১৮৮৫, ২৮শে জুলাই
শোকাতুরা ব্রাহ্মণীর বাটীতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
ঠাকুর বাগবাজারের একটি শোকাতুরা ব্রাহ্মণীর বাড়ি আসিয়াছেন। বাড়িটি পুরাতন ইষ্টকনির্মিত। বাড়ি প্রবেশ করিয়াই বাম দিকে গোয়ালঘর। ছাদের উপর বসিবার স্থান হইয়াছে। ছাদে লোক কাতার দিয়া, কেহ দাঁড়াইয়া কেহ বসিয়া আছেন। সকলেই উৎসুক – কখন ঠাকুরকে দেখিবেন।
ব্রাহ্মণীরা দুই ভগ্নী, দুই জনেই বিধবা। বাড়িতে এঁদের ভায়েরাও সপরিবারে থাকেন। ব্রাহ্মণীর একমাত্র কন্যা দেহত্যাগ করাতে তিনি যারপরনাই শোকাতুরা। আজ ঠাকুর গৃহে পদার্পণ করিবেন বলিয়া সমস্ত দিন উদ্যোগ করিতেছেন। যতক্ষণ ঠাকুর শ্রীযুক্ত নন্দ বসুর বাড়িতে ছিলেন, ততক্ষণ ব্রাহ্মণী ঘর-বাহির করিতেছিলেন, – কখন তিনি আসেন। ঠাকুর বলিয়া দিয়াছিলেন যে, নন্দ বসুর বাড়ি হইতে আসিয়া তাঁহার বাড়িতে আসিবেন। বিলম্ব হওয়াতে তিনি ভাবিতেছিলেন, তবে বুঝি ঠাকুর আসিবেন না।
ঠাকুর ভক্তসঙ্গে আসিয়া ছাদের উপর বসিবার স্থানে আসন গ্রহণ করিলেন। কাছে মাদুরের উপর মাস্টার, নারাণ, যোগীন সেন, দেবেন্দ্র, যোগীন। কিয়ৎক্ষণ পরে ছোট নরেন প্রভৃতি অনেক ভক্তেরা আসিয়া জুটিলেন। ব্রাহ্মণীর ভগ্নী ছাদের উপর আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বলিতেছেন – “দিদি এই গেলেন নন্দ বোসের বাড়ি খবর নিতে, কেন এত দেরি হচ্ছে; – এতক্ষণে ফিরবেন।”
নিচে একটি শব্দ হওয়াতে তিনি আবার বলিতেছেন – “ওই দিদি আসছেন।” এই বলিয়া তিনি দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি এখনও আসিয়া পৌঁছেন নাই।
ঠাকুর সহাস্যবদন, ভক্তপরিবৃত হইয়া বসিয়া আছেন।
মাস্টার (দেবেন্দ্রের প্রতি) – কি চমৎকার দৃশ্য। ছেলে-বুড়ো, পুরুষ-মেয়ে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়া রয়েছে! সকলে কত উৎসুক – এঁকে দেখবার জন্য! আর এঁর কথা শোনবার জন্য!
দেবেন্দ্র (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – মাস্টার মশাই বলছেন যে, এ জায়গাটি নন্দ বোসের চেয়ে ভাল জায়গা; – এদের কি ভক্তি!
ঠাকুর হাসিতেছেন।
এইবার ব্রাহ্মণীর ভগ্নী বলিতেছেন, “ওই দিদি আসছেন।”
ব্রাহ্মণী আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া কি বলিবেন, কি করিবেন কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছেন না।
ব্রাহ্মণী অধীর হইয়া বলিতেছেন, “ওগো, আমি যে আহ্লাদে আর বাঁচি না, গো! তোমরা সব বল গো আমি কেমন করে বাঁচি! ওগো, আমার চণ্ডী যখন এসেছিল, – সেপাই শান্ত্রী, সঙ্গে করে – আর রাস্তায় তারা পাহারা দিচ্ছিল – তখন যে এত আহ্লাদ হয়নি গো! – ওগো চণ্ডীর শোক এখন একটুও আমার নাই! মনে করেছিলাম, তিনি যেকালে এলেন না, যা আয়োজন করলুম, সব গঙ্গার জলে ফেলে দেব; – আর ওঁর (ঠাকুরের) সঙ্গে আলাপ করব না, যেখানে আসবেন একবার যাব, অন্তর থেকে দেখব, – দেখে চলে আসব।
“যাই – সকলকে বলি, আয়রে আমার সুখ দেখে যা! – যাই, – যোগীনকে বলিগে, আমার ভাগ্যি দেখে যা!”
ব্রাহ্মণী আবার আনন্দে অধীর হইয়া বলিতেছেন, “ওগো খেলাতে (লটারী-তে) একটা টাকা দিয়ে মুটে এক লাখ টাকা পেয়েছিল, – সে যেই শুনলে এক লাখ টাকা পেয়েছি, অমনি আহ্লাদে মরে গিছল – সত্য সত্য মরে গিছল! – ওগো আমার যে তাই হল গো! তোমরা সকলে আশীর্বাদ কর, না হলে আমি সত্য সত্য মরে যাব।”
মণি ব্রাহ্মণীর আর্তি ও ভাবের অবস্থা দেখিয়া মোহিত হইয়া গিয়াছেন। তিনি তাঁহার পায়ের ধুলা লইতে গেলেন। ব্রাহ্মণী বলিতেছেন, ‘সে কি গো!’ – তিনি মণিকে প্রতিপ্রণাম করিলেন।
ব্রাহ্মণী, ভক্তেরা আসিয়াছেন দেখিয়া আনন্দিত হইয়াছেন আর বলিতেছেন, “তোমরা সব এসেছ, – ছোট নরেনকে এনেছি, – বলি তা না হলে হাসবে কে!” ব্রাহ্মণী এইরূপ কথাবার্তা কহিতেছেন, উহার ভগ্নী আসিয়া ব্যস্ত হইয়া বলিতেছেন, “দিদি এসো না! তুমি এখানে দাঁড়ায়ে থাকলে কি হয়? নিচে এসো! আমরা কি একলা পারি।”
ব্রাহ্মণী আনন্দে বিভোর! ঠাকুর ও ভক্তদের দেখিতেছেন। তাঁদের ছেড়ে যেতে আর পারেন না।
এইরূপ কথাবার্তার পর ব্রাহ্মণী অতিশয় ভক্তিসহকারে ঠাকুরকে অন্য ঘরে লইয়া গিয়া মিশটান্নাদি নিবেদন করিলেন। ভক্তেরাও ছাদে বসিয়া সকলে মিষ্টমুখ করিলেন।
রাত প্রায় ৮টা হইল, ঠাকুর বিদায় গ্রহণ করিতেছেন। নিচের তলায় ঘরের কোলে বারান্দা, বারান্দা দিয়ে পশ্চিমাস্য হইয়া উঠানে আসিতে হয়। তাহার পর গোয়ালঘর ডান দিকে রাখিয়া সদর দরজায় আসিতে হয়। ঠাকুর যখন বারান্দা দিয়া ভক্তসঙ্গে সদর দরজার দিকে আসিতেছেন, তখন ব্রাহ্মণী উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতেছেন, “ও বউ, শীঘ্র পায়ের ধুলা নিবি আয়!” বউ ঠাকুরানী প্রণাম করিলেন। ব্রাহ্মণীর একটি ভাইও আসিয়া প্রণাম করিলেন।
ব্রাহ্মণী ঠাকুরকে বলিতেছেন, “এই আর একটি ভাই; মুখ্যু।”
শ্রীরামকৃষ্ণ – না, না, সব ভাল মানুষ।
একজন সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপ ধরিয়া আসিতেছেন, আসিতে আসিতে এক যায়গায় তেমন আলো হইল না।
ছোট নরেন উচ্চৈঃস্বরে বলিতেছেন, “পিদ্দিম ধর, পিদ্দিম ধর! মনে করো না যে, পিদ্দিম ধরা ফুরিয়ে গেল!” (সকলের হাস্য)
এইবার গোয়ালঘর। ব্রাহ্মণী ঠাকুরকে বলিতেছেন, এই আমার গোয়ালঘর। গোয়ালঘরের সামনে একবার দাঁড়াইলেন, চতুর্দিকে ভক্তগণ। মণি ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন ও পায়ের ধুলা লইতেছেন।
এইবার ঠাকুর গণুর মার বাড়ি যাইবেন।