ভবঘুরেকথা
মা লক্ষ্মীর পাঁচালী

দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ।
ধীরে ধীরে বইতেছে মলয় বাতাস।।
বৈকুন্ঠেতে একাসনে লক্ষ্মী নারায়ন।
করিতেছে কত কথা সুখে আলাপন।।
সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব কত কথা হয়।
শুনিয়া পুলকিত হয় দেবীর হৃদয়।।
অকস্মাৎ দেবর্ষি নারায়ন স্বরে।
আসিলেন ভক্তি চিত্তে বৈকুন্ঠ নগরে।।
প্রনাম করি দেবর্ষি বলেন বচন।
মর্ত্যে দুর্ভিক্ষ মাগো কি ভীষন।।
ঋষি বলে মা তুমি চঞ্চলা মন।
সর্বদা ঘোরো ভবন হতে ভবন।।
তাই মর্ত্যবাসী কষ্ট কত পায়।
দেখি তাহা কেমনে মম প্রানে সয়।।
অন্নাভাবে লোকে কত কষ্ট ভোগে।
মরিতেছে অনাহারে কৃশকায় রোগে।।
ধর্মাধর্ম লোকে সবে ত্যাগ করি দেয়।
স্ত্রী কন্যা বিক্রি করে ক্ষুধার জ্বালায়।।
দুর্ভিক্ষে হইলো শেষ মরে জীবগন।
দয়া করে মাগো তুমি করো নিবারন।।
এই দুর্দশা দেখি প্রানে নাহি সয়।
করো নিবারন মাগো হইয়া সদয়।।
নারদের বাক্য শুনি কহেন হরিপ্রিয়া।
বিশ্বমাতা আমি দেবী বিষ্ণুজায়া।।
যে যেমন করে সে তেমন পায়।
সে দোষে কর্মফল, করে হায় হায়।।
মহামায়ার স্বরূপে নারী সত্যবচন।
মর্ত্যবাসী না মানে এই কথন।।
সদাচার কুল শীল দিয়া বিসর্জন।
ঘরের লক্ষ্মীকে করে সদা বর্জন।।
এমন মনুষ্যজাতি মহাপাপ করে।
কর্ম দোষে লক্ষ্মী ত্যাজে তাহারে।।
নারীর পরম গতি স্বামী ভিন্ন কেবা।
ভুলেও না করে নারী পতি পদসেবা।।
যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেড়ায়।
গুরুজনে নানা কটুবাক্য শোনায়।।
সর্বদা হিংসা করে না মানে আচার।
হিংসাতে তার মজে সংসার।।
ছড়া নাহি দেয়, প্রভাতকালে।
লক্ষ্মী সে স্থান ছাড়িয়া চলে।।
অতিথি যদি উপস্থিত হয় দ্বারে।
দূর দূর করি তারায় তাহাড়ে।।
যেবা গুরু, ব্রাহ্মণ দেখি ভক্তি নাহি করে।
মম নিবাস কভু নহে সেই ঘরে।।
এঁয়োতির চিহ্ন সিঁদুর শাখা না দেয়।
বাসী কাপড়ে যথা তথা বেড়ায়।।
স্নান নিত্য নাহি করে যে মনুষ্য গণ।
ত্যাজিয়া তাহারে, করি অন্যত্র গমন।।
তিথি ভেদে যেবা নিষিদ্ধ দ্রব্য খায়।
হই না কভু তার ওপর সহায়।।
যে মনুষ্য ভক্তিভাবে একদশী না করে।
কদাপি নাহি থাকি তাহার ঘরে।।
উচ্চহাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে।
গুরুজন দেখি ঘোমটা না টানে।।
বয়োজ্যেষ্ঠ দেখি যারা প্রনাম না করে।
সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি দেয় ঘরে।।
ঠাকুর দেবতা আদি কভু না পূজে।
সাধু সন্ন্যাসী দেখি হাসাহাসি করে।।
এমন নারী যে গৃহেতে বসতি রয়।
লক্ষ্মী ত্যাজে তাহাকে জানিবে নিশ্চয়।।
এত বলি লক্ষ্মী দেবী বলেন মুনিকে।
কর্মদোষে মনুষ্য নিজ ফল ভোগে।।
ঋষি বলে মাগো তুমি জগতজননী।
সন্তান কে করো ক্ষমা হে সনাতনী।।
দূর করি দাও মা ভীষন মহামার।
বর দিয়ে জীবেরে করহ নিস্তার।।
এই বলি বিদায় হইলেন মহামুনি।
চিন্তিত হইয়া কহেন নারায়নী।।
কহ কহ কৃপাময় প্রভু নারায়ন।
কিরূপে নিস্কৃতি পাইবে জীবগণ।।
লক্ষ্মীদেবীর কথা শুনি কহেন জনার্দন।
শুন দেবী মন দিয়া আমার বচন।।
তুমি যে পরমা প্রকৃতি দেবী ভগবতী।
তোমার কৃপায় দূর হইবে অনাসৃষ্টি।।
যে জন গুরুবারে লক্ষ্মী ব্রত করে।
সুখে জীবন কাটাইবে তোমার বরে।।
লক্ষ্মী কভু নাহি ছাড়িবে তাহারে।
জীবনান্তে আসিবে সে বৈকুন্ঠ নগরে।।
মর্ত্যে গিয়া কর এই ব্রত প্রচার।
তোমার কৃপায় দূর হইবে অনাচার।।
গমন করেন দেবী শুনি হরির কথা।
পেঁচকে মর্ত্যে আইলেন জগতমাতা।।
অবন্তী নামক নগরী পাশে এক বন।
তথা আসি মা কমলা উপস্থিত হন।।
হেথায় ছিল ব্যবসায়ী ধনেশ্বর রায়।
অগাধ ধন, চৌদ্দ কূল বসি খায়।।
পত্নী সুমতি ছিল সাত কুমার।
সংসার ছিল তার লক্ষ্মীর ভান্ডার।।
যথাকালে ধনেশ্বর করিল গমন।
বিধবা হইলো পত্নী- ভাগ্যের লিখন।।
সর্বদা কলহ করে সপ্ত বধূ গণ।
মারমার কাটকাট হইত সর্বক্ষণ।।
সংসার রচিল যে যার মতো যার।
সুখের পরিবার হইল ছারখার।।
এই দুঃখে ধনেশ্বর পত্নী ভীষন শোকে।
বনে গমন করিল জীবন ত্যাজিতে।।
সেই বনে বৃদ্ধা বসি করে হায় হায়।
এই বুঝি লেখা ছিল বিধাতার খাতায়।।
এই দেখি হরিপ্রিয়া বৃদ্ধা রূপ ধরে।
ছদ্দবেশে দেখা দিলেন ধনেশ্বর ভার্যারে।।
দেবী কহেন কে তুমি দাহ পরিচয়।
কোথা হতে আসিলে বলোহ আমায়।।
স্থান বড় ভয়ানক নির্জন বন।
হেথা হোথা নানা জন্তু করে বিচরণ।
বুড়ি বলে মাগো পোড়া কপাল আমার।
ভয় আমি করি না আর মরিবার।।
এত বলি বৃদ্ধা সব কথা কন।
শুনিয়া দুঃখিত হইলো কমলার মন।।
বৃদ্ধা প্রতি বিষ্ণুপ্রিয়া কহেন বচন।
আত্মহত্যা মহাপাপ শাস্ত্রের লিখন।।
যাও তুমি গৃহে ফিরি করো লক্ষ্মী ব্রত।
অবশ্যই আসিবে সুখ পূর্বের মতো।।
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি এঁয়োগন।
ব্রতের সকল কিছু করিবে আয়োজন।।
আসন পাতি তাহে লক্ষ্মী মূর্তি বসাইবে।
আম্র পল্লব, গোটা ফলে ঘট সাজিবে।।
বিবিধ পুস্প, বিল্বপত্র নৈবদ্য সকল।
দিবে কলা, শর্করা আতপ তণ্ডুল।।
একটি করে মুদ্রা রাখিবে লক্ষ্মী ঘটে।
একমুষ্টি তণ্ডুল জমাইবে লক্ষ্মী ভাঁড়ে।।
আম্র পল্লবে করিবে সিঁদুর তৈলে গোলা।
চাল বাটি লক্ষ্মী সম্মুখে দিবে আলিপনা।।
ধূপ দীপ জালি সম্মুখে রাখিবে।
আসন পাতি লক্ষ্মী পূজায় বসিবে।।
একমনে পূজা দিবে লক্ষ্মী নারায়ন।
পূজাশেষে ব্রত কথা করিবে পাঠন।।
না করিয়ো পূজায় ঘণ্টা বাদন।
পূজান্তে উলু দিবে মিলি এঁয়োগন।।
এই ভাবে যেই জন লক্ষ্মী ব্রত করে।
কোন দুঃখ তার আর নাহি রহিবে।।
শুনিয়া বৃদ্ধা কহিল আনন্দিত মনে।
কে মা তুমি কহো পরিচয় দানে।।
এই শুনি লক্ষ্মী দেবী স্ব মূর্তি ধরে।
ভক্তি চিত্তে বৃদ্ধা কাঁদে ভূমি ওপর পড়ে।।
লক্ষ্মী বলে যাহ তুমি নিজের ভবন।
গুরুবারে আমাকে পূজিবে নিয়ম মতোন।।
এত বলি বিদায় লইল সাগর
নন্দিনী ( মা লক্ষ্মী সাগর রাজার কন্যা )।
ঘরে ফিরি আসিল ধনেশ্বর পত্নী।।
বধূ গনে কহিল লক্ষ্মীর ব্রতের কথন।
গুরুবারে লক্ষ্মী ভজে সপ্ত বধূ গণ।।
ধীরে ধীরে হইল সুখের ভবন।
যেমন আছিল ঘর পূর্বের মতোন।।
সপ্ত ভাই মিলে মিশে কলহ বিসর্জন।
সংসার হইলো যেন স্বর্গের দেবভবন।।
এই দেখি এক রমণী পূজা মানত করে।
স্বামী চিররোগী, উপার্জন হীন সংসারে।।
ভক্তি ভরে সেই নারী লক্ষ্মী দেবী ভজে।
হরিপ্রিয়ার কৃপায় তাহার দুঃখ সকল ঘোচে।।
রোগ ছাড়ি তার স্বামী সুস্থ হইল।
এই ভাবে সকল দুঃখ তার ঘুচিল।।
আনন্দে দিনে জন্মিল তাঁহাদের সুন্দর নন্দন।
লক্ষ্মীর কৃপায় তার বাড়িল ধন জন।।
এই ভাবে লক্ষ্মী ব্রত ছড়ায় দেশ দেশান্তরে।
সকলে শুনি লক্ষ্মী দেবীর পূজা করে।।
লক্ষ্মী কৃপায় সকলের দুঃখ চলি যায়।
কমলার কৃপা সকলের ওপর বর্ষায়।।
একদিন লক্ষ্মী পূজা করে বামাগন।
আসিল এক বনিক তাঁহাদের সদন।।
বনিক কহে কোন দেবী কি পরিচয়।
করিলে পূজা দেবীর, কি ফল হয়।।
বামারা বলে ইনি লক্ষ্মী দেবী জগত জননী।
লক্ষ্মী কৃপায় সুখে রহে ব্রতিনী।।
গুরুবারে যে জন লক্ষ্মী পূজা করে।
অবশ্যই থাকিবে সুখে কমলার বরে।।
এই বাক্য শুনে হাসে বনিক মহাশয়।
মানিনা এই সত্য তব কথায়।।
কপালে যদি না থাকে ধনের লিখন।
কিরূপে দিবে লক্ষ্মী বর- ধন- জন।।
শুধু শুধু লক্ষ্মী পূজা করি কি হয়।
বৃথা কাটাইতেছো কমলা পূজায়।।
গর্বে ভরা বাক্য লক্ষ্মী সইতে নারে।
ধীরে ধীরে মা কমলা ছাড়িল তাহারে।।
ঝড় উঠি তার নৌকা জলে ডোবে।
ধন জন আদি গেলো নানা রোগে ভোগে।।
মড়কে রোগে তার গৃহ হইল ছারখার।
ভিখারী হইয়া বনিক ঘোরে দ্বারে দ্বার।।
এককালে সে থাকিত রাজার হালে।
আজ সে ভিখারী, পথে কষ্টে চলে।।
এই ভাবে বহু দেশ ঘোরে সদাগর।
একদিন আইলো সে অবন্তী নগর।।
সেই স্থানে ব্রত করে যতেক বামাগনে।
বসি তারা মন দেয় লক্ষ্মীর ভজনে।।
এই দেখি পূর্ব কথা হইলো স্মরণ।
এই স্থানে দেবীরে করিছে অবমানন।।
সেই পাপে সব ধ্বংস হইলো তার।
ভূমিতে লোটাইয়ে সদাগর কান্দে বারবার।।
এই স্থানে করেছি মাগো বহু অহঙ্কার।
সেই পাপে সব কিছু হইলো ছারখার।।
ধন গর্বে মত্ত হয়ে করিনু অবহেলা।
সেই অপরাধে মা তুমি মোরে ত্যাজিলা।।
ক্ষুধার জ্বালায় মাগো ঘুরি দেশ দেশান্তরে।
ধন- জন- আত্মীয় গেলা আমাকে ছেড়ে।।
তুমি মাতা দয়াময়ী বিষ্ণু বক্ষ বিলাসিনী।
তুমি মাতা ভগবতী জগত পালিনী।।
তুমি যারে রক্ষা করো কিসের তার ভয়।
তুমি যারে ত্যাজি যাও, সে সব হারায়।।
তুমি যারে কৃপা কর, সেই ধন্য হয়।
তোমার আশিসে মাগো সর্ব সিদ্ধি হয়।।
এই ভাবে সদাগর লক্ষ্মী স্তব করে।
কমলার কৃপা দৃষ্টি বনিকের উপর পড়ে।।
লক্ষ্মীর কৃপায় বনিক সব ফিরি পায়।
গৃহে ফিরি মন দেয় লক্ষ্মীর পূজায়।।
লক্ষ্মীর কৃপায় তাহার ধন জন বাড়ে।
এই ভাবে ব্রত প্রচার হয় দেশ দেশান্তরে।
এই ভাবে সকলে লক্ষ্মী পূজা করে।
ধনে জনে বাড়িল কমলার বরে।।
খাদ্য ধন জন বাড়িল লক্ষ্মীর কৃপায়।
হরি হরি বল তুলিয়া হস্ত দ্বয়।।
যেই জন ভক্তি ভরি লক্ষ্মী পূজিবে।
অবশ্যই তাহার দুঃখ সকল ঘুচিবে।।
যে পড়ে ব্রত কথা, আর যেবা করে শ্রবন।
অবশ্যই পাইবে সে মা লক্ষ্মীর চরণ।।
ব্রত কথা শুনিবে অবশ্যই ভক্তি মনে।
লক্ষ্মীর কৃপায় বাড়িবে ধনে জনে।।
জয় জয় ব্রহ্মময়ী, মা নারায়নী।
তোমার কৃপায় শেষ করিনু গ্রন্থ খানি।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!