শ্রীরামকৃষ্ণ, ব্রাহ্মসমাজ, নরেন্দ্র ও পাপবাদ
[THE DOCTRINE OF SIN]
স্বামীজীর গুরুদেব ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “ঈশ্বরের নাম লইলে ও আন্তরিক তাঁহার চিন্তা করিলে পাপ পলাইয়া যায়। যেমন তুলার পাহাড় অগ্নিস্পর্শে একক্ষণে পুড়িয়া যায়; অথবা যেমন বৃক্ষে পাখি অনেক বসিয়াছে, হাততালি দিলে সব উড়িয়া যায়।”
একদিন কেশববাবুর সহিত কথা হইতেছিল –
শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের প্রতি) – মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত! আমি মুক্ত পুরুষ – সংসারেই তাকি, আর অরণ্যেই থাকি – আমার বন্ধন কি? আমি ঈশ্বরের সন্তান, রাজাধিরাজের ছেলে, আমায় আবার বাঁধে কে? যদি সাপে কামড়ায়, – ‘বিষ নাই’, ‘বিষ নাই’; জোর করে বললে বিষ ছেড়ে যায়। তেমনিই ‘আমি বদ্ধ নই’ ‘আমি বদ্ধ নই’ ‘আমি মুক্ত’ এই কথাটি রোক করে বলতে বলতে তাই হয়ে যায়। মুক্তই হয়ে যায়।
“খ্রীষ্টানদের একখানা বই (বাইবেল) একজন দিলে। আমি পড়ে শুনাতে বললাম। তাতে কেবল ‘পাপ’ আর ‘পাপ’। তোমাদের ব্রাহ্মসমাজেও কেবল ‘পাপ’ আর ‘পাপ’। যে ব্যক্তি আমি বদ্ধ বারবার বলে, সে শেষে বদ্ধই হয়ে যায়। যে রাতদিন ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ এই করে, সে তাই হয়ে যায়।
“ঈশ্বরের নামে এমন বিশ্বাস হওয়া চাই – কি! আমি তাঁর নাম করেছি, আমার এখনও পাপ থাকবে? আমার আবার বন্ধন কি, পাপ কি? কৃষ্ণকিশোর পরম হিন্দু, সদাচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ। সে বৃন্দাবনে গিয়েছিল। একদিন ভ্রমণ করতে করতে তার জলতৃষ্ণা পেয়েছিল। একটা কুয়ার কাছে গিয়ে দেখলে, একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে বললে, ‘ওরে, তুই আমায় একঘটি জল দিতে পারিস? তুই কি জাত?’ সে বললে, ‘ঠাকুর মশাই, আমি হীন জাত – মুচি।’ কৃষ্ণকিশোর বললে, ‘তুই বল, শিব, আর জল তুলে দে।’
“ভগবানের নাম করলে দেহ-মন সব শুদ্ধ হয়ে যায়। কেবল ‘পাপ’ আর ‘নরক’ এ-সব কথা কেন? একবার বল যে অন্যায় কর্ম যা করেছি, তা আর করবো না। আর তাঁহার নামে বিশ্বাস কর।”
স্বামীজীও খ্রীষ্টানদের এই পাপবাদ সম্বন্ধে বলিলেন, পাপ কি! তোমরা অমৃতের অধিকারী, Sons of Immortal Bliss. তোমাদের ধর্মযাজকেরা রাত্রদিন নরকাগ্নির কথা বলেন, সে-কথা শুনিও না।
“Ye are the children of God, the sharers of immortal bliss, holy and perfect beings. Ye divinities on earth – Sinners! It is a sin to call a man so. Come up, O lions! and shake off the delusion that you are sheep! You are souls immortal spirits free and blest – and eternal, ye are not bodies; matter is your servant, not you the servant of matter.”
- Lecture on Hinduism (Chicago)
আমেরিকার হার্টফোর্ড নামক স্থানে স্বামী বক্তৃতা করিবার জন্য নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। এখানকার American Consul Patterson তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ও সভাপতির কার্য করিয়াছিলেন। স্বামী আবার খ্রীষ্টানদের পাপবাদ সম্বন্ধে বলিলেন, যদি ঘর অন্ধকার হয়, তাহলে ‘অন্ধকার’ ‘অন্ধকার’ করিলে কি হইবে? আলো জ্বালো তবে ত হবে –
“Shall we advise men to kneel down and cry – Oh miserable sinner that I am! No, rather let us remind them of their divine nature…..If the room is dark, do you go about striking your breast and crying, “It is dark!’ No, the only way to get into light is to strike a light and then the darkness goes. – The only way to realise the Light above you, is to strike the spiritual light within you and the darkness of impurity and sin will flee away. Think of your higher Self, not of your lower.”
স্বামী পরমহংসদেবের কাছে একটি গল্প১ শুনিয়াছিলেন, সেই গল্পটই বলিলেন – একটা বাঘিনী একটা ছাগলের পাল আক্রমণ করেছিল। পূর্ণগর্ভা, তাই লাফ দিতে গিয়ে ছানা হয়ে গেল। বাঘিনীর মৃত্যু হল। ছানাটি ছাগলের সঙ্গে মানুষ হতে লাগল, আর তাদের সঙ্গে ঘাস খেতে লাগল ও ‘ভ্যা – অ্যা, ভ্যা – অ্যা’, করতে লাগল। কিছুদিন পরে সে ছানাটি বেশ বড় হল। একদিন ছাগলের পালে আর একটি বাঘ পড়ল। সে দেখে অবাক্ যে, একটা বাঘ ঘাস খাচ্ছে, আর ভ্যা – ভ্যা করছে, আবার তাকে দেখে ছাগলের মতো পালাচ্ছে। তখন তাকে ধরে জলের কাছে নিয়ে গেল ও বললে, ‘তুইও বাঘ, তুই ঘাস খাচ্ছিস কেন, আর ভ্যা – ভ্যা করছিল কেন – দেখ আমি কেমন মাংস খাচ্ছি। তুইও খা, ওই দেখ – জলে তোর মুখ দেখা যাচ্চে আমার মতো!’ বাঘটা সব দেখলে, মাংসেরও আস্বাদ পেলে।”
……………………..
১ এই আখ্যায়িকাটি সাংখ্যদর্শনে আছে। আখ্যায়িকা প্রকরণ।