১৮৮৫, ১১ই মার্চ
পার্ষদসঙ্গে – অবতার সম্বন্ধে বিচার
ভক্তেরা অনেকেই উপস্থিত; – শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে বসিয়া। নরেন্দ্র, গিরিশ, রাম, হরিপদ, চুনি, বলরাম, মাস্টার – অনেকে আছেন।
নরেন্দ্র মানেন না যে, মানুষদেহ লইয়া ঈশ্বর অবতার হন। এদিকে গিরিশের জ্বলন্ত বিশ্বাস যে, তিনি যুগে যুগে অবতার হন, আর মানবদেহ ধারণ করে মর্ত্যলোকে আসেন। ঠাকুরের ভারী ইচ্ছা যে, এ সম্বন্ধে দুজনের বিচার হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশকে বলিতেছেন, “একটু ইংরাজীতে দুজনে বিচার করো, আমি দেখবো!”
বিচার আরম্ভ হইল। ইংরেজীতে হইল না, বাংলাতেই হইল – মাঝে মাঝে দু-একটা ইংরেজী কথা। নরেন্দ্র বলিলেন, “ঈশ্বর অনন্ত। তাঁকে ধারণা করা আমাদের সাধ্য কি? তিনি সকলের ভিতরেই আছেন – শুধু একজনের ভিতর এসেছেন, এমন নয়।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) – ওরও যা মত আমারও তাই মত। তিনি সর্বত্র আছেন। তবে একটা কথা আছে – শক্তিবিশেষ। কোনখানে অবিদ্যাশক্তির প্রকাশ, কোনখানে বিদ্যাশক্তির। কোন আধারে শক্তি বেশি, কোন আধারে শক্তি কম। তাই সব মানুষ সমান নয়।
রাম – এ-সব মিছে তর্কে কি হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্তভাবে) – না, না, ওর একটা মানে আছে।
গিরিশ (নরেন্দ্রের প্রতি) – তুমি কেমন করে জানলে, তিনি দেহধারণ করে আসেন না?
নরেন্দ্র – তিনি অবাঙ্মনোসোগোচরম্।
শ্রীরামকৃষ্ণ – না; তিনি শুদ্ধবুদ্ধির গোচর। শুদ্ধবুদ্ধি শুদ্ধ-আত্মা একই, ঋষিরা শুদ্ধবুদ্ধি শুদ্ধ-আত্মা দ্বারা শুদ্ধ-আত্মাকে সাক্ষাৎকার করেছিলেন।
গিরিশ (নরেন্দ্রের প্রতি) – মানুষে অবতার না হলে কে বুঝিয়ে দেবে? মানুষকে জ্ঞানভক্তি দিবার জন্য তিনি দেহধারণ করে আসেন। না হলে কে শিক্ষা দেবে?
নরেন্দ্র – কেন? তিনি অন্তরে থেকে বুঝিয়ে দেবেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে) – হাঁ হাঁ, অন্তর্যামীরূপে তিনি বুঝাবেন।
তারপর ঘোরতর তর্ক। ইনফিনিটি – তার কি অংশ হয়? আবার হ্যামিলটন্ কি বলেন? হার্বার্ট স্পেন্সার কি বলেন? টিণ্ডেল, হাক্সলে বা কি বলে গেছেন, এই কথা হতে লাগল।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – দেখ, ইগুণো আমার ভাল লাগছে না। আমি সব তাই দেখছি। বিচার আর কি করবো? দেখছি – তিনিই সব। তিনিই সব হয়েছেন। তাও বটে, আবার তাও বটে। এক অবস্থায়, অখণ্ডে মনবুদ্ধিহারা হয়ে যায়! নরেন্দ্রকে দেখে আমার মন অখণ্ডে লীন হয়।
(গিরিশের প্রতি) – “তার কি করলে বল দেখি।”
গিরিশ (হাসিতে হাসিতে) – ওইটে ছাড়া প্রায় সব বুঝেছি কিনা। (সকলের হাস্য)
[রামানুজ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ – আবার দু-থাক না নামলে কথা কইতে পারি না।
“বেদান্ত – শঙ্কর যা বুঝিয়েছেন, তাও আছে; আবার রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদও আছে।
নরেন্দ্র – বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রকে) – বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ আছে – রামানুজের মত। কিনা, জীবজগৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। সব জড়িয়ে একটি বেল। খোলা আলাদা, বীজ আলাদা, আর শাঁস আলাদা একজন করেছিল। বেলটি কত ওজনের জানবার দরকার হয়েছিল। এখন শুধু শাঁস ওজন করলে কি বেলের ওজন পাওয়া যায়? খোলা, বিচি, শাঁস সব একসঙ্গে ওজন করতে হবে। প্রথমে খোলা নয়, বিচি নয়, শাঁসটিই সার পদার্থ বলে বোধ হয়। তারপর বিচার করে দেখে, – যেই বস্তুর শাঁস সেই বস্তুরই খোলা আর বিচি। আগে নেতি নেতি করে যেতে হয়। জীব নেতি, জগৎ নেতি এইরূপ বিচার করতে হয়; ব্রহ্মই বস্তু আর সব অবস্তু। তারপর অনুভব হয়, যার শাঁস তারই খোলা, বিচি। যা থেকে ব্রহ্ম বলছো তাই থেকে জীবজগৎ। যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। তাই রামানুজ বলতেন, জীবজগৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। এরই নাম বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ।”