ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে উল্লিখিত স্থানসমূহের পরিচয়

কামাপুকুর ও পার্শ্ববর্তী লীলাস্থল

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জন্মস্থান ও তাঁহার বাল্য ও কৈশোরের লীলাভূমি কামারপুকুর বর্তমান যুগের অন্যতম মহান তীর্থ। ইহা হুগলী, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর এই তিন জেলার সংযোগস্থলে অবস্থিত। শ্রীশ্রীঠাকুরের পৈত্রিক বাসভবন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে উক্ত বাসভবন সহ ৪৫ বিঘা জমি রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক সংগৃহীত হইলে এপ্রিল মাসে সেখানে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের এক যুক্ত শাখাকেন্দ্র খোলা হয়।

শ্রীশ্রীঠাকুরের ব্যবহৃত খড়ের চালবিশিষ্ট মাটির নির্মিত বাসগৃহ, দোতলা গৃহ ও বৈঠকখানা সংরক্ষিত হইয়াছে। শ্রীশ্রীঠাকুরের বাল্য ও কৈশোরের কামারপুকুর ও পার্শ্ববর্তী লীলাস্থলগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ:-

শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মস্থান – ঢেঁকিশালায় একটি উনুনের পাশে। এই জন্মস্থানের উপরেই বর্তমান মন্দির নির্মিত। এই মন্দিরে শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্বেত প্রস্তরমূর্তি যে প্রস্তরময় বেদীর উপর স্থাপিত ওই বেদীর সম্মুখ ভাগে ঢেঁকি ও উনুনের প্রতিরূপ খোদিত আছে।

লাহাবাবুদের পাঠশালা – দুর্গামণ্ডপের সম্মুখে আটচালায় এই পাঠশালা বসিত। ক্ষুদিরাম গদাধরের পাঁচ বৎসর বয়সে এক শুভদিনে হাতে খড়ি দিয়া এই পাঠশালায় ভর্তি করিয়া দিয়াছিলেন। বর্ণপরিচয়, পরে হস্তলিখন ও সংখ্যা গণনা অভ্যাস শুরু হয়। তাঁহার হস্তাক্ষর অতি সুন্দর হইয়াছিল। ‘সুবাহুর পালা’ নামক তাঁহার স্বহস্তলিখিত পুঁথিতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। পুঁথিপাঠ তিনি ভালভাবেই করিতে পারিতেন।

কুলদেবতার মন্দির – শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহাঙ্গনে তাঁহার জন্মস্থানের পশ্চিমে কুলদেবতা ৺রঘুবীরের মন্দির। মন্দিরে ৺রামেশ্বর শিবলিঙ্গ, ৺রঘুবীর শিলা ও ৺শীতলার ঘট আছে। ইঁহাদের নিত্যপূজা হয়। পূর্বে মন্দিরটি মৃত্তিকা নির্মিত ছিল। পরে ইষ্টক নির্মিত হইয়াছে। বর্তমানে এই মন্দিরে ৺নারায়ণ শিলা ও লক্ষ্মীর ঘটও আছে।

পৈতৃক গৃহ: – শ্রীশ্রীঠাকুরের শয়ন ঘর – ৺রঘুবীরের মন্দিরের উত্তের মৃত্তিকা নির্মিত গৃহ ও বারান্দা। এই গৃহে শ্রীরামকৃষ্ণ শয়ন করিতেন। ইহা এখনও তাঁহার শয়নকক্ষ রূপে ব্যবহৃত হয়। খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল ও পরিষ্কার নিকানো মেঝে পূর্বের ন্যায় একই আছে। এই গৃহের সংলগ্ন পূর্বদিকে দ্বিতল মৃত্তিকা নির্মিত গৃহ ও বারান্দা। এই গৃহে বাড়ির অন্যান্য সকলে শয়ন করিতেন।

বাড়ির বাহিরে প্রবেশপথের উপরে একখানি মৃত্তিকার দেওয়াল সহ চালাঘর আছে। এখানে শ্রীশ্রীঠাকুর বাহিরের লোকজনের সহিত কথাবার্তা বলিতেন। সেইজন্য ইহাকে বৈঠকখানা বলা হয়। ইহার পূর্বদিকে দেওয়ালের পার্শ্বে শ্রীশ্রীঠাকুরের স্বহস্তরোপিত আম্রবৃক্ষ আছে। বাড়ির পূর্বদিকে একটি পুষ্করিণী আছে। বর্তমানে ইহা ভরাট করাতে ক্ষুদ্রাকৃতি হইয়াছে। ইহার নাম খাঁ পুকুর।

বাড়ির দক্ষিণ দিকে এখন যে স্থানে নাটমন্দির আছে সেখানে ক্ষুদিরামের বন্ধু সুখলাল গোস্বামীর বাড়ি ছিল। ক্ষুদিরাম স্বগ্রাম দেরে হইতে ওই গ্রামের জমিদারের চক্রান্তে সর্বস্ব বঞ্চিত হইয়া বন্ধু সুখলালের আমন্ত্রণে কামারপুকুরে আসিয়া বসবাস করেন। সুখলাল নিজ বসতবাটীর উত্তরে জমি দান করিয়া গৃহাদি নির্মাণে ক্ষুদিরামকে সহায়তা করিয়াছিলেন।

যুগীদের শিব মন্দির – শ্রীরামকৃষ্ণের বাড়ির উত্তরে যুগীদের শিব মন্দির। এই মন্দিরের মহাদেবের লিঙ্গমূর্তি হইতে দিব্যজ্যোতি নির্গত হইয়া বায়ুর ন্যায় তরঙ্গাকারে মন্দিরের সম্মুখে দণ্ডায়মান চন্দ্রাদেবীর দেহে প্রবেশ করে এবং উহা হইতেই শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্ম। এই মন্দিরে উত্তর-পূর্ব কোণে মধু যুগীর বাড়ি ছিল।

হালদারপুকুর – এই পুকুরে গদাধর (ঠাকুরের বাল্য নাম) ও বাড়ির অন্যান্য সকলে স্নান করিতেন। পরবর্তী কালে শ্রীশ্রীঠাকুর ইহার কথা কথামৃতে বহুবার উল্লেখ করিয়াছেন।

লক্ষ্মীজলা – হালদারপুকুরে পশ্চিমে লক্ষ্মীজলা নামে এক বিঘা দশ ছটাক পরিমাণের ধানের খেত। ইহাতে প্রচুর ধান হইত। এই ধানের চাউলে ৺রঘুবীর ও অন্যান্য দেবতাদের ভোগ হইত।

ভূতির খালের শ্মশান ও গোচারনের মাঠ – পিতা ক্ষুদিরাম দেহত্যাগ হইলে গদাধর শোকাচ্ছন্ন হইয়া এই শ্মশানে বহু সময় কাটাইতেন। এই গোচারণের মাঠে গদাধর কোন কোন সময় কোঁচড়ে মুড়ি লইয়া খাইতে খাইতে বেড়াইতেন। সেই সময় একদিন আকাশে কৃষ্ণবর্ণ মেঘের কোলে এক ঝাঁক সাদা বলাকা দর্শনে মুগ্ধ হন এবং এই অপূর্ব সৌন্দর্যের দর্শনে তন্ময় হইয়া ভাবসমাধিস্থ হন। ইহাই তাঁহার প্রথম ভাব সমাধি।

লাহাবাবুদের সদাব্রত ও দেবালয় – বর্তমান শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের দক্ষিণদিকে এই সদাব্রত ছিল। সাধুরা সেখানে আসিলে চাউল, ডাল ইতাদি পাইতেন। গদাধর বাল্যকাল হইতেই সাধুদর্শনের জন্য সেখানে যাইতেন। বর্তমান মঠের পূর্বদিকে লাহাবাবুদের বাড়ি ও দেবালয়, বিষ্ণুমন্দির ও দুর্গাদালান ছিল। গদাধের বাল্যেই মন্দিরে পূজা ও দুর্গামণ্ডপে প্রতিমা নির্মাণ হইতে পূজাসাঙ্গ পর্যন্ত বিশেষভাবে লক্ষ্য করিতেন। লাহাবাবুদের বাড়িতেও প্রায়ই যাইতেন।

লাহাবাবুদের পাঠশালা – দুর্গামণ্ডপের সম্মুখে আটচালায় এই পাঠশালা বসিত। ক্ষুদিরাম গদাধরের পাঁচ বৎসর বয়সে এক শুভদিনে হাতে খড়ি দিয়া এই পাঠশালায় ভর্তি করিয়া দিয়াছিলেন। বর্ণপরিচয়, পরে হস্তলিখন ও সংখ্যা গণনা অভ্যাস শুরু হয়। তাঁহার হস্তাক্ষর অতি সুন্দর হইয়াছিল। ‘সুবাহুর পালা’ নামক তাঁহার স্বহস্তলিখিত পুঁথিতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। পুঁথিপাঠ তিনি ভালভাবেই করিতে পারিতেন।

গৌরহাটী গ্রাম – এই গ্রামে কামারপুকুর হইতে আরামবাগ হইয়া ৬।৭ মাইল পূর্ব-দক্ষণে যাইতে হয়। গদাধরের কনিষ্ঠা ভগিনী শ্রীমতী সর্বমঙ্গলার সহিত এই গ্রামের শ্রীরামসদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবাহ হইয়াছিল। রামসদয়ের ভগিনী শ্রীমতী শাকম্ভরীর সহিত ঠাকুরের মধ্যম ভ্রাতা শ্রীরামেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। গদাধর একবার গৌরহাটী গ্রামে গিয়া দেখেন তাঁহার কনিষ্ঠা ভগিনী প্রসন্নমুখে নিজের স্বামীর সেবা করিতেছেন।

চিনু শাঁখারির বাড়ি – কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গৃহ হইতে কিছু পূর্বদিকে ইহা অবস্থিত ছিল। বর্তমানে কেবল বাস্তুভিটা ভিন্ন বসতবাটীর অন্য কোন চিহ্ন নাই। সম্প্রতি এই স্থানটি শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ কর্তৃক গৃহীত হইয়াছে।

পাইনদের বাড়ি – বর্তমান মঠের দক্ষিণ দিকে পাইনদের বাড়ি। ইহাদের মধ্যে সীতানাথ পাইনের বাড়িতে গদাধর প্রায়ই যাইতেন।

ধনী কামারিনীর বাড়ি – লাহাবাবুদের দুর্গামণ্ডপের পূর্বদিকে ধরিয়া দক্ষিণ দিকে কিছু দূরে রাস্তার মোড়ের মাথায় ধনী কামারিনীর ভিটা। বর্তমানে এই ভিটায় একটি ছোট মন্দির আছে।

বুধুই মোড়লের শ্মশান – কামারপুকুর গ্রামের পূর্বপ্রান্তে ইহা অবস্থিত। সম্মুখে একটি ছোট পুষ্করিণী। চারিদিকে বট ও অন্যান্য বৃক্ষ আছে। এইখানে গদাধর পিতার দেহাবসানের পর শোকাচ্ছন্ন অবস্থায় একাকী বসিয়া থাকিতেন।

মুকুন্দপুরের বুড়ো শিব – এই মন্দিরে নিত্য পূজা ছাড়া বিশেষ বিশেষ দিনে যাত্রাগান প্রভৃতি হইত।

লাহাবাবুদের পান্থ নিবাস – শ্রীপুরের হাটতলা হইয়া যে পথ দক্ষিণে গিয়া অহল্যা বাঈ রোডের সঙ্গে মিশিয়াছে সেই চৌমাথার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ইহা অবস্থিত ছিল। ওই পান্থনিবাসের কিছু পূর্বে বর্ধমান যাইবার পথের নিকটে নূতন চটি। গদাধর এই সব স্থানে সাধুদর্শন করিয়া তাঁহাদের সহিত মেলামেশার জন্য যাইতেন ও তাঁহাদের যথাসাধ্য সেবা করিতেন। এইসব স্থান ব্যতীত গদাধর বাল্যকালে বিভিন্ন গ্রামের মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে বহুগৃহে ও বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন।

মানিক রাজার আম বাগান – ইহার ভুরসেবো (বর্তমান হরিসভা) গ্রামস্থ বাড়িতে গদাধর বাল্যে অনেকবার গিয়াছেন ও তাঁহাদের স্নেহ যত্ন বিশেষভাবে লাভ করিয়াছিলেন।

আনুড় গ্রাম – আনুড় গ্রামে ৺বিশালাক্ষীর মন্দির অবস্থিত। একবার দেবী দর্শনে গদাধর কামারপুকুরের মহিলা ভক্তদের সঙ্গে গমনকালে ভাবসমাধিস্থ হইয়া পড়েন। মহিলারা কাতরভাবে মায়ের নাম করিতে থাকায় তিনি স্বাভাবিক হন ও সকলে মিলিয়া ৺বিশালাক্ষীর দর্শন ও পূজাদি করিয়া ফিরিয়া আসেন।

গৌরহাটী গ্রাম – এই গ্রামে কামারপুকুর হইতে আরামবাগ হইয়া ৬।৭ মাইল পূর্ব-দক্ষণে যাইতে হয়। গদাধরের কনিষ্ঠা ভগিনী শ্রীমতী সর্বমঙ্গলার সহিত এই গ্রামের শ্রীরামসদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবাহ হইয়াছিল। রামসদয়ের ভগিনী শ্রীমতী শাকম্ভরীর সহিত ঠাকুরের মধ্যম ভ্রাতা শ্রীরামেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। গদাধর একবার গৌরহাটী গ্রামে গিয়া দেখেন তাঁহার কনিষ্ঠা ভগিনী প্রসন্নমুখে নিজের স্বামীর সেবা করিতেছেন।

দৃশ্যটি তাঁহার হৃদয়গ্রাহী হওয়ায় বাড়িতে ফিরিয়া স্বামী সেবানিরতা নিজের ভগিনীর একখানি ছবি আঁকিয়াছিলেন। উহাতে সর্বমঙ্গলার ও তাঁহার স্বামীর চেহারার সৌসাদৃশ্য দেখিয়া সকলে বিস্মিত হইয়াছিলেন। গৌরহাটী গ্রামে সম্প্রতি একটি শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির ও আশ্রম স্থানীয় ভক্তদের আগ্রহে শুরু হইয়াছে।

সরাটি মায়াপুর – আরামবাগ হইতে চয় মাইল পূর্বে এই গ্রাম। গদাধরের মাতুলালয়।

বালি দেওয়ানগঞ্জ – শ্রীশ্রীঠাকুর ও শ্রীশ্রীমা একবার হৃদয়ের সঙ্গে দেশে আসিবার পথে এই গ্রামে এক ভক্ত মোদকের নবনির্মিত গৃহে ত্রিরাত্র বাস করিয়াছিলেন। তখন বর্ষাকাল বলিয়া মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় হৃদয়ের অনিচ্ছাসত্ত্বেও শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্ত মোদকের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য তিন দিন-রাত্রি তাঁহার গৃহে অবস্থানপূর্বক স্থানীয় নরনারীদের নিকট ভগবৎপ্রসঙ্গাদি করিয়া আনন্দ দান করিয়াছিলেন।

বেলটে গ্রাম – এই গ্রাম কামারপুকুরের ৫।৬ মাইল পশ্চিম দক্ষিণে অবস্থিত। এই গ্রামের শ্রীনটবর গোস্বামীর সহিত শিহড়ে হৃদয়রামের বাড়িতে অবস্থানকালে শ্রীশ্রীঠাকুরের আলাপ পরিচয় হয়। একবার গোস্বামীজী তাঁহাকে নিজ বাটীতে লইয়া যান। তিনি ও তাঁহার স্ত্রী উভয়েই ভক্তিভরে শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবা করেন।

ফুলুই-শ্যামবাজার – শ্রীশ্রীঠাকুর একবার বেলটের পার্শ্ববর্তী ফুলুই-শ্যামবাজারে কীর্তন দেখিয়াছিলেন। নটবর গোস্বামীজীর ব্যবস্থায় সাতদিন ধরিয়া এই কীর্তন অহোরাত্র হয়।

কয়াপাট-বদনগঞ্জ গ্রাম – ফুলুই-শ্যামবাজারের নিকটবর্তী সম্মিলিত গ্রাম দুইটির নাম কয়াপাট-বদনগঞ্জ গ্রাম। শ্রীশ্রীঠাকুর একবার প্লীহা দাগানো চিকিৎসা করাইতে এই গ্রামে আসিয়াছিলেন। এখানে কীর্তনানন্দে একবার যোগদানও করিয়াছিলেন ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দে।

কোতলপুর গ্রাম – কথামৃতের ২।৪।১৮৮২ তারিখের পাদটীকায় আছে শিহোড় শ্যামবাজারে কীর্তনানন্দের পর ফিরিবার সময় এই গ্রামে ভদ্রদের বাড়িতে ৺দুর্গাসপ্তমী পূজার আরতি দর্শন করিয়াছিলেন। এই গ্রাম জয়রামবাটী হইতে ৬।৭ মাইল উত্তরে অবস্থিত।

গোঘাট – কামারপুকুর গ্রামের দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রায় ৪ মাইল দূরে আরামবাগ যাইবার পথে ইহা অবস্থিত। শ্রীশ্রীঠাকুর একবার ৺রঘুবীরের নামে জমি ক্রয় করাইয়া রেজিস্ট্রি করাইতে এখানকার রেজিস্ট্রি অফিসে আসিয়াছিলেন।

দক্ষিণেশ্বর ও নিকটবর্তী স্থান

দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ি – এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য রানী রাসমণি ১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা জমি ও কুঠিবাড়িটি বিয়াল্লিশ হাজার পাঁচশত টাকায় ক্রয় করেন। এই বিস্তৃত ভূখণ্ড ও কুঠিবাড়িটি প্রথমে ইংরেজ এটর্নি জেমস হেসটি সাহেবের ছিল। কিছু অংশে মুসলমানদের কবরডাঙ্গা, গাজীসাহেবের পীঠের স্থান, পুষ্করিণী ও আম বাগান ছিল।

এইস্থানের কিছু অংশ কূর্মপৃষ্ঠাকৃতি থাকায় শাস্ত্রানুসারে শক্তিমন্দির প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত স্থানরূপে নির্ণীত হয় এবং পরবর্তী কালে শিব শক্তি ও বিষ্ণু মন্দির নির্মিত হইয়া সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্ররূপে পরিণত হইয়াছে। গঙ্গার ধারে পোস্তা প্রভৃতিসহ মন্দির নির্মাণের কাজ ‘ম্যাকিন্‌টস্‌ আণ্ড বার্‌ন্‌’ কোম্পনি দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছিল। সমস্ত নির্মাণ কাজ শেষ হইতে নয় বৎসর সময় লাগে এবং খরচ হয় তখনকার দিনে নয় লক্ষ টাকা। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে মে, স্নানযাত্রার দিন।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণমথামৃতে দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ির বর্ণনা প্রসঙ্গে সমস্ত ক্ষেত্রটির শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত অনেক তথ্য দিয়াছেন। এখানে সংক্ষেপে ওই স্থানগুলির উল্লেখ করা হইতেছে:-

[গাজীতলা]

বর্তমানে এক বিরাট অশ্বত্থ গাছসহ স্থানটি বাঁধানো আছে এবং ছোট ফলকে পরমহংসদেবের সাধনস্থল বলিয়া লিখিত আছে।

[কুঠিবাড়ি]

রানী রাসমণি, মথুরবাবু ও পরে তাঁহাদের উত্তরাধিকারীগণ দক্ষিণেশ্বে আসিলে এখানে বাস করিতেন। শ্রীশ্রীঠাকুর এই কুঠিবাড়ির পশ্চিমের ঘরে দীর্ঘ ১৬ বৎসর বাস করিয়াছিলেন। পরে ভ্রাতুষ্পুত্র অক্ষয়ের দেহত্যাগের পর মন্দির প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম দিকের ঘরটিতে শেষ ১৪ বৎসর বাস করেন। এই কুঠিবাড়ির ছাদ হইতেই তিনি ভক্তদের আহ্বান করিয়াছিলেন।

[শিবমন্দির]

দ্বাদশ শিবমন্দিরের শিবলিঙ্গগুলির নাম – চাঁদনীর উত্তরদিকের মন্দিরসমূহের যথাক্রমে – যোগেশ্বর, যত্নেশ্বর, জটিলেশ্বর, নকুলেশ্বর, নাকেশ্বর ও নির্জরেশ্বর, আর চাঁদনীর দক্ষিণদিকের মন্দিরগুলির শিবলিঙ্গের নাম যথাক্রমে যজ্ঞেশ্বর, জলেশ্বর, জগদীশ্বর, নাগেশ্বর, নন্দীশ্বর ও নরেশ্বর। সোপকরণ নৈবেদ্যসহ প্রতি শিবকে নিত্যপূজা করা হয়। এতদ্ব্যতীত শিবরাত্রি, নীলপূজা ও চড়কের দিনে এবং স্নানযাত্রায় (দেবালয় প্রতিষ্ঠা দিবসে) বিশেষ পূজার ব্যবস্থা আছে। এই সব মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণ স্তোত্রপাঠাদি করিতেন।

[চাঁদনী]

দুইসারি শিবমন্দিরের মধ্যস্থলে চাঁদনী। এখানে সাধু, অতিথি, ও স্নানার্থীরা বিশ্রামাদি করেন। এখানেই শ্রীমৎ তোতাপুরী প্রথমে আসিয়াছিলেন।

[বিষ্ণুমন্দির]

শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে কিছুকাল পূজা করেন। এখানে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহদ্বয়ের নাম শ্রীশ্রীজগমোহিনী রাধা ও শ্রীশ্রীজগোহন কৃষ্ণ। নিত্য পূজা ও নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। বিশেষ পূজার ব্যবস্থা স্নানযাত্রা, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রাস প্রভৃতি বিশেষ দিনে আছে। এই মন্দিরের পার্শ্ববর্তী কক্ষে যে শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিটি দেখা যায় উহারই ভগ্নপদ শ্রীরামকৃষ্ণ কর্তৃক জোড়া দেওয়া হইয়াছিল। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে এই মূর্তির জোড়া দেওয়া অংশটি অঙ্গরাগের সময় পুনরায় ভগ্ন হওয়ায় নূতন মূর্তি শ্রীশ্রীরাধাবিগ্রহের নিকট স্থাপিত হইয়াছে, ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে।

[কালীমন্দির]

এই মন্দিরটির নবচূড়াবিশিষ্ট তিনটি স্তরে আছে। মন্দির শীর্ষের নিচু অংশে ৪টি চূড়া, তাহার উপরের স্তরে ৪টি ও সর্ব্বোচ্চস্থানে মূল চূড়া – মোট নয়টি। চূড়া ও মন্দির গাত্রের শিল্পকাজসমূহ স্থাপত্যশিল্পের অপূর্ব নিদর্শন। মন্দিরের দেবীর নাম শ্রীশ্রীজগদীশ্বরী কালী, কিন্তু তিনি ভবতারিণী নামেই সমধিক পরিচিতা। এখানে নিত্য পূজা হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে প্রায় তিন বৎসর পূজা করেন। পরে দিব্যোন্মত্তায় বৈধীপূজা করা সম্ভব ছিল না। তবে নিত্যই মায়ের মন্দিরে গিয়া প্রণামাদি করিতেন। সাধনকালে ব্যাকুলভাবে মায়ের নিকট প্রার্থনা, ও দিব্যভাবে মাকে খাওয়ানো শোয়ানো প্রভৃতি বিভিন্নভাবে সেবা করিতেন।

[নাটমন্দির]

কালীমন্দিরে প্রবেশ করিবার পূর্বে মন্দিরের দক্ষিণদিকে অবস্থিত ইহার উপরে উত্তরমুখী মহাদেব, নন্দী ও ভৃঙ্গীকে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রণাম করিতেন। এই নাটমন্দিরে ধর্মীয় সভায় ভৈরবী ব্রাহ্মণী শ্রীশ্রীঠাকুরকে সর্বজনসমক্ষে অবতার বলিয়া ঘোষণা করেন। নাটমন্দিরের দক্ষিণে বলিদানের স্থান।

[শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর]

মন্দির প্রাঙ্গনের উত্তর-পশ্চিমদিকের কক্ষটিতে শ্রীশ্রীঠাকুর দীর্ঘ ১৪ বৎসর কাল বাস করিয়াছেন। এই কালে কত সাধু, পণ্ডিত, ভক্ত, তাঁহার অন্তরঙ্গ গৃহী ও ত্যাগী ভক্তবৃন্দের সঙ্গে ভগবৎপ্রসঙ্গ, তাঁহার সাধনকালের কথা, কীর্তন, ভজন, ভাব, সমাধি অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। এই ঘরের পশ্চিমদিকের অর্ধচন্দ্রাকৃতি বারান্দায় দাঁড়াইয়া গঙ্গাদর্শন করিতেন। এই ঘরে বর্তমানে শ্রীশ্রীঠাকুরের তক্তাপোশ, চৌকীর উপর তাঁহার ফটো সযত্নে রক্ষিত হইয়া নিত্য পূজাদি হয়।

[নহবতখানা]

মন্দির প্রাঙ্গণের বাহিরে উত্তর ও দক্ষিণে অবস্থিত দুইটি নহবতখানা হইতে পূর্বে দিনে ছয়বার নহবত বাজানো হত। এখন আর হয় না। উত্তর দিকের নহবতখানার ঘরে ঠাকুরের মাতা চন্দ্রামণিদেবী বাস করিতেন। নিচের ঘরে শ্রীশ্রীমা দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালে দীর্ঘদিন বাস করিয়াছিলেন। এখন এই ঘরে শ্রীশ্রীমায়ের ফটোতে নিত্য পূজা হয়।

[পঞ্চবটী]

বট, অশ্বত্থ, নিম, আমলকি ও বেলগাছ রোপণ করিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর এই পঞ্চবটী তলায় অনেক কাল সাধন করিয়াছিলেন। বৃন্দাবনের রজঃ আনিয়া এখানে ছড়াইয়া দিয়া বলিয়াছিলেন, ‘এই স্থান এখন হইতে মহাতীর্থে পরিণত হইল।’ পঞ্চবটীর সাধন কুটিরে তোতাপুরীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণপূর্বক বেদান্তসাধনা করিয়া নির্বিকল্প সমাধি লাভ করিয়াছিলেন। এই সাধন কুটিরটি এখন একটি পাকা কুটিরে পরিণত হইয়াছে।

[বেলতলা]

এখানে পঞ্চমুণ্ডীর আসন (নর, সর্প, সারমেয়, বৃষ ও শৃগাল এই পঞ্চপ্রাণীর মুণ্ড) ব্রাহ্মণী স্থাপন করেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরকে ৬৪ প্রকার তন্ত্রের সাধন করান। এই সাধনবেদী পরে ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয়। এখন স্থানটিতে সিমেন্টের বেদী করিয়া ঘিরিয়া রাখা হইয়াছে। এই সব ক্ষেত্র ব্যতীত দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ির বর্ণনাতে হাঁসপুকুর, গাজীপুকুর, বকুলতলা, ভাণ্ডার, কর্মচারীদের থাকিবার স্থান প্রভৃতির বিবরণও মাস্টারমহাশয় দিয়াছেন।

মোল্লাপাড়ার মসজিদ – দক্ষিণেশ্বরের নিকটবর্তী এই মসজিদে ইসলামধর্ম সাধনকালে শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে নমাজ পড়িতে আসিয়াছিলেন।

কুয়ার সিং-এর আস্তানা – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরের বাগানের পাশে শিখ পল্টনদের নিবাস ছিল। ভক্তিমান কুয়ার সিং কালীবাড়ির উত্তরদিকে অবস্থিত সরকারী বারুদখানার পাহারাদার শিখ সৈন্যদলের হাবিলদার থাকার সময়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের সংস্পর্শে আসিয়া তাঁহার অনুরাগী হইয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে সাধুদের ভোজন করাইবার সময় নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার আস্তানায় লইয়া যান।

রসিক মেথরের বাড়ি – দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ির নিকট মেথর পল্লীতে রসিকের বাস ছিল। সে দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখিত। রসিকের ভক্তিতে ঠাকুর তাহাকে স্নেহ করিতেন। সাধনকালে ঠাকুর গোপনে রাত্রিতে রসিকের বাড়িতে গিয়া নর্দমা প্রভৃতি স্থান ধুইয়া নিজের মস্তকের কেশ দ্বারা সাফ করিতেন এবং মায়ের নিকট প্রার্থনা করিতেন তাঁহার ব্রাহ্মণত্বের অভিমান নাশ করিবার জন্য।

ধ্যানকালে একদিন তাঁহার মন রসিকের বাড়িতে চলিয়া গিয়াছিল। তখন তিনি মনকে ওইখানেই থাকার কথা বলিয়াছিলেন।

যদু মল্লিকের বাগানবাড়ি – দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরের সংলগ্ন দক্ষিণদিকে অবস্থিত। ভক্ত যদু মল্লিকের আন্তরিক আহ্বানে ঠাকুর এখানে তাঁহার সঙ্গে কখন কখনও মিলিত হইতেন। এইখানে ম্যাডোনা ক্রোড়ে শিশু যীশুর ছবি দেখিয়া ঠাকুর তন্ময় হইয়া গিয়াছিলেন।

শম্ভু মল্লিকের বাগানবাড়ি – দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়ির পাশেই শম্ভু মল্লিকের এই বাগানবাড়ি থাকায় ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হইয়াছিল। ঠাকুর মধ্যে মধ্যে তাঁহার বাগানে যাইতেন। এখানে তাঁহার নিকট হইতে বাইবেল ও যীশুর পবিত্র জীবনকথা শুনিয়া ঠাকুর খ্রীষ্টধর্ম সাধনায় ব্রতী হইয়াছিলেন। এ স্থানের এখন কোন চিহ্ন নাই।

তদনুসারে অনেক ভক্ত সঙ্গে একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর এই গ্রামে শুভাগমন করিয়া সকলকে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ ও কীর্তনাদি দ্বারা আনন্দদান করেন এবং এই ভক্তিমান ব্রাহ্মণের গৃহে ভক্তগণসঙ্গে আহারাদি করিয়া সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। এখানে সামাধ্যায়ী নামক এক পণ্ডিতের সহিত মহিম চক্রবর্তীর বিচারকালে পণ্ডিত যখন কোন কথা স্বীকার করিতেছিলেন না, তখন শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাকে স্পর্শ করিয়া তাঁহার নাস্তিক ভাব দূর করিয়া তাঁহাকে কৃপা করিয়াছিলেন।

শম্ভু নির্মিত শ্রীশ্রীমায়ের চালাঘর – কালীবাড়ির নহবতের সঙ্কীর্ণ ঘরে শ্রীশ্রীমায়ের বসবাসের কষ্ট দেখিয়া ভক্ত শম্ভুচরণ মন্দিরের বাগানের পাশেই একখণ্ড জমি ক্রয় করিয়া ঠাকুরের অন্য ভক্ত কাপ্তেনের সহায়তায় সেখানে মায়ের বসবাসের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করিয়া দানপত্র করিয়া দিয়াছিলেন।

নবীনচন্দ্র রায়চৌধুরীর বাড়ি – দক্ষিণেশ্বর গ্রামে সুবিখ্যাত সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়ি। যোগীন্দ্রের (স্বামী যোগানন্দের) পিতার এই বাড়িতে ঠাকুর কথকতা, শাস্ত্রকথা প্রভৃতি শুনিতে যাইতেন।

নবীন নিয়োগীর বাড়ি – দক্ষিণেশ্বরের বাচস্পতি পাড়া রোডে ঠাকুর তাঁহাদের বাড়িতে দুর্গোৎসবাদিতে নিমন্ত্রিত হইয়া শুভাগমন করিতেন। নীলকণ্ঠের যাত্রাগান শুনিতেও গিয়াছিলেন।

নবকুমার চাটুজ্যের বাড়ি – দক্ষিণেশ্বর নিবাসী এই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের গৃহে কোন কোন সময় ঠাকুর স্বেচ্ছায় গিয়া খুব তৃপ্তির সহিত আহার করিতেন।

বিশ্বাসদের বাড়ি – দক্ষিণেশ্বরে তাঁহাদের বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর উলোর বামনদাসের ভক্তির কথা শুনিয়া তাঁহার সহিত ঈশ্বরীয় আলাপ করিতে গিয়েছিলেন।

কৃষ্ণকিশোর ভট্টাচার্যের বাড়ি – দক্ষিণেশ্বরের পার্শ্ববর্তী আড়িয়াদহে এই ভাগ্যবান পরমভক্তের বাড়িতে ঠাকুর বহুবার শুভাগমন করিয়াছিলেন। অধ্যাত্ম রামায়ণ পাঠ শুনিয়া ও ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করিয়া অনেক সময় ঠাকুর তাঁহার গৃহে আহার করিতেন।

পণ্ডিত পদ্মলোচনের বাসা বাড়ি – আড়িয়াদহে মতান্তরে কামারহাটীতে গঙ্গাতীরে একটি বাগান বাড়িতে পণ্ডিতজী যখন শারীরিক অসুস্থতার জন্য অবস্থান করিতেছিলেন তখন ঠাকুর নিজেই তাঁহার সহিত দেখা করেন ও ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ কারিয়া তাঁহাকে আনন্দ দান করেন ও নিজেও আনন্দিত হন।

দেবমণ্ডল ঘাট – গঙ্গাতীরে এই ঘাটের চাঁদনিতে ভৈরবী ব্রাহ্মণী বাস করিতেন। এইখান হইতে প্রত্যহ দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে ঠাকুরের নিকট যাতায়াত করিতেন। দক্ষিণেশ্বরে নিবাসী ভক্ত নবীন নিয়োগীর সহধর্মিণী তাঁহাকে প্রয়োজনীয় আহার্য দ্রব্যাদি সরবরাহ করিতেন। এখানে ব্রাহ্মণীর অন্য দুই শিষ্য চন্দ্র ও গিরিজার সহিত শ্রীশ্রীঠাকুরের দেখা হয়।

গদাধরের পাটবাড়ি – ঠাকুর শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সহিত এখানে দর্শনাদির জন্য গিয়াছিলেন।

কোন্নগর – এই গ্রামের জমিদার ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ দক্ষিণেশ্বরে মন্দিরাদি দর্শন ও শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন, ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ ও কীর্তনাদি শ্রবণ করিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহাদের আগ্রহে শ্রীশ্রীঠাকুর কয়েকবার এখানে শুভাগমন করিয়াছিলেন। এই স্থানের পণ্ডিত দীনবন্ধু ন্যয়রত্ন, শ্রীযুক্ত নবাই চৈতন্য এবং তঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র মনোমোহন মিত্র শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশেষ অনুরাগী ও পরমভক্ত হইয়াছিলেন।

শ্রীরামপুর-মাহেশ – এই স্থানের জগন্নাথদেবের মন্দির বিখ্যাত। স্নানযাত্রা ও রথযাত্রায় খুব ভিড় হয়। দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালে শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তসঙ্গে দেবদর্শনে বিশেষত রথযাত্রায় অনেকবার এখানে আসিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিতে উল্লেখ আছে একবার মনোমোহন মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের ভ্রাতা গিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর সেবক লাটুসহ এখানে আসিয়া দেবদর্শন করেন।

বল্লভপুর – শ্রীশ্রীঠাকুর মাহেশের নিকটবর্তী বল্লভপুরে শ্রীশ্রীবল্লভজীর দর্শনে আসিতেন। মনোমোহন মিত্র, গিরীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই মন্দির দর্শনের কথা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিতে উল্লিখিত আছে।

ভদ্রকালী – দক্ষিণেশ্বরের অপরপারে ভদ্রকালী গ্রাম অবস্থিত। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিতে আছে পাঁচালী গায়ক শিবু আচার্যের গান শুনিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর মুগ্ধ হইলে শিবু তাঁহার ভক্তিমান শ্বশুরের বাড়ি ভদ্রকালী গ্রামে শ্রীশ্রীঠাকুরকে একবার শুভাগমন করিতে বিশেষ অনুরোধ করেন।

তদনুসারে অনেক ভক্ত সঙ্গে একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর এই গ্রামে শুভাগমন করিয়া সকলকে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ ও কীর্তনাদি দ্বারা আনন্দদান করেন এবং এই ভক্তিমান ব্রাহ্মণের গৃহে ভক্তগণসঙ্গে আহারাদি করিয়া সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। এখানে সামাধ্যায়ী নামক এক পণ্ডিতের সহিত মহিম চক্রবর্তীর বিচারকালে পণ্ডিত যখন কোন কথা স্বীকার করিতেছিলেন না, তখন শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাকে স্পর্শ করিয়া তাঁহার নাস্তিক ভাব দূর করিয়া তাঁহাকে কৃপা করিয়াছিলেন।

বালী – কালাচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে হরিসভায় – শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীমদ্‌ভাগবত পাঠ, ভগবৎ লীলাবিষয়ক কীর্তন বা যাত্রা শ্রবণের জন্য হরিসভা প্রভৃতি অনেক স্থলে গিয়াছিলেন। বালীতে ভক্ত কালাচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গৃহে হরিসভায় শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ ও কীর্তনে যোগ দিয়াছিলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিতে উল্লিখিত আছে।

বেলুড় – নেপালের কাঠের গুদাম – শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতকার শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলিতেন শ্রীশ্রীঠাকুর কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের অনুরোধে নেপালের কাঠের টালে (গুদাম), একবার আসিয়াছিলেন। তখন কাপ্তেনের এই কাঠের গুদাম ও গদী বর্তমান বেলুড় মঠের জমির উপর অবস্থিত পুরাতন মঠবাড়ি বলিয়া পরিচিত বাড়িটির সংলগ্ন উত্তরের একতলা অংশে ছিল। ইহা শ্রীমদর্শন ১৫শে খণ্ডে উল্লিখিত আছে।

মঠের প্রাচীন সন্ন্যাসীবৃন্দও মাস্টারমহাশয়ের কাছে একথা শুনিয়াছিলেন। মাস্টারমহাশয় শ্রীশ্রীঠাকুরের নিজমুখে একথা শুনিয়াছিলেন।

আলমবাজার – রাম চাটুজ্যের বাড়ি – দিব্যোন্মাদ অবস্থায় ঠাকুর কখন কখনও এই বাড়িতে আসিয়া আহার করিতেন। বিষ্ণুমন্দিরের পূজারী রাম চাটুজ্যে অন্য ব্যক্তি। তিনি দক্ষিণেশ্বরে বাস করিতেন।

নটবার পাঁজার বাড়ি – দক্ষিণেশ্বরের পার্শ্বে আলমবাজারে তাঁহার বাড়িতে ঠাকুর গিয়াছিলেন। (শ্রীমদর্শন – ১৫শ খণ্ড)

কবিরাজ ঈশানচন্দ্র মজুমদারের বাড়ি – মাস্টারমহাশয়ের ভগ্নীপতি ঈশানচন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের চিকিৎসা করিতেন। তাঁহার বরাহনগরের বাড়িতে ঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন (শ্রীমদর্শন)

পানিহাটী – দক্ষিণেশ্বরের উত্তরে গঙ্গাতীরে পানিহাটী। নিত্যানন্দ প্রভুর নির্দেশে বৈষ্ণব রঘুনাথ দাস এখানে জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে (মহাপ্রভুর উপদেশ অমান্য করার অপরাধের দণ্ড স্বরূপ) এই চিঁড়ার উৎসবের সূচনা। সেইজন্য ইহাকে দণ্ড মহোৎসব বলা হয়। রঘুনাথ দাসের পর পানিহাটী নিবাসী রাঘব পণ্ডিত এই উৎসব করিতেন বলিয়া ইহাকে রাঘব পণ্ডিতের চিঁড়ার মহোৎসবও বলা হইয়া থাকে।

কথক ঠাকুরদাদার বাড়ি – বরাহনগর কুঠিঘাট রোড নিবাসী পরম ভক্ত নারায়ণদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কথকতায় দক্ষ ছিলেন বলিয়া জনগণের নিকট কথকঠাকুর বা ঠাকুরদাদা নামে পরিচিত ছিলেন। কথামৃতেও তিনি ঠাকুরদাদা নামে উল্লিখিত হইয়াছেন। ঠাকুর এই বাড়িতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। (শ্রীমদর্শন – ১৫শে খণ্ড)

মণি মল্লিকের বাগানবাড়ি – বরাহনগরের এই বাগানবাড়িতে ঠাকুর আহার করিয়াছিলেন। এখানে মধ্যে মধ্যে আসিতেন।

জয় মিত্রের কালীবাড়ি – গঙ্গার ধারে বরাহনগরে ভক্তপ্রবর জয় মিত্রের কৃপাময়ী কালীমন্দিরে ঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন বলিয়া কোন কোন গ্রন্থে উল্লিখিত আছে।

ভাগবত আচার্যের পাটবাড়ি, বরাহনগর – বৈষ্ণবদের বিখ্যাত এই পাটবাড়িতে ঠাকুরের শুভাগমন হইয়াছিল। শ্রীম-দর্শন গ্রন্থের পঞ্চদশ ভাগে ইহার উল্লেখ আছে। যেহেতু ঠাকুর বরাহনগর অঞ্চলের অধিকাংশ দেবালয়েই যাতায়াত করিয়াছিলেন সেজন্য এই পবিত্র আশ্রমে তাঁহার আগমন স্বাভাবিক। শ্রীরঘুনাথ উপাধ্যায় একবার এই স্থানে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে তাঁহার ভজন কুটিরে ভাগবত পাঠ ও ব্যাখ্যা শুনাইয়াছিলেন। মহাপ্রভু তাঁহার পাঠে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে ‘ভাগবতাচার্য’ উপাধি দিয়াছিলেন।

ভাগবত পণ্ডিতের বাড়ি – ভাগবত পাঠ শুনিবার আগ্রহে ঠাকুর প্রথম জীবনে দক্ষিণেশ্বর হইতে বরাহনগরে এক ভাগবত পণ্ডিতের বাড়িতে নিত্য সন্ধ্যার সময় আসিতেন। ইহার উল্লেখ ‘বরাহনগর-আলমবাজার মঠ’ পুস্তকে আছে।

সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির – বরাহনগর বাজারের নিকট সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শুভাগমন করিয়াছিলেন। পূর্বোক্ত পুস্তকে ইহার উল্লেখ আছে।

প্রামাণিকদের ব্রহ্মময়ী কালীমন্দির – বরাহনগরের প্রামাণিক ঘাট রোডের উপর দে-প্রামাণিক বংশীয়দের প্রাচীন কালীমন্দিরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আসিয়াছিলেন। ভবতারিণী মূর্তির সহিত ইহার কোন সম্বন্ধ আছে; সেইজন্য এই মূর্তি ‘মাসিমা’ বলিয়া পরিচিত। পূর্বোক্ত পুস্তকে উল্লিখিত।

বরাহনগরে (প্রকৃতপক্ষে কাশীপুরে)কুঠিঘাটের দশমহাবিদ্যার মন্দির – শ্রীশ্রীঠাকুর মথুরবাবুর সহিত এই দেবালয় দর্শন করিতে আসিয়া ৺দেবীর ভোগের জন্য মাসিক বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন। পরবর্তী কালেও তিনি মধ্যে মধ্যে এখানে দর্শন করিতে আসিতেন।

ফাগুর দোকান – বরাহনগর বাজারে রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে ফাগুর প্রসিদ্ধ খাবারের দোকান ছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর ফাগুর দোকানের কচুরি ভালবাসিতেন। বর্তমানে সেখানে কয়েকটি মনোহারী দোকান ও একটি খাবারের দোকান (মুখরুচি) হইয়াছে।

বেলঘরিয়া – জয়গোপাল সেনের বাগান বাড়ি (তপোবন) – শ্রীশ্রীঠাকুর হৃদয়কে সঙ্গে লইয়া বেলঘরিয়ায় এই বাগান বাড়িতে (৮ নং বি. টি. রোড) আগমন করিয়া কেশবের সহিত প্রথম দেখা করেন এবং তাঁহার উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থা লক্ষ্য করিয়া প্রীত হল। এই সময় হইতে উভয়ের মধ্যে গভীর অন্তরঙ্গতার সূচনা (১৫-৩-১৮৭৫)।

আবার ১৪-৫-১৮৭৫ তারিখে ঠাকুর বেলঘরিয়ায় আসিয়া কেশবের সহিত ধর্মালোচনা করেন। এই সময়ে ধর্মতত্ত্ব নামে মাসিক পত্রিকায় ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত পরিচয় বাহির হয়। ১৫-৯-১৮৭৯ তারিখে ব্রাহ্মসমাজের ভাদ্রোৎসবের সময় কেশবের নিমন্ত্রণে ঠাকুর আর একবার বেলঘরিয়ায় এই তপোবনে যান।

দেওয়ান গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি – শ্রীশ্রীঠাকুর ১৮-২-১৮৮৩ তারিখে তাঁহার বেলঘরিয়ার বাড়িতে আসিয়াছিলেন। সেই দিন নামসংকীর্তন, ভজন, ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ ইত্যাদি ভক্তদের সঙ্গে করিয়াছিলেন। এইদিন হরিপ্রসন্ন (পরবর্তী কালে স্বামী বিজ্ঞানানন্দ) তাঁহাকে ভাবসমাধিস্থ অবস্থায় দর্শন করিয়াছিলেন।

কামারহাটী – গোপালের মার বাড়ি – গোবিন্দ দত্তের রাধাকৃষ্ণ মন্দির – পটলডাঙ্গার গোবিন্দচন্দ্র দত্তের এই ঠাকুর বাড়ি, কামারহাটীতে গোপালের মা বাস করিতেন। তিনি এখানে নিয়মিত ধ্যান, জপ, গঙ্গাস্নানাদি এবং ইষ্ট দেবতা গোপালের সেবা করিতেন।

৬২ বৎসর বয়সে শ্রীশ্রীঠাকুরের সাক্ষাতের পর তাঁহার ইষ্ট দর্শন ও ভাবে দিব্যদর্শনাদি হইয়াছিল। ঠাকুর রাখালচন্দ্রের (স্বামী ব্রহ্মানন্দের) সহিত একবার কামারহাটীতে গিয়া গোপালের মার সেবা গ্রহণ করেন। ইহার পূর্বেও দত্ত গৃহিণীর নিমন্ত্রণে ঠাকুর এই ঠাকুরবাড়িতে আসিয়াছিলেন।

পানিহাটী – দক্ষিণেশ্বরের উত্তরে গঙ্গাতীরে পানিহাটী। নিত্যানন্দ প্রভুর নির্দেশে বৈষ্ণব রঘুনাথ দাস এখানে জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে (মহাপ্রভুর উপদেশ অমান্য করার অপরাধের দণ্ড স্বরূপ) এই চিঁড়ার উৎসবের সূচনা। সেইজন্য ইহাকে দণ্ড মহোৎসব বলা হয়। রঘুনাথ দাসের পর পানিহাটী নিবাসী রাঘব পণ্ডিত এই উৎসব করিতেন বলিয়া ইহাকে রাঘব পণ্ডিতের চিঁড়ার মহোৎসবও বলা হইয়া থাকে।

পরবর্তী কালে পানিহাটীর সেন পরিবার এই উৎসব করেন। শ্রীশ্রীঠাকুর কয়েকবার এই উৎসবে যোগদান করেন।

মণিমোহন সেনের বাড়ি ও ঠাকুরবাড়ি – পানিহাটীর উৎসবে যোগদান কালে তাঁহার বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর শুভাগমন করিতেন ও তাঁহাদের ঠাকুরবাড়ি দর্শন করিতেন।

রাঘব পণ্ডিতের বাটী – পানিহাটী-মহোৎসবে যোগদান কালে কীর্তন দলের সহিত ভাবে নৃত্য ও গান করিতে করিতে ঠাকুর এখানে আসিতেন।

মতিশীলের ঠাকুরবাড়ি ও ঝিল – ১৮-৬-১৮৮৩ তারিখে ঠাকুর সদলবলে পানিহাটীর মহোৎসবে হইতে ফিরিবার পথে সন্ধ্যার সময় এই ঠাকুরবাড়ি ও ঝিল দর্শন করেন।

খড়দহ – শ্যামসুন্দর মন্দির – উত্তর-চব্বিশ পরগণা জেলার খরদহ রেলস্টেশন হইতে দুই মাইল পশ্চিমে গঙ্গার পূর্বকূলে শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরের মন্দির। ঠাকুর একবার দক্ষিণেশ্বর হইতে প্রভু নিত্যানন্দ বংশীয় গোস্বামীর সহিত আগমন করিয়া শ্রীবিগ্রহ দর্শন ও প্রসাদী ভোগ গ্রহণ করিতেন।

ব্যারাকপুর – চানকে অন্নপূর্ণা মন্দির – ব্যারাকপুরের দক্ষিণে গঙ্গাতীরবর্তী চানকে এই মন্দির ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল মথুরবাবুর ভক্তিমতী স্ত্রী শ্রীমতী জগদম্বা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরমধ্যে ৺অন্নপূর্ণাবিগ্রহ স্থাপিত হইয়াছিল। প্রতিষ্ঠা কার্যের সময় শ্রীশ্রীঠাকুর সেখানে গিয়াছিলেন।

তীর্থাদি ও অন্যান্য স্থান

আঁটপুর – এই গ্রামের জমিদার শ্রীরামপ্রসাদ মিত্র কলিকাতায় ঝামাপুকুরে একটি ভাড়াবাড়িতে থাকিতেন। সেই সময় (১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দ) শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহার অগ্রজ রামকুকারের টোলে থাকিতেন ও মিত্রমহাশয়ের বাসাতে প্রায়ই যাইতেন। মিত্রমহাশয়ের পুত্রদ্বয় শ্রীকালীচরণ (কালু) ও শ্রীউমাচরণ (ভুলু)-র সহিত তাঁহর বিশেষ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়।

সেই সূত্রেই ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে খুব সম্ভবত দুর্গাপূজায় নিমন্ত্রিত হইয়া গদাধর আঁটপুরে গিয়াছিলেন। এই গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম তড়া। সেইজন্য তখন ইহাকে তড়া-আঁটপুর বলা হইত। বাবুরাম (পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ) যখন প্রথম দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করেন, তখন তাঁহার বাড়ি তড়া-আঁটপুরে জানিয়া ঠাকুর তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, ‘তবে তো তোমাদের দেশেও একবার গেছি।’

জয়রামবাটী – শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর জন্মস্থান। বিষ্ণুপুর রেলওয়ে স্টেশন হইতে সাতাশ মাইল দূরে আমোদর নদের পার্শ্বে এই গ্রাম অবস্থিত। কলিকাতা হইতে সোজাপথে তারকেশ্বর হইয়া তেষট্টি মাইল। এখানে ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর, অগ্রাহায়ণ কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে পিতা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও মাতা শ্যামা সুন্দরী দেবীর গৃহে শ্রীশ্রীমা আবির্ভূতা হন।

ওই সময়ে ভাবাবেশে ঠাকুরের যে দেবী মূর্তির দর্শন হইয়াছিল তাহা বহুপূর্বেই ভগ্ন হওয়ার পরে নূতন মূর্তি মন্দিরে স্থাপিত হইয়াছিল। ভাবে দৃষ্ট দেবী মূর্তির মুখখানি এই নূতন মূর্তির মুখের ন্যায় ছিল না। পুরাতন মূর্তির মুখটি এক ব্রাহ্মণের গৃহে সযত্নে রক্ষিত ছিল। পরে অন্যমূর্তি গড়াইয়া এই মুখটি উহাতে সংযোজিত করিয়া লালবাঁধের পার্শ্বে অন্য মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং ইহার নিত্যপূজাদি হইতে থাকে।

১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে মে মাসের প্রথমার্ধে শ্রীশ্রীঠাকুরের সহিত তাঁহার শুভ বিবাহ হয়। বিবাহের পরও ঠাকুর কয়েকবার এখানে আসিয়াছিলেন। বর্তমানে মায়ের জন্মস্থানের উপর এপটি প্রশস্ত মন্দিরে শ্রীশ্রীমায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়া নিত্যপূজা ও উৎসবাদিতে বিশেষ পূজার অনুষ্ঠান হইয়া থাকে।

ভানু পিসীর বাড়ি – জয়রামবাটীতে পিত্রালয়ে বৈধব্য অবস্থায় বাস কালে ভানু পিসী শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিজ ইষ্টরূপে দর্শন করেন। ঠাকুর একদিন তাঁহার বাড়িতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। ভানু পিসীর প্রকৃত নাম মান গরবিনী। শ্রীশ্রীমা তাঁহাকে পিসী সম্বোধন করিতেন বলিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহার নাম দিয়াছিলেন ভানু পিসী।

সিংহবাহিনীর মন্দির – জয়রামবাটীতে এই প্রাচীন মন্দিরে শ্রীশ্রীমা তাঁহার কঠিন আমাশয় রোগের উপশমের জন্য ‘হত্যা’ দিয়াছিলেন এবং ৺সিংহবাহিনীর ঔষধে আরোগ্যলাভ করিয়াছিলেন। সেই অবধি এই দেবীর মাহাত্ম আরও প্রচার লাভ করে।

শিহড় – শ্রীশ্রীঠাকুরের পিসতুত ভগিনী হেমাঙ্গিনী দেবীর পুত্র হৃদয়রামের বাড়ি। শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে কয়েকবার আসিয়াছিলেন। ইহা কামরপুকুর গ্রামের প্রায় পাঁচ মাইল উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। একবার পালকিতে কামারপুকুর হইতে শিহড় গ্রামে যাওয়ার সময় ঠাকুর দেখিয়াছিলেন তাঁহার দেহ হইতে দুইটি কিশোর বয়স্ক সুন্দর বালক বাহির হইয়া মাঠের মধ্যে বনপুষ্পাদি অন্বেষণ, কখনও বা পালকির নিকটে আসিয়া হাস্য পরিহাস, কথোপকথনাদি করিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত এইরূপ আনন্দ করিয়া তাহারা পুনরায় তাঁহার দেহে প্রবেশ করিল। ভৈরবী ব্রাহ্মণী এই দর্শনের কথা পরবর্তী কালে ঠাকুরের নিকট শুনিয়া তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, ‘এইবার নিত্যানন্দের খোলে চৈতন্যের আবির্ভাব – শ্রীনিত্যানন্দ, শ্রীচৈতন্য এইবার একসঙ্গে একাধারে আসিয়া তোমার ভিতরে রহিয়াছেন।’

বিষ্ণুপুর – ৺মৃন্ময়ী মন্দির – ঠাকুর একবার কামারপুকুর হইতে শিহড়ে হৃদয়ের গৃহে অবস্থানকালে একটি মোকদ্দমায় সাক্ষ্য দিতে বিষ্ণুপুর আদালতে গিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামলা আপসে মিটিয়া যাওয়ায় সাক্ষ্য দিতে হয় নাই। সেই সময় ঠাকুর বিষ্ণুপুর শহরের লালবাঁধ ইত্যাদি দীঘি, অনেক দেব-মন্দির ইত্যাদি দেখিয়াছিলেন। বিষ্ণুপুরের রাজাদের প্রতিষ্ঠিত ৺মৃন্ময়ী দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা ছিলেন।

ওই সময়ে ভাবাবেশে ঠাকুরের যে দেবী মূর্তির দর্শন হইয়াছিল তাহা বহুপূর্বেই ভগ্ন হওয়ার পরে নূতন মূর্তি মন্দিরে স্থাপিত হইয়াছিল। ভাবে দৃষ্ট দেবী মূর্তির মুখখানি এই নূতন মূর্তির মুখের ন্যায় ছিল না। পুরাতন মূর্তির মুখটি এক ব্রাহ্মণের গৃহে সযত্নে রক্ষিত ছিল। পরে অন্যমূর্তি গড়াইয়া এই মুখটি উহাতে সংযোজিত করিয়া লালবাঁধের পার্শ্বে অন্য মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং ইহার নিত্যপূজাদি হইতে থাকে।

বর্ধমান – কামারপুকুর হইতে দক্ষিণেশ্বর যাতায়াতের পথে ঠাকুর কখনও কখনও বর্ধমান হইয়া গমনাগমন করিতেন।

কালনা – ভগবানদাস বাবাজীর আশ্রম – মথুরবাবুর সহিত শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে শুভাগমন করিয়াছিলেন। এখানে ভগবানদাস বাবাজীর সহিত তাঁহার মিলনের ফলে বাবাজী তাঁহাকে যথার্থ মহাপুরুষ বলিয়া বুইতে পারিয়াছিলেন।

নদীয়া – নবদ্বীপ ধাম – শ্রীশ্রীঠাকুর মথুরবাবুর সহিত নবদ্বীপ ধাম দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। মহাপ্রভুর দেবভাবের প্রকাশ নবদ্বীপে বহু গোঁসাইর বাড়িতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কিছুই অনুভব না হওয়ায় দুঃখিত হন। ফিরিবার কালে নৌকাতে উঠিবার সময় এক অদ্ভুত দিব্যদর্শন হয়। দিব্যদর্শনটি এইরূপ – দুইটি সুন্দর কিশোর তপ্তকাঞ্চনের মতো রঙ, মাথায় একটি করিয়া জ্যোতিমণ্ডল, হাত তুলিয়া হাসিতে হাসিতে তাঁহার দিকে আকাশ পথ দিয়া ছুটিয়া আসিতেছিল।

ঠাকুর চিৎকার করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘ওই এলোরে, ওই এলোরে!’ তাঁহারা নিকটে আসিয়া ঠাকুরের দেহে প্রবেশ করায় ঠাকুর বাহ্যজ্ঞানহারা হইয়াছিলেন। ইহা হইতে বুঝা যায় শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর লীলাস্থান পুরাতন নবদ্বীপ গঙ্গাগর্ভে লীন হইয়াছে।

ঠাকুর ৺কাশীতে ত্রৈলঙ্গস্বামীর দর্শন লাভ করেন। নিজের হাতে ঠাকুর একদিন তাঁহাকে পায়েস খাওয়াইয়াছিলেন। ৺কাশীতে একদিন নানকপন্থী সাধুদের মঠে নিমন্ত্রিত হইয়া ঠাকুর গিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে মুখ করিয়া অল্পবয়স্ক এক সাধু গীতা পাঠ করিয়াছিলেন। সেই সাধু ঠাকুরকে বলিয়াছিলেন ‘কলিযুগে নারদীয় ভক্তি।’ ৺কাশীতে একদিন ভৈরব-ভৈরবীদের চক্রে আহূত হইয়া শ্রীশ্রীঠাকুর গিয়াছিলেন।

কলাইঘাট – রানাঘাটের নিকট এই স্থানে মথুরবাবুর জমিদারি মহল দেখিতে গিয়া কলাইঘাটবাসী স্ত্রী-পুরুষগণের দুর্দশা ও অভাব দেখিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর দুঃখে কাতর হন এবং মথুরবাবুর দ্বারা নিমন্ত্রণ করিয়া তাহাদিগকে এক-মাথা তেল, এক-একখানি নূতন কাপড় ও পেট ভরিয়া একদিনের ভোজন দান করাইয়াছিলেন।

সোনাবেড়ে – সাতক্ষীরার নিকট সোনাবেড়ে গামে মথুরবাবুর পৈত্রিক ভিটা ছিল। ইহার সন্নিহিত গ্রামগুলিও তাঁহার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঠাকুরকে সঙ্গে লইয়া মথুরবাবু ওইস্থানে গমন করিয়াছিলেন।

তালমাগরো – সোনাবেড়ের অনতিদূরে এই গ্রামে মথুরবাবুর গুরুগৃহ ছিল। গুরুবংশীয়দিগের আমন্ত্রণে মথুরবাবু তথায় গিয়াছিলেন। এই সময়ে ঠাকুর ও হৃদয়কে হস্তীপৃষ্ঠে বসাইয়া লইয়া গিয়াছিলেন এবং সেখানে কয়েকসপ্তাহ কাটাইয়াছিলেন।

দেওঘর – ৺বৈদ্যনাথ ধাম – শ্রীশ্রীঠাকুর দুইবার এখানে আসিয়াছিলেন ৺কাশীধাম গমনের পথে। প্রথমবার ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে। সে সময়কার বিবরণ কিছু জানা যায় না। ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে জানুয়ারির শেষদিকে মথুরবাবু তাঁহাকে লইয়া এখানে আসিয়াছিলেন। সে সময় হৃদয় তাঁহার সঙ্গী ছিলেন। ৺বৈদ্যনাথ মহাদেবের পূজা ও দর্শনাদি করিয়া কয়েকদিন এই তীর্থে অবস্থান করিয়াছিলেন।

সে সময় একদিন একটি পল্লীর দরিদ্র লোকদের দুঃখ দুর্দশা দর্শনে ঠাকুর অত্যন্ত বিচলিত হইয়া মথুরবাবুকে বলিলেন, ‘তুমি তো মার দেওয়ান, এদের এক-মাথা করে তেল আর একখানা করে কাপড় দাও, আর পেট ভরে একদিন খাইয়ে দাও।’ মথুর উত্তরে বলিয়াছিলেন, ‘বাবা তীর্থে অনেক খরচ হবে, এও দেখছি অনেক লোক; এদের খাওয়াতে হলে অনেক টাকা লাগবে – এ অবস্থায় কি বলেন?’

‘দূর শালা তোর কাশী তাহলে আমি যাব না, আমি এদের কাছেই থাকব; এদের কেউ নেই এদের ছেড়ে যাব না।’ – এই বলিয়া ঠাকুর কাঁদিতে কাঁদিতে লোকগুলির মধ্যে গিয়া বসিয়া পড়িলেন। মথুরবাবু তখন কলিকাতায় লোক পাঠাইয়া অনেক কাপড় আনাইয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছানুযায়ী লোকগুলির সেবা করিয়াছিলেন।

৺কাশীধাম – শ্রীশ্রীঠাকুর দুইবার এই তীর্থে আগমন করিয়াছিলেন কথামৃতে উল্লিখিত আছে। একবার ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে। সঙ্গে তাঁহার মা, শ্রীরাম চাটুজ্যে ও মথুরবাবুর কয়েকজন পুত্র। সে সময় কাশী পর্যন্ত রেলপথে যাতায়াত সবে শুরু হইয়াছে। শ্রীশ্রীঠাকুরের তখন সাধনাবস্থার ৫/৬ বৎসরের মধ্যে। সে সময় তিনি প্রায়ই সমাধিস্থ অথবা ভাবে মাতোয়ারা হইয়া থাকিতেন।

১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয়বার ৺কাশী দর্শনকালে সঙ্গে মথুরবাবু ও তাঁহার স্ত্রী জগদম্বা দাসী ছিলেন। হৃদয়ও সঙ্গে ছিলেন। এ সময়ে মথুরবাবু তাঁহার সঙ্গে শতাধিক ব্যক্তিকে লইয়া আসিয়াছিলেন। কেদার ভাটের নিকট দুইটা ভাড়া বাড়িতে তাঁহারা ছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর ভাবচক্ষে ৺কাশীধামকে স্বর্ণময়রূপে দেখেন।

ঠাকুর ৺কাশীতে ত্রৈলঙ্গস্বামীর দর্শন লাভ করেন। নিজের হাতে ঠাকুর একদিন তাঁহাকে পায়েস খাওয়াইয়াছিলেন। ৺কাশীতে একদিন নানকপন্থী সাধুদের মঠে নিমন্ত্রিত হইয়া ঠাকুর গিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে মুখ করিয়া অল্পবয়স্ক এক সাধু গীতা পাঠ করিয়াছিলেন। সেই সাধু ঠাকুরকে বলিয়াছিলেন ‘কলিযুগে নারদীয় ভক্তি।’ ৺কাশীতে একদিন ভৈরব-ভৈরবীদের চক্রে আহূত হইয়া শ্রীশ্রীঠাকুর গিয়াছিলেন।

নিধুবনে গঙ্গামাতার দর্শনলাভ করেন। গঙ্গামাতাজী শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যে শ্রীরাধার প্রকাশ দেখিয়া তাঁহাকে ‘দুলালী’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন ও তাঁহাকে নানাভাবে সেবা করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রতি আকর্ষণে শ্রীশ্রীঠাকুর বৃন্দাবন ছাড়িয়া আর কোথাও যাইবেন না বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু মথুরবাবু ও হৃদয়ের অনুরোধে দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার বৃদ্ধা মাতা চন্দ্রাদেবীর শোক-তাপের কথা মনে পড়ায় ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।

৺কাশীর মদনপুরা পল্লীতে শ্রীশ্রীঠাকুর বীণাবাদক মহেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতে তাঁহার বীণা বাদন শুনিয়া আনন্দিত হইয়াছিলেন। চৌষট্টি যোগিনী ঘাটের নিকট যোগেশ্বরী ভৈরবী ব্রাহ্মণীকে (শ্রীশ্রীঠাকুরের তন্ত্র সাধনার গুরু) দেখিয়া ঠাকুর তাঁহার মনোবেদনা দূর করিয়া ৺বৃন্দাবনে লইয়া গিয়াছিলেন।

শ্রীশ্রীঠাকুরের আজ্ঞায় মথুরবাবু এখানে একদিন কল্পতরু হইয়া নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য বস্ত্র, কম্বল, পাদুকা প্রভৃতি যে যাহা চাহিয়াছিল, দান করিয়াছিলেন। মথুরবাবুর অনুরোধে ঠাকুর একটি কমণ্ডলু চাহিয়া লইয়াছিলেন।

প্রয়াগ ও ত্রিবেণী – শ্রীশ্রীঠাকুর ১৮৬৩ খ্রী: ও ১৮৬৮ খ্রী: দুইবার প্রয়াগে তীর্থদর্শনে আসিয়াছিলেন। মথুরবাবুর সহিত ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ৺কাশী ধাম হইতে প্রয়াগে আসিয়া গঙ্গা-যমুনা-সঙ্গমে স্নান ও ত্রি-রাত্রি বাস করিয়াছিলেন।

৺শ্রীবৃন্দাবন ও মথুরাধাম – ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রয়াগ হইতে কাশীতে ফিরিয়া এক পক্ষকাল পরে শ্রীশ্রীঠাকুর মথুরবাবুর সঙ্গে ৺বৃন্দাবন ও মথুরাধামে আগমন করিয়াছিলেন। ভৈরবী ব্রাহ্মণীকেও তিনি কাশী হইতে লইয়া আসিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণী ৺বৃন্দাবন ধামে শেষ জীবন অতিবাহিত করিয়া এখানেই দেহত্যাগ করেন। বিভিন্ন সময়ে কথামৃতে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহার মথুরা ও বৃন্দাবনের পথে মথুরায় নামিয়া তাঁহারা লীলাস্থানসমূহ দর্শন করেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর ধ্রুব ঘাটে বসুদেবের কোলে শিশু কৃষ্ণের যমুনা পার হওয়া ভাবচক্ষে দর্শন করিয়াছিলেন। এখানে স্বপ্নে রাখালকৃষ্ণকে দর্শন করিয়াছিলেন। বৃন্দাবনে আসিয়া তিনি শ্রীশ্রীগোবিন্দজীর মন্দিরের নিকট বাড়িতে – চৈতন্য ফৌজদার কুঞ্জে ছিলেন। বৃন্দাবনে ফিরতি গোষ্ঠে শ্রীকৃষ্ণ গোপালবালকদের সহিত ধেনু লইয়া যমুনা পার হইতেছেন – ভাবচক্ষে শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শন করিয়া বিহ্বল হইতেন।

৺গোবিন্দজীর মন্দির দর্শন করিবার পর পুনরায় গোবিন্দজীকে দেখিতে চাহেন নাই। ৺বঙ্কুবিহারীকে দেখিয়া ভাব হইয়াছিল। গোবর্ধন গিরি দেখামাত্রই ছুটিয়া উহার উপর উঠিয়া বিহ্বল ও বাহ্যশূন্য হন। পাণ্ডারা ধীরে ধীরে নামাইয়া আনিয়াছিল। পালকি করিয়া ৺শ্যামকুণ্ড ও ৺রাধাকুণ্ড দর্শনে হৃদয়ের সঙ্গে গিয়াছিলেন। পালকিতে ভাবাবেগে বিহ্বল হইয়া অনেক সময় পালকি হইতে লাফাইয়া পড়িতে চাহেন।

হৃদয় বেহারাদের সঙ্গে সঙ্গে যাইতেন ও তাহাদের খুব সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন। এইসব লীলাস্থলের পথে কৃষ্ণের বিরহে শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখের জলে কাপড় ভিজিয়া যাইত। তিনি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেন, ‘সেইসব আছে, কৃষ্ণরে তুই কোথায়।’

নিধুবনে গঙ্গামাতার দর্শনলাভ করেন। গঙ্গামাতাজী শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যে শ্রীরাধার প্রকাশ দেখিয়া তাঁহাকে ‘দুলালী’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন ও তাঁহাকে নানাভাবে সেবা করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রতি আকর্ষণে শ্রীশ্রীঠাকুর বৃন্দাবন ছাড়িয়া আর কোথাও যাইবেন না বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু মথুরবাবু ও হৃদয়ের অনুরোধে দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার বৃদ্ধা মাতা চন্দ্রাদেবীর শোক-তাপের কথা মনে পড়ায় ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।

বৃন্দাবনে এক পক্ষকাল অবস্থানের সময় শ্রীশ্রীঠাকুর অধিকাংশ সময় ভাবাবেগে বিহ্বল হইয়া থাকিতেন বলিয়া পদব্রজে দর্শনাদি করিতে পারিতেন না। পালকিতেই তাঁহাকে যাইতে হইত। এমনকি যমুনাতেও স্নানের সময়ও পালকিতে বসিয়া স্নান করিতেন।

কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী স্থান

নাথের বাগান – এই স্থান কলিকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে অবস্থিত। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামকুমারের সহিত ১৭ বৎসর বয়সে গদাধর এখানে কিছুদিন ছিলেন।

ঝামাপুকুর – গোবিন্দ চাটুজ্যের বাড়ি – গোবিন্দ চাটুজ্যের বাড়ি – বাড়ির ঠিকানা ৬১ বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকতা-৯। এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর (তখন গদাধর) কিছুদিন বাস করিয়া দেবদেবীর পূজা করিতেন। বর্তমানে ঝামাপুকুরে যে রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে, তখন এই মন্দিরের রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ গোবিন্দ চাটুজ্যের বাড়িতে পূজা পাইতেন। বাড়িটি একতলা এবং খুবই পুরাতন।

স্বামী সুবোধানন্দের বাড়ি – ঝামাপুকুরে অবস্থানকালে সুবোধের (পরবর্তী কালে শ্রীশ্রীঠাকুরের অন্যতম পার্ষদ স্বামী সুবোধানন্দ) ঠনঠনিয়ার বাড়িতে কয়েকবার গিয়াছিলেন। তখন সুবোধের জন্ম হয় নাই। পরবর্তী কালে সুবোধ ছাত্রাবস্থায় প্রথম দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের দর্শনের জন্য গেলে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘যখন ঝামাপুকুরে ছিলুম তোদের সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, তোদের বাড়িতে কতবার গেছি। তুই তখন জন্মাসনি।’

দিগম্বর মিত্রের বাড়ি – ঝামাপুকুরে অবস্থান কালে গদাধর এই বাড়িতে ৺নারায়ণ পূজা করিতেন। সেজন্য নিত্যই তাঁহাকে এখানে আসিতে হইত। দিগম্বর মিত্রের এই বিরাট প্রাসাদের অধিকাংশই বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। দিগম্বর মিত্রের এই বাড়িটি ‘ঝামাপুকুর রাজবাড়ি’ নামে খ্যাত। ঠিকানা: ১ নং ঝামাপুকুর লেন, কলি-৯।

ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি – ঝামাপুকুরে বাসকালে গদাধর এই মন্দিরের মা সিদ্ধেশ্বরী কালী দর্শনে আসিতেন এবং দেবীকে গান শুনাইতেন। পরবর্তী কালেও এই মন্দিরে অনেকবার আসিয়া দেবীদর্শন ও পূজাদি দিয়াছিলেন। এই মন্দির ১১১০ বঙ্গাব্দে মহাত্মা শঙ্কর ঘোষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। এই ভক্ত শঙ্কর ঘোষই দেবীর মাটির মূর্তির বদলে প্রস্তর মূর্তি স্থাপন করেন।

শ্রীশ্রীঠাকুরের অন্যতম পার্ষদ স্বামী সুবোধানন্দজী এই শঙ্কর ঘোষের প্রপৌত্র। শঙ্কর ঘোষের বংশধরগণই এখন এই কালীমাতার সেবাইত। ঠিকানা: ২২০।২ বিধান সরণি, কলিকাতা – ৬।

ঝামাপুকুর চতুষ্পাঠী – ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে ঝামাপুকুরে ছাত্রদের পড়াইবার জন্য রামকুমার (ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) এই টোল বা চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন। সাংসারিক অভাব অনটনের জন্য তাঁহাকে কলিকতায় আসিয়া এই কাজ করিতে হইয়াছিল। বর্তমানে এই টোলের কোন অস্তিত্ব নাই। সেই ভিটাতেই রাধাকৃষ্ণের মন্দির স্থাপিত হইয়া নিত্যপূজা হয়। ঠিকানা – ৬১ নং বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলিকাতা-৯।

ঠাকুরের দাদার বাসা – এই বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে একই সারিতে একটু পূর্বে ৩/৪ টি বাড়ির পরে ঠাকুর দাদার সহিত একই বাসাতে থাকিতেন। খোলার বাড়ি ছিল। লাহাদের বাড়ির বিপরীত দিকে রাস্তার উত্তরে উহা অবস্থিত ছিল। এখন সে সব বাড়ি ভাঙ্গিয়া বড় পাকা বাড়ি হইয়াছে।

নকুর বাবাজীর দোকান – গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের এই দোকানে ঠাকুর ঝামাপুকুরে অবস্থানকালে অনেক সময়ে গিয়া বসিতেন। বৈষ্ণব নকুড় বাবাজী কামারপুকুর অঞ্চলের লোক ছিলেন।

স্বামী সুবোধানন্দের বাড়ি – ঝামাপুকুরে অবস্থানকালে সুবোধের (পরবর্তী কালে শ্রীশ্রীঠাকুরের অন্যতম পার্ষদ স্বামী সুবোধানন্দ) ঠনঠনিয়ার বাড়িতে কয়েকবার গিয়াছিলেন। তখন সুবোধের জন্ম হয় নাই। পরবর্তী কালে সুবোধ ছাত্রাবস্থায় প্রথম দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের দর্শনের জন্য গেলে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘যখন ঝামাপুকুরে ছিলুম তোদের সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, তোদের বাড়িতে কতবার গেছি। তুই তখন জন্মাসনি।’

আমহার্ষ্ট স্ট্রীটে লং সাহেবের গির্জা – হোলি ট্রিনিটি চার্চ (বর্তমান ঠিকানা ৩৩/বি, রামমোহন সরণি।) মধ্যে কলিকাতার বৈঠকখানা অঞ্চলে খ্রীষ্টধর্মের প্রোটেষ্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের বিরাট গির্জা। ভক্ত মথুরবাবুর সহিত শ্রীরামকৃষ্ণ এখানে শুভাগমন করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর খ্রীষ্টের ভাবে তিনদিন দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানের সময় পঞ্চবটী তলায় যীশু খ্রীষ্টের দর্শন লাভ করেন।

প্রথমে এই বাড়ির নম্বর ছিল ২৩ নং শঙ্কর ঘোষ লেন। এখন নম্বর হইয়াছে ৮১ নং শঙ্কর ঘোষ লেন, কলিকাতা-৯। এই বাড়িটি দোতলা ও অতি প্রাচীন। এই বাড়িতেই স্বামী সুবোধানন্দের জন্ম হইয়াছিল। এখানেই শ্রীশ্রীঠাকুর আসিতেন।

ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি – ১৯ নং কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীট, শ্রীশ্রীঠাকুরের এই বাড়িতে দুইবার শুভাগমন করিয়াছিলেন। ঈশানবাবুর বাড়িতে তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র শ্রীশচন্দ্রের সহিত ঠাকুরের আলাপ হইয়াছিল ২৫-৬-১৮৮৪ তারিখে। এখান হইতে ঠনঠনিয়ার শশধর পণ্ডিতকে দেখিতে যান।

রাজেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ি – গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের মোড়ে ১৪ নং বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলি-৯, ঠনঠনে, বেচু চ্যাটার্জীর স্ট্রীটে তাঁহার বাড়ি। ১০-১২-১৮৮১ তারিখে ঠাকুর এখানে শুভাগমন করিয়া ভাবে নৃত্যভজন ও ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করিয়াছিলেন। কেশবচন্দ্র সেনও ওইদিন উপস্থিত ছিলেন।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর বাড়ি – ২৭ নং ঝামাপুকুর লেনের ভাড়াটিয়া বাড়িতে (মেছুয়া বাজার যাইতে বামদিকে) বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী থাকিতেন। তাঁহার অসুখের সময় ঠাকুর তাঁহাকে দেখিতে এই বাড়িতে আসিয়াছিলেন।

নববিধান ব্রাহ্মসমাজ, মেছুয়াবাজার – ৯৫ নং কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রীট, কলিকতা-৯। এখানে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রায়ই আসিতেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রসিদ্ধ নেতা আচার্য কেশবচন্দ্র সেন তাঁহার অনুগামীদের মধ্যে মত বিরোধের ফলে ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে পৃথক ভাবে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ইহার পরবর্তী নামই নববিধান ব্রাহ্মসমাজ। সমাজমন্দিরটি ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত।

কেশব সেনর বাড়ি – ‘লিলি কটেজ’ (কমল কুটির) – মেছুয়াবাজার ও সারকুলার রোডের মোড়ে ইহা অবস্থিত। এখানে ঠাকুর কয়েকবার আসিয়াছিলেন। এই বাড়ির উপরের ঠাকুর ঘরে শ্রীশ্রীঠাকুরকে কেশব সমাদরে বসাইতেন। এইখানেই শ্রীশ্রীঠাকুরের দণ্ডায়মান অবস্থায় সমাধিস্থ ফটো তোলা হয়। বর্তমান ঠিকানা ৭৮/বি, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, রাজাবাজার, কলি-৯।

ড: বিহারীলাল ভাদুড়ীর বাড়ি – তাঁহার বাড়ি ছিল কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে। ঠাকুর সিমলায় মনোমোহন মিত্র ও রাম দত্তের বাড়িতে আসিলে এই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক তাঁহাকে একবার নিজ বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য লইয়া গিয়াছিলেন।

জ্ঞান চৌধুরীর বাড়ি – সিমুলিয়ায় তাঁহার বাড়িতে আয়োজিত ব্রাহ্ম সমাজের মহোৎসব উপলক্ষে শ্রীশ্রীঠাকুর শুভাগমন করিয়া কেশবাদি ব্রাহ্ম ভক্তগণের সঙ্গে ১-১-১৮৮২ তারিখে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ, নৃত্য গীত ইত্যাদি করিয়াছিলেন।

সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ – পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, আচার্য বিজয়কৃষ্ণ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্রাহ্ম নেতাদের প্রতিষ্ঠিত ঠনঠনে অঞ্চলে (২১১ বিধান সরণী) অবস্থিত। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে কয়েকবার শুভাগমন করিয়াছিলেন। নববিধান তথা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে এই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সৃষ্টি এবং ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে সমাজমন্দিরের প্রতিষ্ঠা।

বাদুড়বাগানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাড়ি – বর্তমানে ৩৬ নং বিদ্যাসাগর স্ট্রীট, কলিকাতা-৯। শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে মাস্টারমহাশয়ের সঙ্গে আসিয়াছিলেন। বর্তমানে সেই বাড়ির পূর্বাবস্থা নাই।

বাদুড়বাগানে নবগোপাল ঘোষের বাড়ি – শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহার বাদুড় বাগনের বাড়িতে একদিন মহোৎসব উপলক্ষে শুভ পদার্পণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের চণ্ডীমণ্ডপে ভাগবত পাঠ পদাবলী কীর্তন শ্রবণ করিয়া কীর্তন মধ্যে ত্রিভঙ্গমুরলীধারী হইয়া অবস্থান করিয়াছিলেন। নবগোপালবাবু ঠাকুরের সেইদিন ভুবনমোহন রূপ দর্শন করিয়াছিলেন।

আমহার্ষ্ট স্ট্রীটে লং সাহেবের গির্জা – হোলি ট্রিনিটি চার্চ (বর্তমান ঠিকানা ৩৩/বি, রামমোহন সরণি।) মধ্যে কলিকাতার বৈঠকখানা অঞ্চলে খ্রীষ্টধর্মের প্রোটেষ্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের বিরাট গির্জা। ভক্ত মথুরবাবুর সহিত শ্রীরামকৃষ্ণ এখানে শুভাগমন করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর খ্রীষ্টের ভাবে তিনদিন দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানের সময় পঞ্চবটী তলায় যীশু খ্রীষ্টের দর্শন লাভ করেন।

তাঁহার শরীরে যীশুর প্রবেশ পূর্বক লীন হওয়া প্রত্যক্ষ করিয়া তিনি সমাধিস্থ হন। এই সময় ৺জগদম্বার নিকট খ্রীষ্টান ভক্তদের উপাসনা প্রত্যক্ষ করিবার জন্য আন্তরিক প্রার্থনা জানান এবং তাঁহাদের উপাসনা দেখিতে ওই চার্চে শুভাগমন করেন। (শ্রীমদর্শন ১১/৫ দ্রষ্টব্য)

কাছি বাগান (মানিকতলা) – শ্যামবাজারের নিকটবর্তী কাছি বাগান নামক স্থানে বৈষ্ণবদের ‘নবরসিক’ সম্প্রদায়ের আখড়ায় বৈষ্ণদচরণ গোস্বামী ঠাকুরকে একবার লইয়া গিয়াছিলেন। এখানকার সাধিকারা ঠাকুরকে ইন্দ্রিয় জয়ী কিনা পরীক্ষা করিতে অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে অটুট সহজ বলিয়া সম্মান দেখাইয়াছিলেন।

কাঁকুড়গাছি – সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের উদ্যানবাটী – শ্রীশ্রীঠাকুর ১৬-১২-১৮৮৩ তারিখে রামবাবুর উদ্যানবাটী হইয়া এখানে আসিয়াছিলেন। বর্তমানে এইস্থানে সাধারণের বসতি স্থাপন হইয়াছে। ১৫-৬-১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে এই বাগানে মহোৎসবে ভক্তগণসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর সংকীর্তন শ্রবণ করিয়া ভাবাবিষ্ট হইয়াছিলেন। ইহার বিস্তৃত বর্ণনা কথামৃতে আছে।

রামচন্দ্র দত্তের উদ্যানবাটী (যোগোদ্যান মঠ) – রামচন্দ্র দত্তের প্রতিষ্ঠিত এই সাধন ক্ষেত্রে শ্রীশ্রীঠাকুরের পূত দেহাস্থি ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে জন্মাষ্টমী দিবসে সংরক্ষিত হয়। শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে ২৬-১২-১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে আসিয়াছিলেন। গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া সর্বপ্রথম ঠাকুর তুলসী কানন দর্শন করেন এবং জায়গাটি ঈশ্বর চিন্তার পক্ষে প্রকৃষ্ট স্থান বলিয়া অভিমত প্রকাশ করেন।

এখানে রামবাবুর প্রদত্ত ফল ও মিষ্টান্ন ঠাকুর ভক্তগণসহ গ্রহণ করেন। বর্তমানে ইহা বেলুড় মঠের একটি শাখা কেন্দ্র – ঠিকানা শ্রীরামকৃষ্ণ যোগোদ্যান মঠ, ৭ নং যোগোদ্যান লেন, কাঁকুড়গাছি, কলি-৫৪।

রাজাবাজার – শিবনাথ শাস্ত্রীর বাড়ি – ১৬-৯-১৮৮৪ তারিখে শিবনাথের বাড়িতে গমন করিয়া তাঁহার দেখা না পাওয়ায় শ্রীশ্রীঠাকুর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে অপেক্ষা করিয়াছিলেন এবং ব্রাহ্মভক্তগণের সঙ্গে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করিয়াছিলেন। কিন্তু সেইদিন শিবনাথের সঙ্গে দেখা হয় নাই।

পটলডাঙ্গা – ভূধর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি – ভূধর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি – কলেজ স্ট্রীটে, পণ্ডিত শশধর এই বাড়িতে অবস্থানকালে শ্রীশ্রীঠাকুর ঈশান মুখোপাধ্যায়ের ঠনঠনিয়ার বাড়ি হইতে পণ্ডিতকে দেখিবার জন্য আসিয়াছিলেন।

মেছুয়াবাজার – লছমী বাঈ-এর বাড়ি – রানী রাসমণি ও মথুরবাবু শ্রীশ্রীঠাকুরের সাধনকালে তাঁহাকে পরীক্ষা করিবার জন্য লছমী বাঈ প্রমুখ সুন্দরী বারনারীকুলের সাহায্যে ঠাকুরকে প্রথমে দক্ষিণেশ্বরে এবং পরে কলিকতারা মেছুয়াবাজার পল্লীর এক গৃহে প্রলোভিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।

শ্রীশ্রীঠাকুর এইসব নারীদের মধ্যে জগন্মাতাকে দেখিয়া ‘মা’ ‘মা’ বলিয়া বাহ্যচেতনা হারাইয়াছিলেন। ইহাতে এই সব নারীর মধ্যে বাৎসল্য ভাবের সঞ্চার হয় এবং তাহারা ঠাকুরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও তাঁহাকে প্রণাম পূর্বক চলিয়া গিয়াছিল।

মনোমোহন মিত্রের বাড়ি – ২৩ নং সিমুলিয়া স্ট্রীটের এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন। ৩-১২-১৮৮১ তারিখে এই বাড়িতে কেশব সেন ও অন্যান্য ভক্তদের সঙ্গে ভগবৎ প্রসঙ্গ ও কীর্তনানন্দের পরে আহারাদি করিয়াছিলেন – কথামৃতের পরিশিষ্টে ইহার বিবরণ আছে। কলিকাতায় আসিলে এখানে শ্রীশ্রীঠাকুর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া অন্যত্র যাইতেন। বর্তমানে বাড়িটির হস্তান্তর হইয়াছে।

গেঁড়াতলার মসজিদ – ঠিকানা ১৮২ নং চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, কলি-৭, মধ্য কলিকতার এই মসজিদে শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি আকস্মিক ঘটনায় একদিন শুভাগমন হইয়াছিল। ভক্ত মন্মথনাথ ঘোষ এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। একদিন সন্ধ্যার সময়ে এই মসজিদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া একজন মুসলমান ফকির প্রেমের সহিত ব্যাকুলভাবে ডাকিতেছিলেন, ‘প্যারে, আ যাও, আ যাও।’

এই সময়ে তিনি দেখেন ঠাকুর একটি ভাড়াটিয়া গাড়ি হইতে নামিয়াই দৌড়াইয়া ফকিরকে আলিঙ্গন করেন। দুই জনেই বেশ কিছুক্ষণ আলিঙ্গনবদ্ধ হইয়াছিলেন। গাড়িটিতে ঠাকুর ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল সহ কালীঘাট হইতে মা-কালীকে দর্শন করিয়া ফিরিতেছিলেন। এই মসজিদটি শতাধিক বছরের প্রাচীন এবং এলাকাটির বর্তমান নাম কলাবাগান। ইহা অবাঙ্গালী মুসলমান ভক্তগণ কর্তৃক পরিচালিত।

সিমুলিয়া – নরেন্দ্রনাথের বাড়ি – শ্রীশ্রীঠাকুর ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জ্জী স্ট্রীটের নরেন্দ্রনাথের এই পৈতৃক বাড়িতে তাঁহাকে মাঝে মাঝে দেখিতে ও খোঁজখবর লইতে আসিতেন। মহেন্দ্রনাথ দত্তের রচনা হইতে জানা যায় ঠাকুর কখনও এই গৃহে প্রবেশ করেন নাই। কিন্তু লাটু মহারাজ ও মাস্টারমহাশয়ের মতে ঠাকুর নরেন্দ্রের বাড়ি আসিয়াছিলেন – লাটু মহারাজ সঙ্গে ছিলেন।

নরেন্দ্রের মাতামহীর বাড়ি – নরেন্দ্রের পৈতৃক বাটীর নিকটে ৭ নং রামতনু বসু লেনে তাঁহার মাতামহীর বাটীতে ঠাকুর বহুবার শুভগমন করিয়াছিলেন। নরেন্দ্রনাথ এই বাড়িতে দোতলায় নির্জন একটি ছোট ঘরে লেখাপড়া ও গান বাজনার উদ্দেশ্যে থাকিতেন।

রাজমোহনের বাড়ি – ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর সন্ধ্যার কিছু পরে শ্রীশ্রীঠাকুর সিমুলিয়ায় রাজমোহনের বাড়িতে নরেন্দ্র প্রভৃতি যুবকদের ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা দেখিতে আসিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর যুবকদের উপাসনা দেখিয়া রাজমোহনের বাড়িতে জলযোগ করেন।

রামচন্দ্র দত্তের বাড়ি – সিমুলিয়ার ১১, মধু রায় লেনের এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরকে বৈশাখী পূর্ণিমায় রামবাবু প্রথম লইয়া আসেন। তখন হইতে প্রতিবৎসর এইদিনে ভক্তদের লইয়া উৎসব করিতেন।

এতদ্ব্যতীত বহুবার শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে আসিয়া ভক্তসঙ্গে কীর্তন, ভাগবত পাঠ শ্রবণ ও ভক্তিমূলক গান শ্রবণ করিয়া ভাবস্থ হইয়াছেন। ভগবৎ প্রসঙ্গে ভক্তদের উদ্দীপিত করিয়াছেন ও ভক্তসঙ্গে আনন্দে আহারাদি করিয়াছেন। বর্তমানে এ বাড়ির চিহ্ন নাই। অক্সফোর্ড মিশনের পিছনে এ বাড়ি ভাঙ্গিয়া রাস্তা হইয়াছে।

সুরেন্দ্র মিত্রের বাড়ি – সিমুলিয়াতে নরেন্দ্রনাথের বাড়ির কাছেই, গৌরমোহন মুখার্জী লেনের সংসগ্নে (অক্সফোর্ড মিশনের পিছনে) সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর আগমন করিয়াছিলেন। এ বাড়িটিও ভাঙ্গা হইয়াছে।

মনোমোহন মিত্রের বাড়ি – ২৩ নং সিমুলিয়া স্ট্রীটের এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন। ৩-১২-১৮৮১ তারিখে এই বাড়িতে কেশব সেন ও অন্যান্য ভক্তদের সঙ্গে ভগবৎ প্রসঙ্গ ও কীর্তনানন্দের পরে আহারাদি করিয়াছিলেন – কথামৃতের পরিশিষ্টে ইহার বিবরণ আছে। কলিকাতায় আসিলে এখানে শ্রীশ্রীঠাকুর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া অন্যত্র যাইতেন। বর্তমানে বাড়িটির হস্তান্তর হইয়াছে।

মহেন্দ্র গোস্বামীর বাড়ি – (বর্তমানে ৪০/৪১ নং মহেন্দ্র গোস্বামী লেন): শ্রীম দর্শন – ১৫শ খণ্ডে শ্রীশ্রীঠাকুরের এই বাড়িতে শুভাগমনের কথা উল্লিখিত আছে। এই বাড়িতে পাঁচশত বৎসরের প্রাচীন গৌর-নিতাই বিগ্রহের পালাক্রমে সেবা আছে। মহেন্দ্র গোস্বামী নিত্যানন্দের বংশধর। খড়দহে তাঁহাদের প্রাচীন বাড়ি। শ্রীশ্রীঠাকুর গোর-নিতাই বিগ্রহ দর্শনে আসিয়াছিলেন।

হাতিবাগান – মহেন্দ্র মুখুজ্জের ময়দার কল – স্টার থিয়েটারে চৈতান্যলীলা দর্শনের জন্যে মহেন্দ্র মুখুজ্জের ময়দার কলে শ্রীশ্রীঠাকুর ২১-৯-১৮৮৪ তারিখে আসিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়াছিলেন। থিয়েটারে অভিনয় দর্শনের পর দক্ষিণেশ্বরে ফিরিবার পথে এখানে মহেন্দ্রবাবু শ্রীশ্রীঠাকুরকে সযত্নে খাওয়াইয়াছিলেন।

দীননাথ বসুর বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা ৪৭/এ, বোস পাড়া লেন, বাগবাজার, কলিকাতা-৩। স্বামী অখণ্ডানন্দজীর ‘স্মৃতি কথা’ গ্রন্থে উল্লিখিত আছে শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে কেশবচন্দ্র সেন ও অন্যান্য ব্রাহ্মভক্তদের সঙ্গে শুভাগমন করিয়াছিলেন। সে সময় হৃদয়, শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবক ও সঙ্গী, তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। এই গৃহে কিশোর গঙ্গাধর ও হরিনাথ তাঁহাকে দর্শন করিয়াছিলেন।

শ্যামপুকুর – কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের বাড়ি – ২৫, শ্যামপুকুর স্ট্রীটে তাঁহার বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরকে অনেকবার লইয়া গিয়া সেবা করিয়াছিলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ভক্ত ছিলেন। তাঁহাদের নিকট ভগবৎ প্রসঙ্গ করিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাদের বিশেষ কৃপা করিয়াছিলেন। ভক্তদের নিকট শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাদের সেবার প্রশংসা করিয়াছেন।

কালীপদ ঘোষের বাড়ি – ২০, শ্যামপুকুর স্ট্রীট। এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন পুঁথিতে উল্লিখিত আছে। দক্ষিণেশ্বরে একদিন কালীপদ উপস্থিত হইলে, শ্রীশ্রীঠাকুর কলিকতায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখনই নৌকায় করিয়া ঠাকুর লাটুর সঙ্গে রওনা হন। পথে গঙ্গাবক্ষে কালীপদর জিহ্বায় মন্ত্র লিখিয়া দিয়া তাঁহাকে কৃপা করেন এবং তাঁহার বাড়িতে শুভাগমন করেন। ৺শ্যামা পূজা দিবসে প্রতি বৎসর এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরের স্মরণোৎসব হয়।

শ্যামপুকুর বাটী – গোকুল ভট্টাচার্যের বৈঠকখানা, ৫৫ নং শ্যামপুকুর স্ট্রীট। গলার অসুখের চিকিৎসার জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে ২-১০-১৮৮৫ তাং হইতে ১০-১২-১৮৮৫ পর্যন্ত ৭০ দিন ছিলেন। এই সময়কার বারদিনের বিবরণ কথামৃতে উল্লিখিত আছে। এই বাড়ি কালীপদ ঘোষের প্রচেষ্টায় ভাড়া লওয়া হইয়াছিল।

প্রাণকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি – ৪০ রামধন মিত্র লেন, কলিকাতা-৪, ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ২রা এপ্রিল শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তসঙ্গে এই বাড়িতে আসিয়া মধ্যাহ্নে সেবা গ্রহণ করিয়াছিলেন। তৎপরে ভগবৎপ্রসঙ্গ করেন।

শ্যামপুকুরে বিদ্যাসাগরের স্কুল – এই মেট্রোপলিটন স্কুল শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের অনতিদূরে অবস্থিত। গড়ের মাঠে সার্কাস দেখিতে যাওয়ার পথে শ্রীশ্রীঠাকুর মাস্টারমহাশয়কে এই স্কুল হইতে গাড়িতে তুলিয়া লইয়াছিলেন (১৫-১১-১৮৮২)

গিরিশচন্দ্র ঘোষের বাড়ি – এই বাড়ির পুরানো নম্বর ছিল, ২৩ নং বোস পাড়া লেন। বর্তমানে ইহার প্রায় সবটাই ভাঙ্গিয়া নূতন রাস্তা ‘গিরিশ এভিনিউ’ তৈয়ারী হইয়াছে। বাড়িটির চারিদিকেই রাস্তা। মাঝখানে দ্বীপের মতো সামান্য একটু অংশের সংস্কার করিয়া গিরিশ মেমোরিয়াল নামে একটি পাঠাগার দোতলায় স্থাপন করা হইয়াছে।

প্রাচীর দিয়া ঘেরা জায়গাটিতে গিরিশচন্দ্রের দণ্ডায়মান পূর্ণবয়ব মূর্তি দক্ষিণাস্য অবস্থায় স্থাপিত। বর্তমান ঠিকানা: “গিরিশ সমৃতিমন্দির”, গিরিশ অ্যাভিনিউ, বাগবাজার, কলি-৩। শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে কয়েকবার শুভাগমন করিয়াছিলেন।

বলরাম বসুর বাড়ি – ‘বলরাম মন্দির’ নামে বর্তমানে খ্যাত। শ্রীশ্রীঠাকুর শতাধিকবার এই বাড়িতে শুভাগমন করিয়া মধ্যে মধ্যে রাত্রি বাস করিয়াছেন। ভক্তসঙ্গে মিলন, বলরামের শুদ্ধ অন্ন গ্রহণ, রথযাত্রা উৎসবে সংকীর্তন, বিভিন্ন সময়ে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ, ভাবাবেশে ভক্তদের প্রতি কৃপা, সমাধি, প্রভৃতি শ্রীশ্রীঠাকুরের বহুলীলা এই বাড়িতেই প্রকটিত হইয়াছিল। ঠাকুর এই বাড়িকে তাঁর ‘কেল্লা’ বলিতেন।

বর্তমানে এই বাড়িটির বর্হিভাগ রামকৃষ্ণ মঠের সাধুদের দ্বারা গঠিত পৃথক ট্রাস্টীগণের পরিচালনাধীন। ঠিকানা – ৭ নং গিরিশ অ্যাভিনিউ, কলি-৩।

চুনিলাল বসুর বাড়ি – ৫৮বি, রামকান্ত বোস স্ট্রীট। এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর আসিয়াছিলেন – ভক্তমালিকা ২য় খণ্ডে উল্লিখিত আছে।

নন্দলাল বসুর বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা – ৯ নং পশুপতি বসু লেন, বাগবাজার, কলিকাতা-৩। এই বাড়িতে অনেক দেব-দেবীর ছবি আছে শুনিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর ২৮-৭-১৮৮৫ তারিখে এখানে আসেন ও ছবিগুলি দেখিয়া প্রশংসা করেন।

দীননাথ বসুর বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা ৪৭/এ, বোস পাড়া লেন, বাগবাজার, কলিকাতা-৩। স্বামী অখণ্ডানন্দজীর ‘স্মৃতি কথা’ গ্রন্থে উল্লিখিত আছে শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে কেশবচন্দ্র সেন ও অন্যান্য ব্রাহ্মভক্তদের সঙ্গে শুভাগমন করিয়াছিলেন। সে সময় হৃদয়, শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবক ও সঙ্গী, তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। এই গৃহে কিশোর গঙ্গাধর ও হরিনাথ তাঁহাকে দর্শন করিয়াছিলেন।

কোম্পানী বাগান – বর্তমানে রবীন্দ্রকানন – পুঁথিতে ‘বিডন-বাগান’ নামে উল্লিখিত। ডা: দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গলরোগের প্রথম অবস্থায় দেখানোর পরে শ্রীশ্রীঠাকুর, গোলাপ-মা, লাটু ও কালীর সহিত এই বাগানে দর্শনে আসিয়াছিলেন। নানাপ্রকারের বৃক্ষলতা, সিমেন্টে তিলক চিত্র আঁকা, তিলকের মালা ইত্যাদি দেখিতে দেখিতে বেলা ১৷৷টার সময় তাঁহারা নৌকাযোগে প্রত্যাবর্তন করেন।

কালীনাথ বসুর বাড়ি – দীননাথ বসুর কনিষ্ঠ সহোদর কালীনাথের ১৩/১, বোস পাড়া লেনের বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর কেশববাবু ও অন্যান্যদের সঙ্গে একইদিনে আসিয়াছিলেন। বর্তমানে বাড়িটি হস্তান্তরিত হইয়া নূতন রূপ ধারণ করিয়াছে। ঠিকানা – ৬/এ, নবীন সরকার লেন, বাগবাজার, কলিকাতা-৩।

যোগীন মা-র বাড়ি – ২৮-৭-১৮৮৫ তারিখে গোলাপ মা-র বাড়ি হইতে শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তসঙ্গে এই বাড়িতে শুভাগমন করেন। বাড়িটি আগে এক তলা ছিল, এখন তিনতলা হইয়াছে। ঠিকানা – ৫৯বি, বাগবাজার স্ট্রীট, কলিকাতা-৩।

দীনানাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি – বাগবাজার পুলের কাছে এই বাড়িতে দীননাথের ভক্তির কথা শুনিয়া শ্রীশ্রীঠাকুর মথুরবাবুর সঙ্গে গাড়ি করিয়া আসিয়াছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এই বাড়ির কোন সন্ধান জানা যায় না।

গঙ্গাতীরে নূতন বাড়ি – বাগবাজারে দুর্গাচরণ মুখার্জী স্ট্রীটের এই একতলা ভাড়া বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরের চিকিৎসার জন্য দক্ষিণেশ্বর হইতে ভক্তগণ তাঁহাকে লইয়া আসেন। কিন্তু প্রশস্ত উদ্যানের মুক্ত বায়ুতে থাকিতে অভ্যস্ত ঠাকুর ওই স্বল্প পরিসর বাটীতে প্রবেশ করিয়াই ওই স্থানে বাস করিতে পারিবেন না বলিয়া তৎক্ষণাৎ পদব্রজে বলরাম বসুর ভবনে চলিয়া যান।

৺সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, বাগবাজার – শ্রীশ্রীঠাকুর এই মন্দিরে আসিয়াছিলেন। – শ্রীম-দর্শন ১৫শ খণ্ডে উল্লিখিত আছে।

৺মদনমোহন মন্দির, বাগবাজার – এই মন্দির দর্শনে শ্রীশ্রীঠাকুর আগমনের কথা শ্রীম-দর্শনে (১৫শ খণ্ডে) উল্লিখিত আছে।

কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেনের বাড়ি – ৯/১ কুমারটুলি স্ট্রীট, কলিকাতা-৫, বিখ্যাত কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেনের এই বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ চিকিৎসার জন্য আসিয়াছিলেন।

অধরলাল সেনের বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা – ৯৭বি, বেনিয়াটোলা স্ট্রীট; শোভাবাজার, কলিকতা-৫। শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে ভক্তসঙ্গে অন্তত ৯ বার শুভাগমন করিয়াছিলেন (কথামৃতের বিবরণ অনুযায়ী)। এই বাড়িতে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ও ভগবৎ প্রসঙ্গ হইয়াছিল। ভক্তসঙ্গে কীর্তন, ভগবৎ প্রসঙ্গ, সমাধিস্থ হওয়া ও আহার করার কথা কথামৃতে উল্লিখিত আছে।

নন্দনবাগান, কাশীশ্বর মিত্রের বাড়ি – গ্রে স্ট্রীটে ২-৫-১৮৮৩ তারিখে আদি ব্রাহ্মসমাজভুক্ত কাশীশ্বর মিত্রের এই বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে শ্রীশ্রীঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন। এই উৎসবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি ঠাকুর বংশের ভক্তগণ উপস্থিত ছিলেন।

ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি – কলিকতার নতুন বাজারের নিকট তাঁহার বাড়ি ছিল। শ্রীশ্রীঠাকুরের গলরোগের প্রথম অবস্থায় এই ডাক্তারের বাড়িতে গোলাপ-মা, লাটু ও কালী দক্ষিণেশ্বর হইতে নৌকাযোগে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখাইতে লইয়া আসিয়াছিলেন – পুঁথিতে উহার উল্লেখ আছে।

দেবেন্দ্রনাথ মজুমদারের বাসা বাড়ি – নিমু গোস্বামী লেনের এই বাড়িতে ৬-৪-১৮৮৫ তারিখে শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তসঙ্গে শুভাগমন পূর্বক কীর্তনানন্দে সমাধিস্থ হন। পরে ভগবৎপ্রসঙ্গ করিয়া জলযোগ করেন। চৈত্রমাসের অসতন্ত গরমে কুলপি খাইয়া আনন্দ করিয়াছিলেন।

কোম্পানী বাগান – বর্তমানে রবীন্দ্রকানন – পুঁথিতে ‘বিডন-বাগান’ নামে উল্লিখিত। ডা: দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গলরোগের প্রথম অবস্থায় দেখানোর পরে শ্রীশ্রীঠাকুর, গোলাপ-মা, লাটু ও কালীর সহিত এই বাগানে দর্শনে আসিয়াছিলেন। নানাপ্রকারের বৃক্ষলতা, সিমেন্টে তিলক চিত্র আঁকা, তিলকের মালা ইত্যাদি দেখিতে দেখিতে বেলা ১৷৷টার সময় তাঁহারা নৌকাযোগে প্রত্যাবর্তন করেন।

জোড়াসাঁকো – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা ৬/৪, দ্বারকানাথ ঠাকুর রোড, কলিকাতা-৭। মথুরবাবুর সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে মহর্ষির সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিলেন। ঠিক কোন ঘরে সাক্ষাৎ হইয়াছিল তাহা এখন জানা যায় না। ২৬-১০-১৮৮৪ তারিখে কথামৃতে এই প্রসঙ্গ আছে। বর্তমানে এই বাড়িটি ও অন্যান্য বাড়িগুলি রবীন্দ্র সোসাইটি ও রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম কেন্দ্র।

স্টার থিয়েটার – ৬৮ নং বিডন স্ট্রীট। কথামৃতে আছে ২১-৯-১৮৮৪ তারিখে শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তসঙ্গে এখানে ‘চৈতন্যলীলা’ দর্শন, ১৮-১২-১৮৮৪ তারিখে প্রহ্লাদ চরিত্র এবং ২৫-২-১৮৮৫ তারিখে বৃষকেতু অভিনয় দর্শনে শুভাগমন করিয়াছিলেন। বিডন স্ট্রীটের এই রঙ্গমঞ্চ পরে এমারেল্ড থিয়েটার ও ক্লাসিক থিয়েটারের আভিনয় হইত। পরে কোহিনূর ও মনোমোহন থিয়েটার এখানে হয়।

গরানহাটা – বর্তমান নিমতলা স্ট্রীট – বৈষ্ণব সাধুদের আখড়ায় ষড়ভুজ মহাপ্রভুর দর্শন করিতে শ্রীশ্রীঠাকুর ১৬-১১-১৮৮২ তারিখে বৈকালে এখানে আসিয়াছিলেন।

হাটখোলা – বারোয়ারী মেলায় একদিন সকালে নীলকণ্ঠের ভক্তিমাখা কৃষ্ণলীলা গীত শুনিতে শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তগণ সঙ্গে গিয়াছিলেন – পুঁথিতে ইহার উল্লেখ আছে।

পাথুরিয়াঘাটায় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ি – কাপ্তেনের সঙ্গে এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর আসিয়াছিলেন। পূর্বে একবার যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে যদুলাল মল্লিকের দক্ষিণেশ্বরের বাগানে দেখা ও তাঁহার সঙ্গে ‘ঈশ্বর চিন্তা করাই কর্তব্য’ বিষয়ে কতাবার্তা হইয়াছিল। শ্রীশ্রীঠাকুরের আগমন দিবসে যতীন্দ্রমোহনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা সৌরীন্দ্রমোহনের সহিত কথাবার্তা তাঁহার বাড়িতেই হয়। কিন্তু যতীন্দ্রমোহন ‘গলার বেদনার কথা’ জানাইয়া দেখা করেন নাই। ১৫-১০-১৮৮২ তারিখে কথামৃতে ইহার উল্লেখ আছে।

যদুলাল মল্লিকের বাড়ি – ৬৭ পাথুরিয়া ঘাটা স্ট্রীট, কলিকাতা-৬। এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর মল্লিকদের কুলদেবী ৺সিংহবাহিনী দর্শন করিতে আসিতেন।

খেলাৎ ঘোষের বাড়ি – ঠিকানা ৪৭, পাথুরিয়া ঘাটা স্ট্রীট, কলিকতা-৬। ২১-৭-১৮৮৩ তারিখে শ্রীশ্রীঠাকুর রাত্রি ১০টার সময় এই বাড়িতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। খেলাৎ ঘোষের সম্বন্ধী এক প্রবীণ বৈষ্ণব ভক্তের আগ্রহে শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে আগমন করেন। কথামৃতে ইহার উল্লেখ আছে। এই বৈষ্ণব ভক্তের নাম জানা গিয়াছে শ্রীনিত্যানন্দ সিংহ; তাঁহার বাড়ির ঠিকানা নিত্যানন্দ ধাম, ৩৮/৮, বোস পাড়া লেন, বাগবাজার।

জয়গোপাল সেনের বাড়ি – মাথাঘষা গলি – বর্তমানে রতন সরকার স্কোয়ার, বড় বাজার, ২৮-১১-১৮৮৩ তারিখে সন্ধ্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে ভক্তসঙ্গে শুভাগমন, ভগবৎ প্রসঙ্গ ও ভজন করিয়া গৃহস্থ ভক্তদের উৎসাহ দিয়াছিলেন – কথামৃতে ইহার উল্লেখ আছে। ইঁহার বেলঘরিয়ার উদ্যান বাটিতে (৮নং বি টি রোড) ঠাকুর উপস্থিত হইয়া কেশবচন্দ্র সেনের সহিত সাক্ষাৎ ও আলাপ করিয়াছিলেন।

জোড়াসাঁকো – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা ৬/৪, দ্বারকানাথ ঠাকুর রোড, কলিকাতা-৭। মথুরবাবুর সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে মহর্ষির সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিলেন। ঠিক কোন ঘরে সাক্ষাৎ হইয়াছিল তাহা এখন জানা যায় না। ২৬-১০-১৮৮৪ তারিখে কথামৃতে এই প্রসঙ্গ আছে। বর্তমানে এই বাড়িটি ও অন্যান্য বাড়িগুলি রবীন্দ্র সোসাইটি ও রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম কেন্দ্র।

সিঁদুরিয়া পটী কাশীনাথ মল্লিকের ঠাকুর বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা – ১৪, মহাত্মা গান্ধী রোড, কলি-৭। কাশীনাথ মল্লিকের এই ঠাকুর বাড়িতে পালাক্রমে পূজিতা ৺সিংহবাহিনী দেবীকে দর্শন করিতে শ্রীশ্রীঠাকুর একবার আসিয়াছিলেন। চাষা-ধোপা পাড়ার মল্লিকদের আর এক শরিকের বাড়িতেও শ্রীশ্রীঠাকুর এই দেবী দর্শনে গিয়াছিলেন – কথামৃতে ইহা উল্লিখিত আছে।

আদি ব্রাহ্মসমাজ – বর্তমান ঠিকানা – ৫৫/১ রবীন্দ্র সরণি, কলিকাতা-৭। ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে মথুরবাবুর সহিত শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে আসিয়া কেশব সেনকে বেদীর উপর ধ্যানস্থ অবস্থায় দেখিয়াছিলেন।

জোড়াসাঁকো হরিসভা – শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে কীর্তন শুনিতে আসিয়াছিলেন। ১৮-১২-১৮৮৩ তারিখে তিনি স্বমূখে তাঁহার সমাধিস্থ অবস্থায় দেহত্যাগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন।

কাঁসারিপাড়া হরিভক্তি প্রদায়িনী সভা – ডব্লিউ সি বনার্জী স্ট্রীট – ১৩-৫-১৮৮৩ তারিখে শ্রীশ্রীঠাকুর এই সভার বার্ষিক উৎসবে মনোহর সাঁই-এর ‘মান’ পালা-গান শুনিতে শুভাগমন করিয়াছিলেন।

বড়বাজার – মারোয়াড়ী ভক্তের বাড়ি – ১২ নং মল্লিক স্ট্রীট। ২০-১০-১৮৮৪ তারিখে দেওয়ালির উৎসবের সময় মারোয়াড়ী ভক্তদের অন্নকূট উৎসবে শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তসঙ্গে এখানে আসিয়াছিলেন। ওইদিন ময়ূরমুকুটধারী-বিগ্রহ দর্শন ও প্রসাদ গ্রহণ করিয়াছিলেন।

মণিলাল মল্লিকের বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা ৮২ নং এবং ১২০ নং রবীন্দ্র সরণি, কলিকাতা-৭। সিঁদুরিয়া পটীর ব্রাহ্মসমাজের সাংবৎসরিক মহোৎসবে শ্রীশ্রীঠাকুর ২৬-১১-১৮৮২ এবং ২৬-১১-১৮৮৩ তারিখে এখানে শুভাগমন করিয়া ব্রাহ্মভক্তদের সহিত ভগবৎ প্রসঙ্গ ও আহারাদি করিয়াছিলেন। বর্তমানে এই বাড়িটি জৈন মন্দির। বাড়িটির সম্মুখের অংশ দোতলায় যেখানে শ্রীশ্রীঠাকুর আসিয়া ছিলেন সংস্কার করার পর – এখনও আছে।

কলুটোলা: কেশব সেনের ভ্রাতা নবীন সেনের বাড়ি – এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর অন্তত দুইবার আসিয়াছিলেন – কথামৃতে উল্লিখিত আছে। ১৮৭৫ – ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোন একদিন হৃদয়ের সঙ্গে আসিয়াছিলেন একথা ২৮-৫-১৮৮৪ তারিখের বিবরণে কথামৃতে আছে। এতদ্ব্যতীত ৪-১০-১৮৮৪ তারিখে কোজাগরী পূর্ণিমার দিন কেশবের মাতাঠাকুরানীর নিমন্ত্রণে ভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দ করিয়া আহার গ্রহণ করিয়াছিলেন। বর্তমানে এই বাড়িটি হস্তান্তরিত হইয়াছে। অতি জীর্ণ অবস্থায় একতলায় একটি ঘর মাত্র আছে। বর্তমান ঠিকানা ১২২সি, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, কলিকাতা-৭৩।

কলুটোলার হরিসভা – শ্রীশ্রীঠাকুর এই হরিসভায় নিমন্ত্রিত হইয়া হৃদয়ের সঙ্গে ভাগবত পাঠ শুনিতে আসিয়াছিলেন। পাঠ শুনিতে শুনিতে ভাবে আত্মহারা হইয়া শ্রীচৈতন্যের আসনে সমাধিস্থ অবস্থায় দণ্ডায়মান হন। বর্তমান ঠিকানা – কলুটোলা হরিভক্তি প্রদায়িনী সভা, ৩২-এ ফিয়ারস্‌ লেন, কলিকাতা-৭৩।

রাধাবাজার বেঙ্গল ফটোগ্রাফের স্টুডিও – শ্রীশ্রীঠাকুরকে সুরেন্দ্রনাথ মিত্র এখানে ফটো তোলা কিরূপে হয় দেখাইবার পর শ্রীশ্রীঠাকুরের দণ্ডায়মান ও সমাধিস্থ অবস্থায় ফটো তোলেন।

তেলিপাড়া – ছোট নরেনের বাড়ি – ঠিকানা ৩৩/এ, তেলিপাড়া লেন, কলিকাতা-৪। শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। ১৩-৬-১৮৮৫ তারিখে কথামৃতে ইহার উল্লেখ আছে।

শাঁখারি টোলা – ডা: মহেন্দ্রলাল সরকারের বাড়ি – ঠিকানা – ১৫ নং, মহেন্দ্র সরকার স্ট্রীট, কলিকাতা-১২। শ্রীশ্রীঠাকুরের চিকিৎসার জন্য শাঁখারি টোলার ডা: সরকারের এই বাড়িতে তাঁহাকে লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। রামচন্দ্র দত্তের ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবন বৃত্তান্ত’ গ্রন্থে (২১শ পরিচ্ছেদ) ইহার উল্লেখ আছে।

সিঁদুরিয়া পটী কাশীনাথ মল্লিকের ঠাকুর বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা – ১৪, মহাত্মা গান্ধী রোড, কলি-৭। কাশীনাথ মল্লিকের এই ঠাকুর বাড়িতে পালাক্রমে পূজিতা ৺সিংহবাহিনী দেবীকে দর্শন করিতে শ্রীশ্রীঠাকুর একবার আসিয়াছিলেন। চাষা-ধোপা পাড়ার মল্লিকদের আর এক শরিকের বাড়িতেও শ্রীশ্রীঠাকুর এই দেবী দর্শনে গিয়াছিলেন – কথামৃতে ইহা উল্লিখিত আছে।

জানবাজার রানী রাসমণির বাড়ি – বর্তমান ঠিকানা – ১৩ নং, রানী রাসমণি রোড, কলিকাতা-৮৭, জানবাজারে রানীর বাড়িতে আসিলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই দোতলা বাড়িটিতে বাস করিতেন। তাঁহার ব্যবহৃত খাটটি এখনও আছে। মথুরবাবুর প্রবলভক্তি বিশ্বাসের ফলে শ্রীশ্রীঠাকুরকে অধিক সময় নিকটে পাইবার আকাঙ্ক্ষায় তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বর হইতে লইয়া আসিয়া দীর্ঘকাল সেবা করিতেন। একত্রে আহার, বিহার, এমনকি একই কক্ষে শয়ন পর্যন্ত করিয়াছেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের সখীভাব সাধন কালে এখানে অনুষ্ঠিত অনেক ঘটনার বিবরণ ‘লীলাপ্রসঙ্গে’ আছে।

প্রথমত এগুলিকে ওল্ড সুপ্রীম কোর্টে ও বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাড়িতে রাখা হয়, পরে ১৮০৮ খ্রীষ্টাব্দে পার্ক স্ট্রীটে সোসাইটির নবনির্মিত ভবনে স্থায়ী ভাবে রাখা হয়। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ভারতীয়গণকে সোসাইটির সভ্যপদ দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে সংস্থাটির নাম পরিবর্তিত হইয়া অবশেষে ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাস হইতে ইহার নাম হয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি।’

ময়দান অঞ্চল – গড়ের মাঠ – শ্রীশ্রীঠাকুর দুইবার এখানে আসার কথা কথামৃতে উল্লেখ আছে। ২১-৯-১৮৮৪ তারিখের বিবরণে আছে একবার বেলুন উড়ানো দেখিতে আসিয়া একটি সাহেবের ছেলেকে ত্রিভঙ্গ হইয়া গাছে হেলান দেওয়া অবস্থায় দেখিয়া শ্রীকৃষ্ণের উদ্দীপন হওয়ায় তিনি সমাধিস্থ হইয়াছিলেন। দ্বিতীয়বার ১৫-১১-১৮৮২ তারিখে উইলসন সার্কাস দেখিতে আসিয়াছিলেন।

লাটসাহেবের বাড়ি – বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসভবন। ময়দাবের উত্তরে ছয় একর বিস্তৃত জায়গাতে ইহা অবস্থিত। কলিকাতায় শ্রীশ্রীঠাকুর আসিলে হৃদয় তাঁহাকে বড় বড় থামওয়ালা এই বাড়ি দেখান। শ্রীশ্রীঠাকুর বলিয়াছিলেন, ‘মা দেখিয়ে দিলেন, কতকগুলি মাটির ইট উঁচু করে সাজানো।’ ৯-৩-১৮৮৪ তারিখে কথামৃতে ইহার উল্লেখ আছে।

ফোর্ট উইলিয়াম – রাজা তৃতীয় উইলিয়মের নামে কলিকাতার এই কেল্লা গঙ্গার পূর্বতীরে অবস্থিত। ইহা অসম অষ্টভুজাকৃতির। আয়তন ৫ বর্গ কিলোমিটার। ইহার অস্ত্রাগার বিশেষ দ্রষ্টব্য। মথুরবাবুর সহিত শ্রীশ্রীঠাকুর এই কেল্লা দেখিয়াছিলেন। কথামৃতে ২৫-৫-১৮৮৪ তারিখে ইহার উল্লেখ আছে। সংসারীর পক্ষে ঈশ্বরের সাধন গৃহে থাকিয়াই সুবিধাজনক।

এই প্রসঙ্গে গৃহকে কেল্লার সঙ্গে তুলনা করিয়া বলিয়াছেন, যেমন কেল্লা হইতে যুদ্ধ করিলে কেল্লার অনেক সাহায্য পাওয়া যায়। পুঁথিতে আছে মথুরবাবুর সঙ্গে ফিটন গাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরকে আসিতে দর্শন করিয়া শিখ সৈন্যরা ইংরেজ সেনাধ্যক্ষের অধীনে কেল্লাভিমুখে গমন কালে পথে অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করিয়া ইউনিফর্ম পরা অবস্থাতেই ‘জয় গুরু’ বলিয়া তাঁহাকে ভুলুণ্ঠিত হইয়া প্রণাম করিয়াছিল।

সেনাধ্যক্ষ তাঁহার অনুমতি ব্যতীত তাহাদের এরূপ কাজের জন্য প্রশ্ন করিলে, তাহারা উত্তর দিয়াছিল ইহাই শিখদের গুরুদর্শনে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর চিরাচরিত রীতি। ‘কেল্লা’ শব্দটির ব্যবহার শ্রীশ্রীঠাকুর কয়েকক্ষেত্রে করিয়াছেন। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িকে ‘মা কালীর কেল্লা’ ও বলরাম ভবনকে তাঁহার দ্বিতীয় কেল্লা বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন।

এশিয়াটিক সোসাইটি ও যাদুঘর – তখনকার বেঙ্গল সুপ্রীম কোর্টের এক বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোনস্‌ ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি ভারতে ঐতিহাসিক গবেষণার জন্য এই সোসাইটি স্থাপন করেন। এখানে এশিয়ার অনেক মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি এবং প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ও প্রাণিতত্ত্বের নিদর্শন সংগৃহীত হয় তাঁহারই প্রচেষ্টায়।

প্রথমত এগুলিকে ওল্ড সুপ্রীম কোর্টে ও বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাড়িতে রাখা হয়, পরে ১৮০৮ খ্রীষ্টাব্দে পার্ক স্ট্রীটে সোসাইটির নবনির্মিত ভবনে স্থায়ী ভাবে রাখা হয়। ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ভারতীয়গণকে সোসাইটির সভ্যপদ দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে সংস্থাটির নাম পরিবর্তিত হইয়া অবশেষে ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাস হইতে ইহার নাম হয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি।’

আলিপুর চিড়িয়াখানা – শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের স্মৃতি কথায় আছে একবার তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসিলে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাকে চিড়িয়াখানার সিংহ দেখাইবার জন্য অনুরোধ করেন। “সিংহ জগজ্জননী দেবী দুর্গার বাহন” বলিতে বলিতে তাঁহার মধ্যে এক অতীনিদ্রয় অনুভূতি জাগ্রত হইল। সেদিন শাস্ত্রীমহাশয়ের জরুরী কাজ থাকায় নিজে যাইতে পারেন নাই।

এই সোসাইটির প্রচেষ্টাতেই কলিকতা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া, ইণ্ডিয়ান মিউজিয়াম প্রভৃতি স্থাপিত হইয়াছিল। সোসাইটির মিউজিয়মের জিনিসগুলি ইণ্ডিয়ান মিউজিয়াম বা ভারতীয় সোসাইটিতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে এই সিসাইটির নূতন বাড়িটির উদ্বোধন হয় এবং বর্তমানে এই সোসাইটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানরূপে ঘোষিত।

শ্রীরামকৃষ্ণ এই সোসাইটির মিউজিয়ম (যাদুঘর) দেখিতে আসিয়াছিলেন। কথামৃতে ইহার উল্লেখ আছে – ২-৩-১৮৮৪, ৯-৩-১৮৮৪ ও ২৩-১০-১৮৮৫ তারিখগুলির বিবরণে। হৃদয়ের পরামর্শে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহার শারীরিক ব্যাধির আরামের জন্য মাকে বলিতে লজ্জিত হন। বলিয়াছিলেন সোসাইটিতে দেখা মানুষের কঙ্কাল যেমন তার দিয়া শক্ত করিয়া জুড়িয়া রাখা আছে, সেইরূপ তাঁহার শরীরটা শক্ত করিয়া দিলে তিনি মায়ের নামগুণকীর্তন করিতে পারিবেন।

মিউজিয়ামে দেখিয়াছিলেন জানোয়ার পাথর (fossil) হইয়া গিয়াছে। ইহাতে সাধু সঙ্গে উপমা দিয়া বলিয়াছিলেন, সাধুসঙ্গের ফলে মানুষও সাধু হিয়া যায়। এখানে শ্রীরামকৃষ্ণের শুভাগমনের স্মৃতি রক্ষার জন্য সোসাইটির নূতন বাড়ির চারতলার হল ঘরে তাঁহার একটি সুন্দর প্রতিকৃতি স্থাপিত হইয়াছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিও শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া সোসাইটি তাঁহার একটি প্রতিকৃতি স্থাপন ও বিবেকানন্দ অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি ও অদ্যাপক নিয়োগ করিয়াছেন। বর্তমান ঠিকানা ১ নং পার্ক স্ট্রীট কলিকাতা-১৬। প্রধান ফটকের ডানদিকের পিলারে শ্বেতপাথরের ফলকে ছোট অক্ষরে লেখা আছে (The Asiatic Society)

জগন্নাথ ঘাট ও কয়লাঘাট – শ্রীশ্রীঠাকুর জগন্নাথ ঘাটে নামিয়াছিলেন। শ্রীম দর্শনে (১৫শ খণ্ডে) উল্লিখিত আছে। ২৭-১০-১৮৮২ তারিখে শ্রীশ্রীঠাকুর দক্ষিণেশ্বর হইতে কেশবচন্দ্র ও ব্রাহ্মভক্তদের সহিত স্টীমারে আসিয়া গঙ্গাবক্ষে ভগবৎ প্রসঙ্গ করিয়াছিলেন। সেদিন কয়লাঘাটে নামিয়াছিলেন – কথামৃতে উল্লিখিত হইয়াছে।

আলিপুর চিড়িয়াখানা – শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের স্মৃতি কথায় আছে একবার তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসিলে শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁহাকে চিড়িয়াখানার সিংহ দেখাইবার জন্য অনুরোধ করেন। “সিংহ জগজ্জননী দেবী দুর্গার বাহন” বলিতে বলিতে তাঁহার মধ্যে এক অতীনিদ্রয় অনুভূতি জাগ্রত হইল। সেদিন শাস্ত্রীমহাশয়ের জরুরী কাজ থাকায় নিজে যাইতে পারেন নাই।

সুকিয়া স্ট্রীট পর্যন্ত শ্রীশ্রীঠাকুরকে গাড়িতে লইয়া আসিয়া নরেন্দ্রনাথের দায়িত্বে তাঁহাকে চিড়িয়াখানায় পাঠান। কথামৃতে ২৪-২-১৮৮৪ তারিখের বিবরণে আছে – ‘চিড়িয়াখানা দেখাতে লয়ে গিছলো। সিংহ দর্শন করেই আমি সমাধিস্থ হয়ে গেলাম। ঈশ্বরীয় বাহনকে দেখে ঈশ্বরীয় উদ্দীপন হলো। – তখন আর অন্য জানোয়ার কে দেখে। সিংহ দেখেই ফিরে এলাম।’ প্রায় চল্লিশ একর পরিমিত স্থানে এই চিড়িয়াখানাতে অনেক প্রকারের বন্য প্রাণীর সংগ্রহ আছে।

কালীঘাট মা কালীর মন্দির – এই মন্দির প্রায় ৩৫০ বৎসর পূর্বে নির্মিত। পৌরাণিক কাহিনীতে দেবী সতীর একটি অঙ্গুলি এখানে পড়িয়াছিল। ইহা হিন্দুদের একটি মহাতীর্থ। শ্রীশ্রীঠাকুর এই মহাতীর্থে কয়েকবার মায়ের দর্শনে আসিয়াছিলেন। ২৯-১২-১৮৮৩ তারিখে এখানে আসার কথা কথামৃতে উল্লিখিত আছে। লীলাপ্রসঙ্গে – গুরুভাব উত্তরার্ধ ৩য় অধ্যায়ে আছে কালীঘাট তীর্থে শ্রীশ্রীজগদম্বাকে দর্শন করিয়া আনন্দিত হইয়াছিলেন।

কাশীপুর উদ্যানবাটী – শ্যামপুকুর বাটী হইতে ডাক্তারের পরমর্শে উন্মুক্ত পরিবেশে রাখিবার জন্য ভক্তগণ শ্রীশ্রীঠাকুরকে গোপালচন্দ্র ঘোষের এই উদ্যান বাটীতে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর আনয়ন করেন। শ্রীশ্রীঠাকুর এখানেই ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারী আত্মপ্রকাশে ভক্তদের অভয়প্রদান করেন। ওই ঘটনার স্মরণে আজও প্রতি বৎসর ১লা জানুয়ারি ‘কল্পতরু’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই বাগানবাটীতে শ্রীশ্রীঠাকুর ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই আগস্ট লীলাসংবরণ করেন।

সে সময় সঙ্গী ভক্তদের মধ্যে একজনকে বলিয়াছিলেন ‘দেবস্থান তীর্থস্থান দর্শনাদি করে এসে সেই সব ভাব নিয়ে থাকতে হয়। জাবর কাটতে হয়, তা নইলে ওসব ঈশ্বরীয় ভাব প্রাণে দাঁড়াবে কেন?’

কম্বুলিয়াটোলা – মাস্টারমহাশয়ের ভাড়া বাড়ি – লীলাপ্রসঙ্গে গুরুভাব পূর্বার্ধ (ঝামাপুকুরে) ১ম অধ্যায়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের এখানে আসার কথা আছে। সেদিন কয়েকজন মহিলা ভক্ত দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার দর্শনে গিয়াছিলেন। সেখানে দর্শন না পাইয়া এই বাড়িতে আসিয়া শ্রীশ্রীঠাকুরের দর্শনলাভপূর্বক তাঁহার সহিত কথাবার্তা বলিয়া ধন্যা হইয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর এই বাড়িতে জলযোগ ও আহারাদি করিয়া সেদিন দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া যান।

বেণীমাধব পালের উদ্যানবাটী, সিঁথি – শ্রীশ্রীঠাকুরের এখানে ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে তিনবার শুভাগমনের কথা কথামৃতে উল্লেখ আছে (২৮-১০-১৮৮২, ২২-৪-১৮৮৩ ও ১৯-১০-১৮৮৪)। এইসব দিনের উৎসবে বহু ব্রাহ্মভক্তের সঙ্গে ভগবৎপ্রসঙ্গ ও কীর্তনাদি করিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ হইয়াছিলেন।

বর্তমানে এই উদ্যানবাটীটির সমাজগৃহ, সরোবর, উদ্যানসমেত ১৮ বিঘা জমি হস্তান্তরিত হইয়া বিভিন্ন প্লটে অনেক নতুন বাড়ি নির্মিত হইয়াছে। স্থানীয় ভক্তদের প্রচেষ্টায় সমাজ প্রাঙ্গণের একটি অংশে দেড় কাঠা জমিতে একটি বেদী নির্মিত হইয়াছে।

ঠাকুরদের নৈনালের প্রমোদ কানন, সিঁথি – বর্তমানে এখানে Indian Statistical Institute অবস্থিত। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী এখানে ডিসেম্বর ১৮৭২ হইতে মার্চ ১৮৭৩ খ্রী: পর্যন্ত ছিলেন। তখন শ্রীশ্রীঠাকুর একদিন কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের সঙ্গে সেখানে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন।

কালী ডাক্তারের বাড়ি – শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ের নিকট এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন। (শ্রীম-দর্শন ১৫শ খণ্ড)

সর্বমঙ্গলা মন্দির, কাশীপুর – ইহার নাম ‘চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলা মন্দির।’ কিন্তু ‘সর্বমঙ্গলার মন্দির’ নামে অধিক পরিচিত। শ্রীশ্রীঠাকুর এই মন্দিরে কয়েকবার আসিয়াছিলেন। বর্তমান ঠিকানা: ১৫/১, খগেন চ্যাটার্জী রোড, কলিকাতা – ৭০০০০২।

মহিমাচরণ চক্রবর্তীর বাড়ি – কাশীপুর রোডের উপর দিয়া যেখানে Gun and Shell Factory-র রেললাইন গিয়াছে তাহার পূর্বসীমায় বসাক বাগানে মহিম চক্রবর্তির উদ্যানবাটী ছিল। এই বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর শুভাগমন করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি প্রণেতা অক্ষয় কুমার সেন এই বাড়িতেই শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন। এই বাড়ির এখন কোন চিহ্নই নাই।

কাশীপুর উদ্যানবাটী – শ্যামপুকুর বাটী হইতে ডাক্তারের পরমর্শে উন্মুক্ত পরিবেশে রাখিবার জন্য ভক্তগণ শ্রীশ্রীঠাকুরকে গোপালচন্দ্র ঘোষের এই উদ্যান বাটীতে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর আনয়ন করেন। শ্রীশ্রীঠাকুর এখানেই ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারী আত্মপ্রকাশে ভক্তদের অভয়প্রদান করেন। ওই ঘটনার স্মরণে আজও প্রতি বৎসর ১লা জানুয়ারি ‘কল্পতরু’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই বাগানবাটীতে শ্রীশ্রীঠাকুর ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই আগস্ট লীলাসংবরণ করেন।

পরে এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের একটি শাখাকেন্দ্র স্থাপিত হয়। বর্তমান ঠিকানা – ৯০ কাশীপুর রোড, কলিকাতা – ৭০০০০২।

কাশীপুর মহাশ্মশান – শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পূতদেহ এই শ্মশানঘাটে ১৬-৮-১৮৮৬ তারিখে ভক্তবৃন্দ লইয়া গিয়া অগ্নিতে আহুতি প্রদান করেন। ওই স্থানটিতে একটি স্মারক মন্দির নির্মিত হইয়াছে। ইহার বর্তমান নাম – শ্রীরামকৃষ্ণ মহাশ্মশান।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!