১৮৮৫, ১৫ই জুলাই
শ্রীরামকৃষ্ণের কুষ্ঠি – পূর্বকথা – ঠাকুরের ঈশ্বরদর্শন
[রাম, লক্ষ্মণ ও পার্থসারথি-দর্শন – ন্যাংটা পরমহংসমূর্তি ]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে সেই ছোট ঘরে কথা কহিতেছেন। মহেন্দ্র মুখুজ্জে, বলরাম, তুলসী, হরিপদ, গিরিশ প্রভৃতি ভক্তেরা বসিয়া আছেন। গিরিশ ঠাকুরের কৃপা পাইয়া সাত-আট মাস যাতায়াত করিতেছেন। মাস্টার ইতিমধ্যে গঙ্গাস্নান করিয়া ফিরিয়াছেন ও ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া তাঁহার কাছে বসিয়াছেন। ঠাকুর তাঁহার অদ্ভুত ঈশ্বর-দর্শনকথা একটু একটু বলিতেছেন।
“কালীঘরে একদিন ন্যাংটা আর হলধারী অধ্যাত্ম (রামায়ণ) পড়ছে। হঠাৎ দেখলাম নদী, তার পাশে বন, সবুজ রঙ গাছপালা, – রাম লক্ষ্মণ জাঙ্গিয়া পরা, চলে যাচ্ছেন। একদিন কুঠির সম্মুখে অর্জুনের রথ দেখলাম। – সারথির বেশে ঠাকুর বসে আছেন। সে এখনও মনে আছে।
“আর একদিন, দেশে কীর্তন হচ্ছে, – সম্মুখে গৌরাঙ্গমূর্তি।
“একজন ন্যাংটা সঙ্গে সঙ্গে থাকত – তার ধনে হাত দিয়ে ফচকিমি করতুম। তখন খুব হাসতুম। এ ন্যাংটোমূর্তি আমারই ভিতর থেকে বেরুত। পরমহংসমূর্তি, – বালকের ন্যায়।
“ঈশ্বরীয় রূপ কত যে দর্শন হয়েছে, তা বলা যায় না। সেই সময়ে বড় পেটের ব্যামো। ওই সকল অবস্থায় পেটের ব্যামো বড় বেড়ে যেত। তাই রূপ দেখলে শেষে থু-থু করতুম – কিন্তু পেছেনে গিয়ে ভূত পাওয়ার মতো আবার আমায় ধরত! ভাবে বিভোর হয়ে থাকতাম, দিনরাত কোথা দিয়ে যেত! তার পরদিন পেট ধুয়ে ভাব বেরুত!” (হাস্য)
গিরিশ (সহাস্যে) – আপনার কুষ্ঠি দেখছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – দ্বিতীয়ার চাঁদে জন্ম। আর রবি, চন্দ্র, বুধ – এছাড়া আর কিছু বড় একটা নাই।
গিরিশ – কুম্ভরাশি। কর্কট আর বৃষে রাম আর কৃষ্ণ; – সিংহে চৈতন্যদেব।
শ্রীরামকৃষ্ণ – দুটি সাধ ছিল। প্রথম – ভক্তের রাজা হব, দ্বিতীয় শুঁটকে সাধু হবো না।
[শ্রীরামকৃষ্ণের কুষ্ঠি – ঠাকুরের সাধন কেন – ব্রহ্মযোনিদর্শন ]
গিরিশ (সহাস্যে) – আপনার সাধন করা কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – ভগবতী শিবের জন্য অনেক কঠোর সাধন করেছিলেন, – পঞ্চতপা, শীতকালে জলে গা বুড়িয়ে থাকা, সূর্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা!
“স্বয়ং কৃষ্ণ রাধাযন্ত্র নিয়ে অনেক সাধন করেছিলেন। যন্ত্র ব্রহ্মযোনি – তাঁরই পূজা ধ্যান! এই ব্রহ্মযোনি থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড উৎপত্তি হচ্ছে।
“অতি গুহ্যকথা! বেলতলায় দর্শন হত – লকলক করত!”
[পূর্বকথা – বেলতলায় তন্ত্রের সাধন – বামনীর যোগাড় ]
“বেলতলায় অনেক তন্ত্রের সাধন হয়েছিল। মড়ার মাথা নিয়ে। আবার … আসন। বামনী সব যোগাড় করত।
(হরিপদর দিকে অগ্রসর হইয়া) – “সেই অবস্থায় ছেলেদের ধন, ফুল-চন্দন দিয়ে পূজা না করলে থাকতে পারতাম না।
“আর-একটি অবস্থা হত। যেদিন অহংকার করতুম, তারপরদিনই অসুখ হত।”
মাস্টার শ্রীমুখনিঃসৃত অশ্রুতপূর্ব বেদান্তবাক্য শুনিয়া অবাক্ হইয়া চিত্রার্পিতের ন্যায় বসিয়া আছেন। ভক্তেরাও যেন সেই পূতসলিলা পতিতপাবনী শ্রীমুখনিঃসৃত ভাগবতগঙ্গায় স্নান করিয়া বসিয়া আছেন।
সকলে চুপ করিয়া আছেন।
তুলসী – ইনি হাসেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ – ভিতরে হাসি আছে। ফল্গুনদীর উপরে বালি, – খুঁড়লে জল পাওয়া যায়।
(মাস্টারের প্রতি) – “তুমি জিহ্বা ছোল না! রোজ জিহ্বা ছুলবে।”
বলরাম – আচ্ছা, এঁর (মাস্টারের) কাছে পূর্ণ আপনার কথা অনেক শুনেছেন –
শ্রীরামকৃষ্ণ – আগেকার কথা – ইনি জানেন – আমি জানি না।
বলরাম – পূর্ণ স্বভাবসিদ্ধ। তবে এঁরা?
শ্রীরামকৃষ্ণ – এঁরা হেতুমাত্র।
নয়টা বাজিয়াছে – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে যাত্রা করিবেন তাহার উদ্যোগ হইতেছে। বাগবাজারের অন্নপূর্ণার ঘাটে নৌকা ঠিক করা আছে। ঠাকুরকে ভক্তেরা ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতেছেন।
ঠাকুর দুই-একটি ভক্তের সহিত নৌকায় গিয়া বসিলেন, গোপালের মা ওই নৌকায় উঠিলেন, – দক্ষিণেশ্বরে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিয়া বৈকালে হাঁটিয়া কামারহাটি যাইবেন।
ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরের ঘরের ক্যাম্পখাটটি সারাইতে দেইয়া হইয়াছিল। সেখানিও নৌকায় তুলিয়া দেওয়া হইল। এই খাটখানিতে শ্রীযুক্ত রাখাল প্রায় শয়ন করিতেন।
আজ কিন্তু মঘা নক্ষত্র। যাত্রা বদলাইতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আগত শনিবারে বলরামের বাটীতে আবার শুভাগমন করিবেন।