চৈতন্যদেব, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও লোকমান্য
অধর – চৈতন্যও ভোগ করেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (চমৎকৃত হইয়া) – কি ভোগ করেছিলেন?
অধর – অত পণ্ডিত! কত মান!
শ্রীরামকৃষ্ণ – অন্যের পক্ষে মান। তাঁর পক্ষে কিছু নয়!
“তুমি আমায় মানো আর নিরঞ্জন মানে, আমার পক্ষে এক – সত্য করে বলছি। একজন টাকাওয়ালা লোক হাতে থাকবে, এ মনে হয় না। মনোমোহন বললে, ‘সুরেন্দ্র বলেছে, রাখাল এঁর কাছে থাকে – নালিশ চলে।’ আমি বললাম, ‘কে রে সুরেন্দ্র? তার সতরঞ্চ আর বালিশ এখানে আছে। আর সে টাকা দেয়’?”
অধর – দশ টাকা করে মাসে বুঝি দেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ – দশ টাকায় দু মাস হয়। ভক্তেরা এখানে থাকে – সে ভক্তসেবার জন্য দেয়। সে তার পুণ্য, আমার কি? আমি যে রাখাল, নরেন্দ্র এদের ভালবাসি, সে কি কোন নিজের লাভের জন্য?
মাস্টার – মার ভালবাসার মতো।
শ্রীরামকৃষ্ণ – মা তবু চাকরি করে খাওয়াবে বলে অনেকটা করে। আমি এদের যে ভালবাসি, সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখি! – কথায় নয়।
ঠিক ঠিক ত্যাগীর ভার ঈশ্বর লন – ‘অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তঃ’
শ্রীরামকৃষ্ণ (অধরের প্রতি) – শোনো! আলো জ্বাললে বাদুলে পোকার অভাব হয় না! তাঁকে লাভ কল্লে তিনি সব জোগাড় করে দেন – কোন অভাব রাখেন না। তিনি হৃদয়মধ্যে এলে সেবা করবার লোক অনেক এসে জোটে।
“একটি ছোকরা সন্ন্যাসী গৃহস্থবাড়ি ভিক্ষা করতে গিছিল। সে আজন্ম সন্ন্যাসী। সংসারের বিষয় কিছু জানে না। গৃহস্থের একটি যুবতী মেয়ে এসে ভিক্ষা দিলে। সন্ন্যাসী বললে, মা এর বুকে কি ফোঁড়া হয়েছে? মেয়েটির মা বললে, না বাবা! ওর পেটে ছেলে হবে বলে ঈশ্বর স্তন করে দিয়েছেন – ওই স্তনের দুধ ছেলে খাবে। সন্ন্যাসী তখন বললে, তবে আর ভাবনা কি? আমি আর কেন ভিক্ষা করব? যিনি আমায় সৃষ্টি করেছেন তিনি আমায় খেতে দেবেন।
“শোনো! যে উপপতির জন্য সব ত্যাগ করে এল, সে বলবে না; শ্যালা, তোর বুকে বসব আর খাব।”
তোতাপুরীর গল্প – রাজার সাধুসেবা –
৺কাশীর দুর্গাবাড়ির নিকট নানকপন্থীর মঠে
ঠাকুরের মোহন্তদর্শন ১৮৬৮ খ্রীঃ
“ন্যাংটা বললে, কোন রাজা সোনার থালা, সোনার গেলাস দিয়ে সাধুদের খাওয়ালে। কাশীতে মঠে দেখলাম, মোহন্তর কত মান – বড় বড় খোট্টারা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, আর বলছে, কি আজ্ঞা!
“ঠিক ঠিক সাধু – ঠিক ঠিক ত্যাগী সোনার থালও চায় না, মানও চায় না। তবে ঈশ্বর তাদের কোন অভাব রাখেন না! তাঁকে পেতে গেলে যা যা দরকার, সব জোগাড় করে দেন। (সকলে নিঃশব্দ)
“আপনি হাকিম – কি বলবো! – যা ভালো বোঝ তাই করো। আমি মূর্খ।
অধর (সহাস্যে, ভক্তদিগকে) – উনি আমাকে এগজামিন কচ্ছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – নিবৃত্তিই ভাল। দেখ না আমি সই কল্লাম না। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু!
হাজরা আসিয়া ভক্তদের কাছে মেঝেতে বসিলেন। হাজরা কখন কখন সোঽহং সোঽহম্ করেন! লাটু প্রভৃতি ভক্তদের বলেন, তাঁকে পূজা করে কি হয়! – তাঁরই জিনিস তাঁকে দেওয়া। একদিন নরেন্দ্রকেও তিনি ওই কথা বলিয়াছিলেন। ঠাকুর হাজরাকে বলিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) – লাটুকে বলেছিলাম, কে কারে ভক্তি করে।
হাজরা – ভক্ত আপনি আপনাকেই ডাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – এ তো খুব উঁচু কথা। বলি রাজাকে বৃন্ধাবলী বলেছিলেন, তুমি ব্রহ্মণ্যদেবকে কি ধন দেবে?
“তুমি যা বলছ, ওইটুকুর জন্যই সাধন-ভজন – তাঁর নামগুণগান।
“আপনার ভিতর আপনাকে দেখতে পেলে তো সব হয়ে গেল! ওইটি দেখতে পাবার জন্যই সাধনা। আর ওই সাধনার জন্যই শরীর। যতক্ষণ না স্বর্ণপ্রতিমা ঢালাই হয়, ততক্ষণ মাটির ছাঁচের দরকার হয়। হয়ে গেলে মাটির ছাঁচটা ফেলে দেওয়া যায়। ঈশ্বরদর্শন হলে শরীরত্যাগ করা যায়।
“তিনি শুধু অন্তরে নয়। অন্তরে বাহিরে! কালীঘরে মা আমাকে দেখালেন সবই চিন্ময়! – মা-ই সব হয়েছেন! – প্রতিমা, আমি, কোশা, চুমকি, চৌকাট, মার্বেল পাথর, – সব চিন্ময়!
“এইটি সাক্ষাৎকার করবার জন্যই তাঁকে ডাকা – সাধন-ভজন – তাঁর নামগুন-কীর্তন। এইটির জন্যই তাঁকে ভক্তি করা। ওরা (লাটু প্রভৃতি) এমনি আছে – এখনও অত উচ্চ অবস্থা হয় নাই। ওরা ভক্তি নিয়ে আছে। আর ওদের (সোঽহম্ ইত্যাদি) কিছু বলো না।”
পাখি যেমন শাবকদের পক্ষাচ্ছাদন করিয়া রক্ষা করে, দয়াময় গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সেই রূপে ভক্তদের রক্ষা করিতেছেন!
অধর ও নিরঞ্জন জলযোগ করিতে বারান্দায় গেলেন। জল খাইয়া ঘরে ফিরিলেন। মাস্টার ঠাকুরের কাছে মেঝেতে বসিয়া আছেন।
চারটে পাস ব্রাহ্ম ছোকরার কথা – “এঁর সঙ্গে আবার তর্ক-বিচার”
অধর (সহাস্যে) – আমাদের এত কথা হল, ইনি (মাস্টার) একটিও কথা কন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কেশবের দলের একটি চারটে পাস করা ছোকরা (বরদা?), সব্বাই আমার সঙ্গে তর্ক করছে, দেখে – কেবল হাসে। আর বলে, এঁর সঙ্গে আবার তর্ক! কেশব সেনের ওখানে আর-একবার তাকে দেখলাম – কিন্তু তেমন চেহারা নাই।
রাম চক্রবর্তী, বিষ্ণুঘরের পূজারী, ঠাকুরের ঘরে আসিলেন। ঠাকুর বলিতেছেন – “দেখো রাম! তুমি কি দয়ালকে বলেছ মিছরির কথা? না, না, ও আর বলে কাজ নাই। অনেক কথা হয়ে গেছে।
ঠাকুরের রাত্রের আহার – “সকলের জিনিস খেতে পারি না”
রাত্রে ঠাকুরের আহার একখানি-দুখানি মা-কালীর প্রসাদী লুচি ও একটু সুজির পায়েস। ঠাকুর মেঝেতে আসনে সেবা করিতে বসিয়াছেন। কাছে মাস্টার বসিয়া আছেন, লাটুও ঘরে আছেন। ভক্তেরা সন্দেশাদি মিষ্টান্ন আনিয়াছিলেন। সন্দেশ একটি স্পর্শ করিয়া ঠাকুর লাটুকে বলিতেছেন – ‘এ কোন্ শালার সন্দেশ?’ – বলিয়াই সুজির পায়েসের বাটি হইতে নিচে ফেলিয়া দিলেন। (মাস্টার ও লাটুর প্রতি) ‘ও আমি সব জানি। ওই আনন্দ চাটুজ্যেদের ছোকরা এনেছে – যে ঘোষপাড়ার মাগীর কাছে যায়।’
লাটু – এ গজা দিব?
শ্রীরামকৃষ্ণ – কিশোরী এনেছে।
লাটু – এ আপনার চলবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – হাঁ।
মাস্টার ইংরেজী পড়া লোক। – ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন – “সকলের জিনিস খেতে পারি না! তুমি এ-সব মানো?”
মাস্টার – আজ্ঞা, ক্রমে সব মানতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ
ঠাকুর পশ্চিমদিকের গোল বারান্দাটিতে হাত ধুইতে গেলেন। মাস্টার হাতে জল ঢালিয়া দিতেছেন।
শরৎকাল। চন্দ্র উদয় হওয়াতে নির্মল আকাশ ও ভাগীরথীবক্ষ ঝকমক করিতেছে। ভাটা পড়িয়াছে – ভাগীরথী দক্ষিণবাহিনী। মুখ ধুইতে ধুইতে মাস্টারকে বলিতেছেন, তবে নারাণকে টাকাটি দেবে?
মাস্টার – যে আজ্ঞা, দেব বইকি?
-১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর-
……………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চবিংশ অধ্যায় : পঞ্চম পরিচ্ছেদ
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….