শ্রীরামকৃষ্ণ, কর্মযোগ, নরেন্দ্র ও দরিদ্রনারায়ণ সেবা
(নিষ্কাম কর্ম)
পরমহংসদেব বলিতেন, কর্ম সকলেরই করিতে হয়। জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম এই তিনটি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার পথ। গীতায় আছে, – সাধু, গৃহস্থ, প্রথমে চিত্তশুদ্ধির জন্য গুরুর উপদেশ অনুসারে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করিবে। ‘আমি কর্তা’ এটি অজ্ঞান, ধন-জন কার্যকলাপ আমার, এটিও অজ্ঞান। গীতায় আছে, আপনাকে অকর্তা জেনে ইশ্বরকে ফল সমর্পণ করে কাজ করতে হয়। গীতায় আরও আছে যে, সিদ্ধিলাভের পরও প্রত্যাদিষ্ট হইয়া কেহ কেহ, যেমন জনকাদি, কর্ম করেন। গীতায় যে আছে কর্মযোগ সে এই। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও ওই কথা বলিতেন।
তাই কর্মযোগ বড় কঠিন। অনেকদিন নির্জনে ঈশ্বরের সাধনা না করলে অনাসক্ত হয়ে কর্ম করা যায় না। সাধনার অবস্থায় গুরুর উপদেশ সর্বদা প্রয়োজন। তখন কাঁচা অবস্থা, তাই কোন্ দিক থেকে আসক্তি এসে পড়ে জানতে পারা যায় না। মনে করছি, আমি অনাসক্ত হয়ে ঈশ্বরে ফল সমর্পণ করে, জীবসেবা দানাদি কার্য করছি; কিন্তু বাস্তবিক আমি হয় তো লোকমান্য হবার জন্য করছি, নিজেই বুঝতে পারছি না। যে ব্যক্তি গৃহস্থ, যার গৃহ, পরিজন, আত্মীয়-কুটুম্ব, আমার বলবার আছে, তাকে দেখে নিষ্কাম কর্ম ও অনাসক্তি, পরার্থে স্বার্থত্যাগ, এ-সকল শিক্ষা করা বড় কঠিন।
কিন্তু সর্বত্যাগী কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী সিদ্ধ মহাপুরুষ যদি নিষ্কাম কর্ম করে দেখান, তাহলে লোক সহজে উহা বুঝিতে পারে ও তাঁহার পদানুসরণ করে।
স্বামী বিবেকানন্দ কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী। তিনি নির্জনে গুরুর উপদেশে অনেকদিন সাধনা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন। তিনি যথার্থে কর্মযোগের অধিকারী। তবে তিনি সন্ন্যাসী, মনে করিলেই ঋষিদের মতো অথবা তাঁহার গুরুদেব পরমহংসদেবের মতো কেবল জ্ঞান-কর্ম লইয়া থাকিতে পারিতেন। কিন্তু তাঁহার জীবন কেবল ত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখাইবার জন্য হয় নাই। সংসারীরা যে সকল বস্তু গ্রহণ করে, অনাসক্ত হইয়া তাহাদের কিরূপ ব্যবহার করিতে হয়, নারদ, শুকদেব ও জনকাদির ন্যায় স্বামীজী লোকসংগ্রহার্থ তাহাও দেখাইয়া গিয়াছেন। তিনি অর্থ ও মান, এ-সকলকে সন্ন্যাসীর ন্যায় কাকবিষ্ঠা জ্ঞান করিতেন বটে, অর্থাৎ নিজে ভোগ করিতেন না; কিন্তু তাহাদিগকে জীবসেবার্থে কিরূপে ব্যবহার করিতে হয়, তাহা উপদেশ দিয়া ও নিজে কাজ করিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন। যে অর্থ বিলাত ও আমেরিকার বন্ধুবর্গের নিকট হইতে তিনি সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সে সমস্ত অর্থ জীবের মঙ্গলকল্পে ব্যয় করিয়াছেন। স্থানে স্থানে, যথা কলিকাতার নিকটস্থ বেলুড়ে, আলমোরার নিকটস্থ মায়াবতীতে, কাশীধামে ও মাদ্রাজ ইত্যাদি স্থানে মঠ স্থাপন করিয়াছেন। দুর্ভিক্ষপীড়িতদিগকে নানা স্থানে – দিনাজপুর, বৈদ্যনাথ, কিষেণগড়, দক্ষিণেশ্বর ও অন্যান্য স্থানে – সেবা করিয়াছেন। দুর্ভিক্ষের সময় পিতৃমাতৃহীন অনাথ বালক-বালিকাগণকে অনাথাশ্রম করিয়া রাখিয়া দিয়াছেন। রাজপুতনার অন্তর্গত কিষেণগড় নামক স্থানে অনাথাশ্রম স্থাপন করিয়াছিলেন। মুর্শিদাবাদের নিকট (ভাবদা) সারগাছী গ্রামে এখনও অনাথাশ্রম চলিতেছে। হরিদ্বার-নিকটস্থ কনখলে পীড়িত সাধুদিগের জন্য স্বামী সেবাশ্রম স্থাপন করিয়াছেন। প্লেগের সময় প্লেগব্যাধি-আক্রান্ত রোগীদিগকে অনেক অর্থব্যয় করিয়া সেবা-শুশ্রূষা করাইয়াছেন। দরিদ্র কাঙালের কন্য একাকী বসিয়া কাঁদিতেন। আর বন্ধুদের সমক্ষে বলিতেন, “হায়! এদের এত কষ্ট, ঈশ্বরকে চিন্তা করিবার অবসর পর্যন্ত নাই।”
গুরূপদিষ্ট কর্ম, নিত্যকর্ম ছাড়া অন্য কর্মতো বন্ধনের কারণ। তিনি সন্ন্যাসী। তাঁহার কর্মের কি প্রয়োজন?
“Who sows must reap,” they say
and “cause must bring
The sure effect. Good good;
bad bad; and none
Escape the law. But who so
wears a form Must wear the chain.” Too true,
but far beyond
Both name and form is Atman,
ever free.
Know thou art That, sannyasin bold!
say “Om Tat Sat, Om.”Song of the Sannaysin
কেবল লোকশিক্ষার জন্য ঈশ্বর তাঁহাকে এই সকল কর্ম করাইলেন। এখন সাধু বা সংসারী সকলে শিখিবে যে, যদি তাহারাও কিছুদিন নির্জনে গুরুর উপদেশে ঈশ্বরের সাধনা করিয়া ভক্তিলাভ করে, তাহারাও স্বামীজীর ন্যায় নিষ্কাম কর্ম করিতে পারিবে, যথার্থা অনাসক্ত হইয়া দানাদি সৎকার্য করিতে পারিবে। স্বামীজীর গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে আঠা লাগবে না।” অর্থাৎ নির্জনে সাধনের পর ভক্তিলাভ করিয়া প্রত্যাদিষ্ট হইয়া লোকশিক্ষার্থ পৃথিবীর কার্যে হাত দিলে ঈশ্বরের কৃপায় যথার্থ নির্লিপ্তভাবে কাজ করা যায়। স্বামী বিবেকানন্দের জীবন অনুধ্যান করিলে, নির্জনে সাধন কাহাকে বলে ও লোকশিক্ষার্থ কর্ম কাহাকে বলে, তাহার আভাস পাওয়া যায়।
বিবেকানন্দের এ-সকল কর্ম লোকশিক্ষার্থ।
কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি ৷৷
এই গীতোক্ত কর্মযোগ অতিশয় কঠিন। জনকাদি কর্মের দ্বারা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন যে, জনক তাহার পূর্বে নির্জনে বনে অনেক কঠোর তপস্যা করিয়াছিলেন। তাই সাধুরা জ্ঞান ও ভক্তিপথ অবলম্বন করিয়া সংসার-কোলাহল ত্যাগ করিয়া নির্জনে ঈশ্বরসাধন করেন। তবে স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় উত্তম অধিকারী বীরপুরুষ কেবল এই কর্মযোগের অধিকারী। ভগবানকে অনুভব করিতেছেন, অথচ লোকশিক্ষার জন্য প্রত্যাদিষ্ট হইয়া সংসারে কর্ম করিতেছেন, এরূপ মহাপুরুষ পৃথিবীতে কয়টি? ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা, কামিণী-কাঞ্চনের দাগ একটিও লাগে নাই, অথচ জীবের সেবার জন্য ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতেছেন, এরূপ আচার্য কয়টি দেখা যায়?
স্বামীজী লণ্ডনে ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ১০ই নভেম্বর বেদান্তের কর্মযোগ ব্যাখ্যায় গীতার কথা বলিলেন –
“Curiously enough the scene is laid on the battlefield where Krishna teaches the philosophy to Arjuna; and the doctrine which stands out luminously in every page of the Gita is intense activity, but in the midst of that, eternal calmness. And this idea is called the secret of work to attain which is the goal of the Vedanta.” (London) – Practical Vedanta
বক্তৃতায় স্বামীজী কর্মের মধ্যে সন্ন্যাসীর ভাবের (‘Calmness in the midst of activity’) কথা বলিয়াছেন। স্বামী ‘রাগদ্বেষ-বিবর্জিত’ হইয়া কর্ম করিতে চেষ্টা করিতেন। তিনি যে এরূপ কর্ম করিতে পারিতেন, সে কেবল তাঁর তপস্যার গুণে, তাঁর ঈশ্বরানুভূতির বলে। সিদ্ধ পুরুষ অথবা শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় অবতারপুরুষ না হইলে এই স্থিরতা (‘Calmness’) হয় না।