১৮৮৫, ২৪শে এপ্রিল
সমাধিস্থ কি ফেরে? শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত – কুয়ার সিং১
মহিমাচরণ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – মহাশয়, সমাধিস্থ কি ফিরতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি একান্তে) – তোমায় একলা একলা বলব; তুমিই একথা শোনবার উপযুক্ত।
“কুয়ার সিং ওই কথা জিজ্ঞাসা করত। জীব আর ঈশ্বর অনেক তফাত। সাধন-ভজন করে সমাধি পর্যন্ত জীবের হতে পারে। ঈশ্বর যখন অবতীর্ণ হন, তিনি সমাধিস্থ হয়েও আবার ফিরতে পারেন। জীবের থাক – এরা যেন রাজার কর্মচারী। রাজার বারবাড়ি পর্যন্ত এদের গতায়াত। রাজার বাড়ি সাততলা, কিন্তু রাজার ছেলে সাততলায় আনাগোনা করতে পারে, আবার বাইরেও আসতে পারে। ফেরে না, ফেরে না, সব বলে। তবে শঙ্করাচার্য রামানুজ এরা সব কি? এরা ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিল।”
মহিমাচরণ – তাই তো; তা না হলে গ্রন্থ লিখলে কেমন করে?
শ্রীরামকৃষ্ণ – আবার দেখ, প্রহ্লাদ, নারদ, হনুমান, এরাও সমাধির পর ভক্তি রেখেছিল।
মহিমাচরণ – আজ্ঞা হাঁ।
[শুধু জ্ঞান বা জ্ঞানচর্চা – আর সমাধির পর জ্ঞান – বিদ্যার আমি ]
শ্রীরামকৃষ্ণ – কেউ কেউ জ্ঞানচর্চা করে বলে মনে করে, আমি কি হইছি। হয়তো একটু বেদান্ত পড়েছে। কিন্তু ঠিক জ্ঞান হলে অহংকার হয় না, অর্থাৎ যদি সমাধি হয়, আর মানুষ তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যায়, তাহলে আর অহংকার থাকে না। সমাধি না হলে ঠিক জ্ঞান হয় না। সমাধি হলে তাঁর সঙ্গে এক হওয়া যায়। অহং থাকে না।
“কিরকম জানো? ঠিক দুপুর বেলা সূর্য ঠিক মাথার উপর উঠে। তখন মানুষটা চারিদিকে চেয়ে দেখে, আর ছায়া নাই। তাই ঠিক জ্ঞান হলে – সমাধিস্থ হলে – অহংরূপ ছায়া থাকে না।
“ঠিক জ্ঞান হবার পর যদি অহং থাকে, তবে জেনো, ‘বিদ্যার আমি’ ‘ভক্তির আমি’ ‘দাস আমি’। সে ‘অবিদ্যার আমি’ নয়।
“আবার জ্ঞান ভক্তি দুইটিই পথ – যে পথ দিয়ে যাও, তাঁকেই পাবে। জ্ঞানী একভাবে তাঁকে দেখে, ভক্ত আর-একভাবে তাঁকে দেখে। জ্ঞানীর ঈশ্বর তেজোময়, ভক্তের রসময়।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও মার্কণ্ডেয়চণ্ডীবর্ণিত অসুরবিনাশের অর্থ ]
ভবনাথ কাছে বসিয়াছেন ও সমস্ত শুনিতেছেন। ভবনাথ নরেন্দ্রের ভারী অনুগত ও প্রথম প্রথম ব্রাহ্মসমাজে সর্বদা যাইতেন।
ভবনাথ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে। আমি চণ্ডী বুঝতে পারছি না। চণ্ডীতে লেখা আছে যে, তিনি সব টক টক মারছেন। এর মানে কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ – ও-সব লীলা। আমিও ভাবতুম ওই কথা। তারপর দেখলুম সবই মায়া। তাঁর সৃষ্টিও মায়া, তাঁর সংহারও মায়া।
ঘরের পশ্চিমদিকের ছাদে পাতা হইয়াছে। এইবার গিরিশ ঠাকুরকে ও ভক্তদিগকে আহ্বান করিয়া লইয়া গেলেন। বৈশাখ শুক্লা দশমী। জগৎ হাসিতেছে। ছাদ চন্দ্রকিরণে প্লাবিত। এ-দিকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে সম্মুখে রাখিয়া ভক্তেরা প্রসাদ পাইতে বসিয়াছেন। সকলেই আনন্দে পরিপূর্ণ।
ঠাকুর “নরেন্দ্র” “নরেন্দ্র” করিয়া পাগল। নরেন্দ্র সম্মুখে পঙ্ক্তিতে অন্যান্য ভক্তসঙ্গে বসিয়াছেন। মাঝে মাঝে ঠাকুর নরেন্দ্রের খবর লইতেছেন। অর্ধেক খাওয়া হইতে না হইতে ঠাকুর হঠাৎ নরেন্দ্রের কাছে নিজের পাত থেকে দই ও তরমুজের পানা লইয়া উপস্থিত। বলিলেন, “নরেন্দ্র তুই এইটুকু খা।” ঠাকুর বালকের ন্যায় আবার ভোজনের আসনে গিয়া উপবিষ্ট হইলেন।
…………………………..
১ কুয়ার সিং সিপাহিদের হাভিলদার