শ্রীরামকৃষ্ণ, বিজয়, কেশব, নরেন্দ্র ও ‘কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ’ – সন্ন্যাস
(Renunciation)
একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে কথাবার্তা কহিতেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়ের প্রতি) – কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ না করলে লোকশিক্ষা দেওয়া যায় না। দেখ না, কেশব সেন ওইটি পারলে না বলে, কি হল শেষটা! তুমি নিজে ঐশ্বর্যের ভিতর, কামিনী-কাঞ্চনের ভিতর থেকে যদি বল ‘সংসার অনিত্য, ঈশ্বরই বস্তু’, অনেকে তোমার কথা শুনবে না। আপনার কাছে গুড়ের নাগরি রয়েছে, পরকে বলছো গুড় খেও না! তাই ভেবে-চিন্তে চৈতন্যদেব সংসারত্যাগ করলেন। তা না হলে জীবের উদ্ধার হয় না।
বিজয় – আজ্ঞে হাঁ, চৈতন্যদেব বলেছিলেন, কফ যাবে বলে পিপ্পলখণ্ড তৈয়ের করলাম১ – কিন্তু উলটো উৎপত্তি হল, কফ বেড়ে গেল; নবদ্বীপের অনেক লোক ব্যঙ্গ করতে লাগল ও বলল, নিমাই পণ্ডিত বেশ আছে হে; সুন্দরী স্ত্রী, প্রতিষ্ঠা, অর্থের অভাব নেই; বেশ আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ – কেশব যদি ত্যাগী হত অনেক কাজ হত। ছাগলের গায়ে ক্ষত থাকলে আর ঠাকুর সেবা হয় না। বলি দেওয়া হয় না। ত্যাগী না হলে লোকশিক্ষার অধিকারী হয় না। গৃহস্থ হলে কজন তার কথা শুনবে?
স্বামী বিবেকানন্দ কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, তাই তাঁহার ঈশ্বরবিষয়ে লোকশিক্ষা দেবার অধিকার। বিবেকানন্দ বেদান্তে ও ইংরেজী ভাষা ও দর্শনাদিতে পণ্ডিতাগ্রগণ্য, তিনি অসাধারণ বাগ্মী, সেই কি তাঁহার মাহাত্ম্য? ইহার উত্তর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দিবেন। দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে ভক্তদের সম্বোধন করিয়া পরমহংসদেব ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বলিতেছেন –
“এই ছেলেটিকে২ দেখছো এখানে একরকম। দুরন্ত ছেলে, বাবার কাছে যখন বসে, যেন জুজুটি। আবার চাঁদনিতে যখন খেলে, তখন আর এক মূর্তি। এরা নিত্যসিদ্ধের থাক। এরা সংসারে কখন বদ্ধ হয় না। একটু বয়স হলেই চৈতন্য হয়, আর ভগবানের দিকে চলে যায়। এরা সংসারে আসে জীবশিক্ষার জন্য। এদের সংসারে বস্তু কিছু ভাল লাগে না – এরা কামিনী-কাঞ্চনে কখনও আসক্ত হয় না।
“বেদে আছে হোমাপাখির কথা। খুব উঁচু আকাশে সে পাখি থাকে। সেই আকাশেই সে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়লেই ডিমটা পড়তে থাকে। ডিম পড়তে পড়তে ফুটে যায়। তখন ছানাটা পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে তার চোখ ফুটে আর ডানা বেরোয়। চোখ ফুটলেই দেখতে পায় যে, সে পড়ে যাচ্ছে, আর শরীর মাটিতে লাগলে একেবারে চুরমার হয়ে যাবে। তখন সে পাখি মার দিকে, ঊর্ধ্বদিকে চোঁচা দৌড় দেয়, আর উঁচুতে উঠে যায়।”
বিবেকানন্দ এই ‘হোমাপাখি’ – তাঁর জীবনের এক লক্ষ্য মার কাছে চোঁচা দৌড় দিয়ে উঠে যাওয়া – গায়ে মাটি না ঠেকতে ঠেকতে অর্থাৎ সংসার স্পর্শ না করতে করতে ভগবানের পতে অগ্রসর হওয়া।
শ্রীরামকৃষ্ণ ৺বিদ্যাসাগরকে বলিয়াছিলেন, “পাণ্ডিত্য! শুধু পাণ্ডিত্যে কি হবে? শকুনিও অনেক উঁচুতে উঠে, কিন্তু নজর ভাগাড়ের দিকে – কোথায় পচা মড়া। পণ্ডিত অনেক শ্লোক ফড়র ফড়র করতে পারে, কিন্তু মন কোথায়? যদি হরিপাদপদ্মে থাকে, আমি তাকে মানি, যদি কামিনী-কাঞ্চনে থাকে, তাহলে আমার খড়কুটো বোধ হয়।”
স্বামী বিবেকানন্দ শুধু পণ্ডিত নহেন, তিনি সাধু, মহাপুরুষ! শুধু পাণ্ডিত্যের জন্য ইংরেজ ও আমেরিকাবাসিগণ ভৃত্যের ন্যায়, তাঁহার সেবা করেন নাই। তঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, ইনি আর এক জাতীয় লোক। সম্মান, টাকা, ইন্দ্রিয়সুখ, পাণ্ডিত্য প্রভৃতি লোকে রহিয়াছে; ইঁহার কিন্তু এক লক্ষ্য ঈশ্বরলাভ। সন্ন্যাসীর গীতিতে তিনিই বলিয়াছেন, সন্ন্যাসী কামিনী-কাঞ্চনত্যাগ করিবে।
“Truth never comes where lust
and fame and greed
Of gain reside. No man who
thinks of woman
As his wife can ever perfect be.
Nor he who owns however little,
Nor he –
Whom anger chains – Can ever pass
thro’ Maya’s gates.
So give these up, sannyasin bold, Say –
“Om Tat Sat Om!”
- Song of the Sannyasin.
আমেরিকায় তাঁহার প্রলোভন কম হয় নাই। একে জগদ্ব্যাপী প্রতিষ্ঠা; তাহাতে সর্বদাই পরমাসুন্দরী উচ্চবংশীয়া সুশিক্ষিতা মহিলাগণ আসিয়া আলাপ ও সেবা করিতেন। তাঁহার এত মোহিনীশক্তি যে, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে তাঁহাকে বিবাহ করিতে চাহিতেন। একজন অতি ধনাঢ্যের কন্যা (heiress) সত্য সত্য একদিন আসিয়া তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, “স্বামী! আমার সর্বস্ব ও আমাকে আপনাকে সমর্পণ করিলাম।” স্বামী তদুত্তরে বলিলেন, “ভদ্রে! আমি সন্ন্যাসী, আমার বিবাহ করিতে নাই। সকল স্ত্রীলোক আমার মাতৃস্বরূপা!” ধন্য বীর! তুমি গুরুদেবের উপযুক্ত শিষ্য! তোমার গাত্র যথার্থই পৃথিবীর মৃত্তিকা স্পর্শ করে নাই। তোমার গাত্রে কামিনী-কাঞ্চনের দাগটি পর্যন্ত লাগে নাই। তুমি প্রলোভনের রাজ্য হইতে পলায়ন কর নাই। তাহার মধ্যে থাকিয়া, শ্রীনগরে বাস করিয়া, ইশ্বরের পথে অগ্রসর হইয়াছ। তুমি সামান্য জীবের ন্যায় দিন কাটাইতে চাও নাই। তুমি দেবভাবের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রাখিয়া এ-মর্ত্যধাম ত্যাগ করিয়া গিয়াছ।
…………………………………
১ পিপুলখণ্ড – অর্থাৎ নবদ্বীপে হরিনাম প্রচার।
২ স্বামী বিবেকানন্দ তখন জেনার্যাল্ অ্যাসেমব্লি কলেজে পড়েন। বয়স ১৯।২০। তাঁহার বাড়ি তখন কলেজের কাছে সিমুলিয়ায়। পিতার নাম ৺বিশ্বনাথ দত্ত হাইকোর্টের এটর্ণি। বালকের নাম নরেনদ্র। কলেজে থাকিয়া বি. এ. পাশ করিয়াছিলেন। তখন Hastie সাহেব প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। এক্ষণে তাঁহার ভাই ভগ্নীরা আছেন। স্বামীর জন্মদিন – সোমবার, পৌষ সংক্রান্তি, ১২৬৯ সাল, প্রাতে ৬-৩১।৩৩ সময়, সূর্যোদয়ের ৬ মিনিট পূর্বে; বয়স – ৩৯ বৎসর ৫ মাস ২৪ দিন হইয়াছিল।