঙ্গে ঘর করতেই হবে; আর ছেলেপুলের বাপ হতেই হবে! আহা! নরেন্দ্র এক-একটি বেশ কথা বলে! আপনি বরং জিজ্ঞাসা করবেন!”
মাস্টার – তা ঠিক কথা। রাখাল বাবু, তোমারও দেখছি মনটা খুব ব্যাকুল হয়েছে।
রাখাল – মাস্টার মশায়, কি বলব? দুপুর বেলায় নর্মদায় যাবার জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়েছিল! মাস্টার মশায়, সাধন করুন, তা না হলে কিছু হচ্ছে না; দেখুন না, শুকদেবেরও ভয়। জন্মগ্রহণ করেই পলায়ন! ব্যাসদেব দাঁড়াতে বললেন, তা দাঁড়ায় না!
মাস্টার – যোগোপনিষদের কথা। মায়ার রাজ্য থেকে শুকদেব পালাচ্ছিলেন। হাঁ, ব্যাস আর শুকদেবের বেশ কথাবার্তা আছে। ব্যাস সংসারে থেকে ধর্ম করতে বলছেন। শুকদেব বলছেন, হরিপাদপদ্মই সার! আর সংসারীদের বিবাহ করে মেয়েমানুষের সঙ্গে বাস, এতে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন।
রাখাল – অনেকে মনে করে, মেয়েমানুষ না দেখলেই হল। মেয়েমানুষ দেখে ঘাড় নিচু করলে কি হবে? নরেন্দ্র কাল রাত্রে বেশ বললে, ‘যতক্ষণ আমার কাম, ততক্ষণই স্ত্রীলোক; তা না হলে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ বোধ থাকে না।’
মাস্টার – ঠিক কথা। ছেলেদের ছেলেমেয়ে বোধ নাই।
রাখাল – তাই বলছি, আমাদের সাধনা চাই। মায়াতীত না হলে কেমন করে জ্ঞান হবে। চলুন বড় ঘরে যাই; বরাহনগরে থেকে কতকগুলি ভদ্রলোক এসেছে। নরেন্দ্র তাদের কি বলছে, চলুন শুনি গিয়ে।
[নরেন্দ্র ও শরণাগতি (Resignation) ]
নরেন্দ্র কথা কহিতেছেন। মাস্টার ভিতরে গেলেন না। বড় ঘরের পূর্বদিকের দালানে বেড়াইতে বেড়াইতে কিছু কিছু শুনিতে পাইলেন।
নরেন্দ্র বলিতেছেন – সন্ধ্যাদি কর্মের, স্থান সময় নাই।
একজন ভদ্রলোক – আচ্ছা মশায়, সাধন করলেই তাঁকে পাওয়া যাবে?
নরেন্দ্র – তাঁর কৃপা। গীতায় বলছেন, –
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেঽর্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্বভূতানি যন্ত্ররূঢ়ানি মায়য়া।।
তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপস্যসি শাশ্বতম্।।
“তাঁর কৃপা না হলে সাধন-ভজনে কিছু হয় না। তাই তাঁর শরণাগত হতে হয়।”
ভদ্রলোক – আমরা মাঝে মাঝে এসে বিরক্ত করব।
নরেন্দ্র – তা যখন হয় আসবেন।
“আপনাদের ওখানে গঙ্গার ঘাটে আমরা নাইতে যাই।”
ভদ্রলোক – তাতে আপত্তি নাই, তবে অন্য লোক না যায়।
নরেন্দ্র – তা বলেন তো আমরা নাই যাব।
ভদ্রলোক – না তা নয় – তবে যদি দেখেন পাঁচজন যাচ্ছে, তাহলে আর যাবেন না।
[আরতি ও নরেন্দ্রের গুরুগীতা পাঠ ]
সন্ধ্যার পর আরতি হইল। ভক্তেরা আবার কৃতাঞ্জলি হয়ে “জয় শিব ওঁকার” সমস্বরে গান করিতে করিতে ঠাকুরের স্তব করিতে লাগিলেন। আরতি হইয়া গেলে ভক্তেরা দানাদের ঘরে গিয়া বসিলেন। মাস্টার বসিয়া আছেন। প্রসন্ন গুরুগীতা পাঠ করিয়া শুনাইতে লাগিলেন। নরেন্দ্র আসিয়া নিজে সুর করিয়া পাঠ করিতে লাগিলেন। নরেন্দ্র গাইতেছেন:
ব্রহ্মানন্দং পরমসুখদং কেবলং জ্ঞানমূর্তিং।
একং নিত্যং বিমলমচলং সর্ব্বধীসাক্ষীভূতং।
ভাবাতীতং ত্রিগুণরহিতং সদ্গুরুং তং নমামি।।
আবার গাইলেন:
ন গুরোরধিকং ন গুরোরধিকং। শিবশাসনতঃ শিবশাসনতঃ।।
শ্রীমৎ পরং ব্রহ্মগুরুং বদামি। শ্রীমৎ পরং ব্রহ্মগুরুং ভজামি।।
শ্রীমৎ পরং ব্রহ্মগুরুং স্মরামি। শ্রীমৎ পরং ব্রহ্মগুরুং নমামি।।
নরেন্দ্র সুর করিয়া গুরুগীতা পাঠ করিতেছেন। আর ভক্তদের মন যেন নিবাতনিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় স্থির হইয়া গেল। সত্য সত্যই ঠাকুর বলিতেন, সুমধুর বংশীধ্বনি শুনে সাপ যেমন ফণা তুলে স্থির হয়ে থাকে, নরেন্দ্র গাইলে হৃদয়ের মধ্যে যিনি আছেন, তিনিও সেইরূপ চুপ করে শোনেন। আহা! মঠের ভাইদের কি গুরুভক্তি!
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভালবাসা ও রাখাল ]
কালী তপস্বীর ঘরে রাখাল বসিয়া আছেন। কাছে প্রসন্ন। মাস্টারও সেই ঘরে আছেন।
রাখলা সন্তান-পরিবার ত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন। অন্তরে তীব্র বৈরাগ্য; কেবল ভাবছেন, একাকী নর্মদাতীরে কি অন্য স্থানে চলিয়া যাই। তবু প্রসন্নকে বুঝাইতেছেন।
রাখাল (প্রসন্নের প্রতি) – কোথায় ছুটে ছুটে বেরিয়া যাস? এখানে সাধুসঙ্গ। এ ছেড়ে যেতে আছে? আর নরেনের মতো লোকের সঙ্গ। এ ছেড়ে কোথায় যাবি?
প্রসন্ন – কলকাতায় বাপ-মা রয়েছে। ভয় হয়, পাছে তাঁদের ভালবাসা আমাকে টেনে নেয়; তাই দূরে পালাতে চাই।
রাখাল – গুরুমহারাজ যেমন ভালবাসতেন, তত কি বাপ-মা ভালবাসে? আমরা তাঁর কি করেছি যে এত ভালবাসা। কেন তিনি আমাদের দেহ মন আত্মার মঙ্গলের জন্য এত ব্যস্ত ছিলেন। আমরা তাঁর কি করেছি?
মাস্টার (স্বগত) – আহা, রাখাল ঠিক বলেছেন! তাই তাঁকে বলে অহেতুক কৃপাসিন্ধু।
প্রসন্ন – তোমার কি বেরিয়া যেতে ইচ্ছা হয় না?
রাখাল – মনে খেয়াল হয় যে নর্মদাতীরে গিয়ে কিছুদিন থাকি। এক-একবার ভাবি, ওই সব জায়গায় কোন বাগানে গিয়ে থাকি, আর কিছু সাধন করি। খেয়াল হয়, তিনদিন পঞ্চতপা করি। তবে সংসারীর বাগানে যেতে আবার মন হয় না।
[ঈশ্বর কি আছেন ]
দানাদের ঘরে তারক ও প্রসন্ন কথা কহিতেছেন। তারকের মা নাই। পিতা রাখালের পিতার ন্যায় দ্বিতীয় সংসার করিয়াছেন। তারকও বিবাহ করিয়াছিলেন কিন্তু পত্নীবিয়োগ হইয়াছে। মঠই তারকের এখন বাড়ি, তারকও প্রসন্নকে বুঝাইতেছেন।
প্রসন্ন – না হল জ্ঞান, না হল প্রেম; কি নিয়ে থাকা যায়?
তারক – জ্ঞান হওয়া শক্ত বটে, কিন্তু প্রেম হল না কেমন করে?
প্রসন্ন – কাঁদতে পারলুম না, তবে প্রেম হবে কেমন করে? আর এতদিনে কি বা হল?
তারক – কেন, পরমহংস মশায়কে তো দেখেছ। আর জ্ঞানই বা হবে না কেন?
প্রসন্ন – কি জ্ঞান হবে? জ্ঞান মানে তো জানা। কি জানবে? ভগবান আছেন কি না, তারই ঠিক নাই।
তারক – হাঁ, তা বটে, জ্ঞানীর মতে ঈশ্বর নাই।
মাস্টার (স্বগত) – আহা প্রসন্নের যে অবস্থা, ঠাকুর বলতেন, যারা ভগবানকে চায়, তাদের ওওরূপ অবস্থা হয়। কখনও বোধ হয়, ভগবান আছেন কি না। তারক বুঝি এখন বৌদ্ধমত আলোচনা করছেন, তাই জ্ঞানীর মতে ঈশ্বর নাই বলছেন। ঠাকুর কিন্তু বলতেন, জ্ঞানী আর ভক্ত এক জায়গায় পৌঁছিবে।
………………………………………………
১ কোন দেশে পদ্ম নামে রাজা ও লীলা নামে তাঁহার সহধর্মিণী ছিলেন। লীলা পতির অমরত্ব আকাঙ্ক্ষায় ভগবতী সরস্বতীর আরাধনা করিয়া, তাঁহার পতির জীবাত্মা, দেহত্যাগের পরও গৃহাকাশে অবরুদ্ধ থাকিবেন, এই বর লাভ করিয়াছিলেন। পতির মৃত্যুর পর লীলা সরস্বতীদেবীকে স্মরণ করিলে তিনি আবির্ভূতা হইয়া লীলাকে তত্ত্বোপদেশ দ্বারা জগৎ মিথ্যা ও ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, ইহা সুন্দররূপে ধারণা করাইয়া দিলেন।
সরস্বতীদেবী বলিলেন, তোমার পদ্মনামক স্বামী – পূর্বজন্মে বশিষ্ঠ নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন – তাঁহার আট দিন মাত্র দেহত্যাগ হইয়াছে – আর এক্ষণে তাঁহার জীবাত্মা এই গৃহে অবস্থিত আছেন, আবার অন্য একস্থলে বিদুরথ নামে রাজা হইয়া অনেক বর্ষ রাজ্যভোগ করিয়াছিলেন। এ সকলই মায়াবলে সম্ভবে। বাস্তবিক দেশকাল কিছু নহে। পরে সমাধিবলে সরস্বতীদেবীর সহিত তিনি সূক্ষ্মদেহে প্রোক্ত বশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ও বিদুরথ রাজার রাজ্যে ভ্রমণ করিয়া আসিলেন।
সরস্বতীদেবীর কৃপায় বিদুরথের পূর্বস্মৃতি উদিত হইল। পরে তিনি এক যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিলে তাঁহার জীবাত্মা পদ্মরাজার শরীরে প্রবেশ করিল।
২ বিদুরথ রাজার চণ্ডালত্ব প্রাপ্তি হয় নাই। লবণ রাজার হইয়াছিল। তিনি এক ঐন্দ্রজালিকের ইন্দ্রজাল প্রভাবে এক মুহূর্তের মধ্যে সারা জীবন চণ্ডালত্ব অনুভব করিয়াছিলেন। অহল্যা নামে কোন রাজার মহিষী ইন্দ্র নামক কোন যুবকের আসক্তিতে পড়িয়াছিলেন।