নরেন্দ্র কর্তৃক শ্রীরামকৃষ্ণের প্রচারকার্য
আজ আমরা একটু আলচনা করিব, পরমহংসদেবের সেই বিশ্বজনীন সনাতন হিন্দুধর্ম স্বামীজী কিরূপ প্রচার করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।
(REALISATION OF GOD)
শ্রীরামকৃষ্ণের কথা – ঈশ্বরকে দর্শন করিতে হইবে। কতকগুলি মত মুখস্থ বা শ্লোক মুখস্থ করার নাম ধর্ম নহে। এই ঈশ্বরদর্শন হয়, যদি ভক্ত ব্যাকুল হইয়া তাঁহাকে ডাকে, এই জন্মেই হউক অথবা জন্মান্তরেই হউক। একদিনের তাঁহার কথাবার্তা আমাদের মনে পড়ে। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে কথা হইতেছিল।
পরমহংসদেব কাশীপুরের মহিমাচরণ চক্রবর্তীকে বলিতেছিলেন – (রবিবার, ২৬শে অক্টোবর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ।)
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণ ও অন্যান্য ভক্তদের প্রতি) – শাস্ত্র কত পড়বে? শুধু বিচার করলে কি হবে? আগে তাঁকে লাভ করবার চেষ্টা কর। বই পড়ে কি জানবে? যতক্ষণ না হাটে পৌঁছান যায়, ততঁন দূর হতে কেবল হো-হো শব্দ। হাটে পৌঁছিলে আর-একরকম, তখন স্পষ্ট স্পষ্ট দেখতে পাবে, শুনতে পাবে, ‘আলু লও’ ‘পয়সা দাও’।
বই পড়ে ঠিক অনুভব হয় না। অনেক তফাত। তাঁহাকে দর্শনের পর শাস্ত্র, সায়েন্স সব খড়কুটো বোধ হয়।
“বড়বাবুর সঙ্গে আলাপ দরকার। তাঁর কখানা বাড়ি, কটা বাগান, কত কোম্পানির কাগজ; এ-সব আগে জানবার জন্য অত ব্যস্ত কেন? কিন্তু জো-সো করে বড়বাবুর সঙ্গে একবার আলাপ কর, তা ধাক্কা খেয়েই হউক আর বেড়া ডিঙ্গিয়েই হউক, তখন ইচ্ছা হয় তো তিনিই বলে দিবেন, তাঁর কখানা বাড়ি, কত বাগান, কত কোম্পানির কাগজ। বাবুর সঙ্গে আলাপ হলে আবার চাকর দ্বারবান সব সেলাম করবে।” (সকলের হাস্য)
একজন ভক্ত – এখন বড়বাবুর সঙ্গে আলাপ কিসে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ – তাই কর্ম চাই। সাধন চাই। ঈশ্বর আছেন বলে বসে থাকলে হবে না। তাঁর কাছে যেতে হবে। নির্জনে তাঁকে ডাকো, প্রার্থনা করো – ‘দেখা দাও’ বলে। ব্যকুল হয়ে কাঁদো। কামিনী-কাঞ্চনের জন্য পাগল হয়ে বেড়াতে পার, তবে তাঁর জন্য একটু পাগল হও। লোক বলুক যে, ঈশ্বরের জন্য অমুক পাগল হয়ে গেছে। দিনকতক না হয় সব ত্যাগ করে তাঁকে একলা ডাকো। শুধু ‘তিনি আছেন’ বলে বসে থাকলে কি হবে? হালদার-পুকুরে বড় মাছ আছে, পুকুরের পাড়ে শুধু বসে থাকলে কি মাছ পাওয়া যায়? চার কর, চার ফেল। ক্রমে গভীর জল থেকে মাছ আসবে আর জল নড়বে। তখন আনন্দ হবে। হয়তো মাছের খানিকটা একবার দেখা গেল, মাছটা ধপাং করে উঠলো। যখন দেখা গেল, আরও আনন্দ।১
ঠিক এই কথা স্বামীজীও চিকাগোর ধর্মসমিতি সমক্ষে বলিলেন – অর্থাৎ ধর্মের উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে লাভ করা, দর্শন করা –
“The Hindu does not want to live upon words and theories. He must see God and that alone can destroy all doubts. So the best proof of a Hindu sage gives about the soul, about God, is ‘I have seen the soul; I have seen God’. * * * The whole struggle in their system is a constant struggle to become perfect, to become divine, to reach God and see God; and their reaching God, seeing God, becoming perfect even ‘as the Father in Heaven is perfect’ constitutes the religion of the Hindus.”
- Lecture on Hinduism (Chicago Parliament of Religions.)
আমেরিকার অনেক স্থানে স্বামী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সকল স্থানেই এই কথা। Hartford নামক স্থানে বলিয়াছিলেন –
“The next idea that I want to bring to you is that religion does not consist in doctrines or dogmas. * * * The end of all religions is the realisation of God in the soul. Ideals and methods may differ but that is the central point. That is the realisation of God, something behind this world of sense – this world of eternal eating and drinking and talking nonsense – this world of shadows and selfishness. There is that beyond all books, beyond all creeds, beyond the vanities of this world, and that is the realisation of God within yourself. A man may believe in all the churches in the world, he may carry on his head all the sacred books ever written, he may baptise himself in all the rivers of the earth; still if he has no perception of God I would class him with the rankest atheist.”
স্বামী তাঁহার ‘রাজযোগ’ নামক গ্রন্থে বলিয়াছেন যে, আজকাল লোক বিশ্বাস করে না যে, ঈশ্বরদর্শন হয়; লোকে বলে, হাঁ ঋষিরা অথবা খ্রীষ্ট প্রভৃতি মহাপুরুষগণ আত্মদর্শন করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু আজকাল আর তাহা হয় না। স্বামীজী বলেন, অবশ্য হয় – মনের যোগ (Concentration) অভ্যাস কর, অবশ্য হদয় মধ্যে তাঁহাকে পাইবে –
“The teachers all saw God; they all saw their own souls and what they saw preached. Only there is this difference that in most of these religions, especially in modern times, a peculiar claim is put before us and that claim is that these experiences are impossible at the present day; they were only possible with a few men, who were the first founders of the religions that subsequently bore their names. At the present time these experiences have become obsolete and therefore we have now to take religion on belief. This I entirely deny. Uniformity is the rigorous law of nature; what once happened can happen always.”
- Raja-Yoga: Introductory.
স্বামী New York নামক নগরে ৯ই জানুয়ারি, ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বজনীন ধর্ম কাহাকে বলে (Ideal of a Universal Religion) এই বিষয়ে একটি বক্তৃতা দিয়াছিলেন – অর্থাৎ যে ধর্মে জ্ঞানী, ভক্ত, যোগী বা কর্মী সকলেই মিলিত হইতে পারে। বক্তৃতা সমাপ্ত হইবার সময় ঈশ্বরদর্শন যে সব ধর্মের উদ্দেশ্য, এই কথা বলিলেন – জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি এগুলি নানা পথ, নানা উপায় – কিন্তু গন্তব্যস্থান একই অর্থাৎ ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার। স্বামী বলিলেন –
“Then again all these various yogas (work or woরship, psychic control or philosophy) have to be carried out into practice, theories will not do. We have to meditate upon it, realise it until it becomes our whole life. Religion is realisation, nor talk nor doctrine nor theories, however beautiful they may be. It is being and beoming, not hearing or acknowledging. It is not an intellectual assent. By intellectual assent we can come to hundred sorts of foolish things and change them next day, but this being and becoming is what is Religion.”
মাদ্রাজীদের নিকট তিনি যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতেও ওই কথা। – হিন্দুধর্মের বিশেষত্ব ঈশ্বরদর্শন – বেদের মুখ্য উদ্দেশ্য ঈশ্বরদর্শন –
“The one idea which distinguishes the Hindu religion from every other in the world, the one idea to express which the sages almost exhaust the vocabulary of the Sanskrit language, is that man must realise God. * * * Thus to realise God, the Brahman as the Dvaitas (dualists) say, or to become Brahman as the Advaitas say – is the aim and end of the whole teachings of the Vedas.”
- Reply to Madras Address.
স্বামী ২৯শে অক্টোবর (১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দ) লণ্ডন নগরে বক্তৃতা করেন, বিষয়, ঈশ্বরদর্শন (Realisation) এই বক্তৃতায় কঠোপনিষৎ পাঠ করিয়া নচিকেতার কথা উল্লেখ করিলেন। নচিকেতা ঈশ্বরকে দেখিতে চান, ব্রহ্মজ্ঞান চান। ধর্মরাজ যম বলিলেন, বাপু, যদি ঈশ্বরকে জানিতে চাও, দেখিতে চাও, তাহা হইলে ভোগ আসক্তি ত্যাগ করিতে হইবে; ভোগ থাকিলে যোগ হয় না, অবস্তু ভালবাসিলে বস্তুলাভ হয় না। স্বামী বলিতে লাগিলেন, আমরা বলিতে গেলে সকলেই নাস্তিক, কতকগুলি বাক্যের আড়ম্বর লইয়া ধর্ম ধর্ম বলিতেছি। যদি একবার ঈশ্বরদর্শন হয়, তাহা হইলেই প্রকৃত বিশ্বাস আসিবে।
“We are all atheists and yet we try to fight the man who tries to confess it. We are all in the dark; religion is to us a mere nothing, mere intellectual assent, mere talk – this man talks well and that man evil. Religion will begin when that actual realisation in our own souls begins. That will be the dawn of religion. * * * Then will real faith begin.”
………………………………
১ যীশুখ্রীষ্ট তাঁহার শিষ্যদের বলিতেন -“Blessed are the pure in spirit, for they shall see God.’