ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮১, ৩রা ডিসেম্বর
মনোমোহন মন্দিরে

ব্রাহ্মভক্তগণ সঙ্গে কেশব আসিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাঙ্গণে বসিয়া আছেন। কেশব আসিয়া অতি ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের বামদিকে কেশব বসিলেন আর দক্ষিণদিকে রাম উপবিষ্ট।

কিয়ৎকাল ভাগবত পাঠ হইতে লাগিল।

পাঠান্তে ঠাকুর কথা কহিতেছেন। প্রাঙ্গণের চতুর্দিকে গৃহস্থ ভক্তগণ বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – সংসারের কর্ম বড় কঠিন; বনবন করে ঘুরলে মাথা ঘুরে যেমন অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তবে খুঁটি ধরে ঘুরলে আর ভয় নাই। কর্ম কর কিন্তু ঈশ্বরকে ভুল না।

“যদি বল, যেকালে এত কঠিন? উপায় কি?

“উপায় অভ্যাসযোগ। ও-দেশে ছুতোরদের মেয়েরা দেখছি, তারা একদিকে চিঁড়ে কুটছে, ঢেঁকি পড়বার ভয় আছে হাতে; আবার ছেলেকে মাই দিচ্ছে; আবার খরিদ্দারদের সঙ্গর কতা কইছে; বলছে – তোমার যা পাওনা আছে দিয়ে যেও।

“নষ্ট মেয়ে সংসারের সব কাজ করে, কিন্তু সর্বদা উপপতির দিকে মন পড়ে থাকে।

“তবে এটুকু হবার জন্য একটু সাধন চাই। মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁকর ডাকতে হয়। ভক্তিলাভ করে কর্ম করা যায়। শুধু হাতে কাঁঠাল ভাঙলে হাতে আঠা লাগবে – হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে আর আঠা লাগবে না।”

এইবার প্রাঙ্গণে গান হইতেছে। ক্রমে শ্রীযুক্ত ত্রৈলোক্যও গান গাহিতেছেন:

জয় জয় আনন্দময়ী ব্রহ্মরূপিণী।

ঠাকুর আনন্দে নাচিতেছেন। সঙ্গে সঙ্গে কেশবাদি ভক্তগণ নাচিতেছেন। শীতকাল, ঠাকুরের গায়ে ঘাম দেখা দিতেছে।

কীর্তনানন্দের পর সকলে উপবেশন করিলে শ্রীরামকৃষ্ণ কিছু খাইতে চাহিলেন। ভিতর হইতে একটি থালা করিয়া মিষ্টান্নাদি আসিল। কেশব ওই থালাখানা ধরিয়া রহিলেন, ঠাকুর খাইতে লাগিলেন। কেশব জলপাত্রও ওইরূপ ধরিলেন; গামছা দিয়া মুখ মুছাইয়া দিলেন। তৎপরে ব্যজন করিতে লাগিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ এইবার সংসারে ধর্ম হয় কিনা আবার সেই কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবাদির প্রতি) – যারা সগসারে তাঁকে ডাকতে পারে, তারা বীরভক্ত। মাথায় বিশ মন বোঝা, তবু ঈশ্বরকে পাবার চেষ্টা করছে। এরই নাম বীরভক্ত।

“যদি বল এটি অতি কঠিন। কঠিন হলেও ভগবানের কৃপায় কিনা হয়। অসম্ভবও সম্ভব হয়। হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে যদি আলো আসে, সে কি একটু একটু করে আসবে? একবারে ঘর আলোকিত হবে।”

এই সকল আশার কথা শুনিয়া কেশবাদি গৃহস্থ ভক্তগণ আনন্দ করিতেছেন।

কেশব (রাজেন্দ্র মিত্রের প্রতি, সহাস্যে) – আপনার বাড়িতে এরূপ একদিন হলে বেশ হয়।

রাজেন্দ্র – আচ্ছা তাতো বেশ! রাম, তোমার উপর সব ভার।

রাজেন্দ্র, রাম ও মনোমোহনের মেসোমশাই।

এইবার ঠাকুরকে উপরে অন্তঃপুরে লইয়া যাওয়া হইতেছে। সেখানে তিনি সেবা করিবেন। মনোমোহনের মাতাঠাকুরাণী শ্যামাসুন্দরী সমস্ত আয়োজন করিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ আসন গ্রহণ করিলেন। নানাবিধ মিষ্টান্নাদি উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য দেখিয়া ঠাকুর হাসিতে লাগিলেন ও খাইতে খাইতে বলিতেছেন – আমার জন্য এত করেছো। এক গ্লাস বরফ জলও কাছে ছিল।

কেশবাদি ভক্তগণ প্রাঙ্গণে বসিয়া খাইতেছেন। ঠাকুর নিচে আসিয়া তাঁহাদিগকে খাওয়াইতে লাগিলেন। তাঁহাদের আনন্দের জন্য লুচিমণ্ডার গান গাহিতেছেন ও নাচিতেছেন।

এইবার দক্ষিণেশ্বর যাত্রা করিবেন। কেশবাদি ভক্তগণ তাঁহাকে গাড়িতে তুলিয়া দিলেন ও পদধূলি গ্রহণ করিলেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!