বাসে ওঠে প্রায় মাঝামাঝি জানালার পাশের একটা সীটে বসে পড়লাম। বাইরে বৃষ্টি। মোটামুটি ভিজে গেছি। অল্পসময়ের মধ্যেই বাসে যাত্রী ভরে গেল। বৃহস্পতিবার রাত তাই যাত্রী বেশি, পাশের যাত্রীর কাছে জানা গেল। বাসের নাম ‘আরাম’ তবে বসে কিছুতেই আরাম পাচ্ছি না। যাত্রী উঠছে তো উঠছেই। যাত্রীদের চিৎকার চেচামিচি ক্রমাগত বাড়ছে। যাচ্ছি বিক্রমপুরের বাঘ্রা গ্রামে। সারারাত লালন গান হবে এ কথা শুনে একাই রওয়ানা হয়েছি। ওখানে অবশ্য আমাদের এক বন্ধু আছে। ওর নাম রাজীব। তবে বেশি বোঝে বলে আমরা ওকে বলি রাজীব কাকা। রাজীব কাকাকে নির্ভর করে যতবার বিক্রমপুরে গেছি ততবারই হয়েছে তীক্ত অভিজ্ঞতা। তারপরও কেন যেন ও ডাকলে না করতে পারি না। প্রতিবার অবশ্য আমার সঙ্গে কেউ না কেউ থাকে। কিন্তু আজ আমার সফরসঙ্গী আমি নিজেই। মানে একা একা যাচ্ছি।
এই বৃষ্টির মধ্যে গান হবে কিনা তাতেও সন্দেহ লাগছে। অবশ্য রাজীব কাকা সত্য কথা বলেছে নাকি সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। এমনো হয়েছে আমাদের খবর দিয়ে রাজীব বিক্রমপুরে নিয়ে গেছে। যেয়ে দেখি রাজীব কাকা নাকি ঢাকায় চলে এসেছে। বিপদের একশেষ। বাসের সীটে বসে কেন যেন মনে হচ্ছে রাজীব কাকার একটা ফোন কলে বাসে উঠে বসা ঠিক হয়নি।
বাসে তিল ধারণের জায়গা নেই তবুও যাত্রী তুলছে। দম বের হয় হয় অবস্থা তাও বাস ছাড়ছে না। যদিও বাসের গায়ে লেখা আছে সিটিং সার্ভিস। কন্টেকটারের ভাষ্য ‘লাস্ট টিপ যাত্রীগুলারে কি ফালায়া যামু। হ্যারাও তো মানুষ, হ্যারা যাইব কেমনে?’ তবে তার কথায় যাত্রীদের জন্য যত আন্তরিকতা প্রকাশ পাচ্ছে তার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে সকলের মনে। সকলে এই আলোচনাই করছে। বাসের যাত্রীদের অনেকেই ড্রাইভারের বাবা-মাকে অনেক নামে নামাঙ্কিত করছে। তবু বাস জায়গা থেকে নড়ছে না। তবে বাস স্টার্ড নিয়েছে। যখন বাসে আর একটি যাত্রীও তোলার মতো জায়গা নেই তখন বাস ছাড়লো। অবশ্য কন্টেকটার তখনো ডাকছে শ্রীনগর… শ্রীনগর… বাঘ্রা বাজার… বাঘ্রা বাজার…।
ঢাকা থেকে বাঘ্রা নাকি ঘণ্টা খানেকের পথ। আগে অবশ্য আমি বাঘ্রা যাইনি। নেহাৎ লালন গান নাইলে কি আর এই বৃষ্টির রাতে বাসার নরম বিছানা ছেড়ে রাজীব কাকার ডাকে সাড়া দেই। এই বৃষ্টির মধ্যে গান হবে কিনা তাতেও সন্দেহ লাগছে। অবশ্য রাজীব কাকা সত্য কথা বলেছে নাকি সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। এমনো হয়েছে আমাদের খবর দিয়ে রাজীব বিক্রমপুরে নিয়ে গেছে। যেয়ে দেখি রাজীব কাকা নাকি ঢাকায় চলে এসেছে। বিপদের একশেষ। বাসের সীটে বসে কেন যেন মনে হচ্ছে রাজীব কাকার একটা ফোন কলে বাসে উঠে বসা ঠিক হয়নি। রাজীব কাকা আবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। রাজীব নিজে কোনোখান থেকে ফোন না করলে তাকে কি করে খুঁজে পাব তাও আগে ভাবিনি। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না বাস থেকে নেমে পড়বো কিনা। এমন সময় পেছনের দিকের এক যাত্রী বলে ওঠলো : ঐ হ্যালপার পেছনের লাইটটা বন্ধ কইরা দে। গরম লাগতাছে। ভদ্রলোকের বলা শেষ হতে না হতে বাসের পেছনের দিকের প্রায় সকলেই চিৎকার করতে লাগলো। লাইট বন্ধ র্ক। ঐ ব্যাটা লাইট বন্ধ র্ক। কিন্তু হ্যালপারের এ দিকে কান নেই। সে ড্রাইভারের পাশে বসে সিগারেট টানছে। বাস ছুটছে সাই সাই করে।
চিৎকার চেচামিচি শেষ। সকলে ঘুমের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মনে হলো। কিন্তু কে জানতো হেলপারের পরের কথায় উত্তেজিত যাত্রীদের বাকি পথটার ঘুমটুকু কেড়ে নেবে? আমার পাশের সীটের ভদ্রলোক মাত্র মোবাইল ফোনের হেডফোন কানে দিয়েছে সম্ভবত গান-টান শুনবেন।
শুনেছিলাম বিক্রামপুইরা পোলা আশি টাকা তোলা। আজ তাই দেখছি। আশি টাকা তোলার পুত্ররা এক লাইট বন্ধ করা নিয়ে এখন মহাব্যস্ত। শুধু পেছনের দিকের যাত্রীরাই নয় ধীরে ধীরে পুরো বাসের যাত্রীরাই লাইট বন্ধের পক্ষে মত দিতে লাগলো। কিন্তু হ্যালপার-ড্রাইভার কেউ তাদের কথায় কান দিচ্ছে না। আমি ছাড়া প্রায় সকলেই চিৎকার করছে। সম্ভবত বাসের মধ্যে আমিই একমাত্র বহিরাগত যিনি বৃষ্টির রাতে গান শুনতে যাচ্ছেন বাঘ্রা গ্রামে। লাইট বন্ধ হচ্ছে না দেখে অনেকে এতই উত্তেজিত যে পারলে ড্রাইভারকে মারতে যায়। এরমধ্যে এক বৃদ্ধ হ্যালপারের চৌদ্দগোষ্ঠি নিয়ে যেই না গালাগালি শুরু করলো। বাসের প্রায় সকল বয়সের ভদ্রলোক(!)রা তার সঙ্গে একাত্বতা ঘোষণা করে শুরু করলো গালাগালি। এমনিতেই রাজীব রাজীর কাকার সঙ্গে পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা মনে আসলেই আৎকে উঠছি। যেয়ে হয়তো দেখবো লালন সংগীত তো দূরের কথা গ্রামের কেউ লালনের নামও জানে না। নয়তো দেখবো রাজীব কাকা ঢাকায় চলে এসেছে। মধ্যরাতে এরকম বিপদে পরলে কি করব তাই ভাববার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যাত্রীদের চেঁচামিচিতে কোন দিকেই স্থির হতে পারছি না। হঠাৎ আমার পাশের সীটের যাত্রী আমাকে আঙ্গিুলের খোঁচা দিয়ে বললো। ভাই আপনে কিছু বলতাছেন না কেন? লাইটটাটো আমাদের সীটের পাশে। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে চেমসে একটা হাসি দিলাম। তাড়াহুড়ো করে আসতে যেয়ে রাতের খাবার খাওয়া হয়নি। এখন রাত এগারোটা ছাড়িয়েছে। এমনিতেই পেটের ভেতর চো চো করছে। তার উপর নাকি আমাকেও সকলের সঙ্গে গালাগালিতে অংশ নিতে হবে! ভদ্রলোকের কথায় উপরে তাকিয়ে দেখলাম আসলেই আমার মাথার উপরেই টিম টিম করে জ্বলছে গোবেচারা লাইট। এর ক্ষীণ আলো বাসের যাত্রীদের কি এমন ক্ষতি করতে পারে বুঝে উঠতে পারছি না কিছুতেই। দেখলাম সামনের সীটের যাত্রী আরেক জনকে বলছে তার কথা না শোনায় কিভাবে সে একবার বাস ড্রাইভারকে মেরেছিল। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরাও একই গল্প করছে। আর কেউ কেউ অনরগল ড্রাইভার-হেলপারকে গালাগালি করছে। যাত্রীদের ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখতে পেলাম হেলপার জানালা দিয়ে সিগারেটের ফিল্টার ফেলে উঠে দাঁড়ালো। এতোক্ষণে অবশ্য পঁচিশ-ত্রিশ মিনিট চলে গেছে। বাস প্রায় অর্ধেক রাস্তায় চলে এসেছে। হেলপারকে দাঁড়াতে দেখে যাত্রীরা দ্বিগুণ উৎসাহে গালাগালি করতে লাগলো। হেলপার বেশ উচ্চ স্বরে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো ‘ওস্তাদ দেন লাইটটা বন্ধ কইরা’। ড্রাইভার লাইট বন্ধ করে দিল।
সব যাত্রী স্বস্তীর নিঃশ্বাস ছাড়লো। মুহুর্তে গালাগালি চিৎকার চেচামিচি শেষ। সকলে ঘুমের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মনে হলো। কিন্তু কে জানতো হেলপারের পরের কথায় উত্তেজিত যাত্রীদের বাকি পথটার ঘুমটুকু কেড়ে নেবে? আমার পাশের সীটের ভদ্রলোক মাত্র মোবাইল ফোনের হেডফোন কানে দিয়েছে সম্ভবত গান-টান শুনবেন। এমন সময় হেলপার বলে উঠলোÑ “মানুষ নিজের ভালা না বুঝলে আমরা কি করুম। বাসের পিছের হেডলাইট নাই, হ্যার লাইগা বাসের লাইট জ্বালায়া রাখছিলাম। অহন ট্র্যাক দিবোনে পিছে লাগাইয়া তখন বুজবো।” হেলপারের বলা শেষ… তৎক্ষণাত যাত্রীদের যেন হুস এলো। পেছন থেকে কেউ চিৎকার করে উঠলো। ব্যাটা লাইট জ্বালা। আর কি সকলে জুটে গেল তার সঙ্গে। বাসের পেছনের লাইট নষ্ট বাসের মাঝখানের লাইটই যাত্রীদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। জীবন-মৃত্যু বলে কথা। যাত্রীরা চিৎকার শুরু করে দিল ঐ …পুত লাইট জ্বালা। লাইট জ্বালা কইতাছি। নাইলে কিন্তু ভালা হইব না।
কে শোনে কার কথা, বাস এগিয়ে চলছে। আমার পাশের সীটের ভদ্রলোক হেডফোন খুলে ফেলেছে। সীটে বসে থাকা প্রায় সকল যাত্রীই দাঁড়িয়ে পরেছে। সকলের এক কথা লাইট জ্বালা হারামজাদা নইলে…
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো দলে যাব? নাকি এভাবে বসে থাকবো। বকাবকির মাত্রা বাড়ছে। এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলে।
হ্যালো।
হ্যালো কাকা আমি রাজীব (রাজীব অবশ্য আমাকেও কাকা বলে)।
হ্যা রাজীব বলো।
কাকা তুমি কই?
আমি বাসে।
কত পর্যন্ত আসছো।
শ্রীনগর পার হয়েছি।
শোন বাঘ্রা বাজার পর্যন্ত যাইও না মাজারের সামনে নামবা।
কোন মাজার? হ্যালো হ্যালো…
চিৎকার চেচামিচিতে ভালো ভাবে কিছুই শুনছিলাম না। তার উপর কথা শেষ হতে না হতেই রাজীব লাইন কেটে দিল। মোবাইলে তাকিয়ে দেখলাম ৫৯ সেকেন্ড। রাজীব কাকা খুবই হিসাবি। এক মিনিটের বেশি সে কথা বলে না। আবার এক মিনিটের আগে কথা শেষ হয়ে গেলেও কাটে না একেবারে ৫৭, ৫৮ বা ৫৯ সেকেন্ডই সে ফোন কেটে দেয়। কি করে যে এটা করে সেই রহস্য আমরা আজো ভেদ করতে পারিনি।
হঠাৎ বাসের চিৎকার হট্টোগোলে রূপ নিলো পেছনের এক অতি উৎসাহী যাত্রী সবাইকে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে ড্রাইভারকে মারতে। সকলে তাকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম ভাই এখানে মাজারটা কোথায়?
-বাজানের মাজার?
-মনে হয়।
আমার পাশ দিয়ে বাস সামনের দিকে এগিয়ে চললো। তাকিয়ে দেখলাম বাসের পেছনের দু পাশেই তীর্ব্র আলোতে হেড লাইট দুটি জ্বলছে। আমি অনেকটা স্বশব্দে হেসে উঠলাম। অন্ধকার গলে শাল মুড়ি দিয়ে রাজীব কাকা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
আর দুই-এক মিনিটের পথ যান যান গেটের সামনে যান। আমি সেই উৎসাহী ভদ্রলোকের পেছন পেছন রওনা দিলাম। দু একজন মোবাইলের টর্চ জ্বেলে আমাদের পথ করে দিচ্ছে। সকলেই ভবছে আমিও হয়তো ড্রাইভারকে মারতে যাচ্ছি। তাই সরে সরে জায়গা করে দিচ্ছে। গেটের কাছাকাছি আসার পর ড্রাইভারকে মাইর দেয়ার পরিকল্পনা সম্ভবত উৎসাহী ভদ্রলোক পরিবর্তন করেছে। সে অনেকটা নরম স্বরে ড্রাইভারকে বোঝাতে লাগলো। সম্ভবত বিশাল দেহী ড্রাইভারকে দেখে তার অতি উৎসাহ চুপসে গেছে। এমন সময় কন্টেকটার বলে উঠলো ‘মাজার… মাজার… মাজার… নামার যাত্রী থাকলে নামেন’। আমি ফাঁক গোলে নেমে এলাম। তখনো বাস শুদ্ধ লোক লাইট জ্বালানার জন্য চিৎকার করেই যাচ্ছে।
গা ছমছম পরিবেশে ফোটা ফোটা বৃষ্টি মধ্যে বাস থেকে কেবল আমিই নেমে এলাম। বাস গতি কমিয়ে আমাকে নামিয়ে আবার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার পাশ দিয়ে বাস সামনের দিকে এগিয়ে চললো। তাকিয়ে দেখলাম বাসের পেছনের দু পাশেই তীর্ব্র আলোতে হেড লাইট দুটি জ্বলছে। আমি অনেকটা স্বশব্দে হেসে উঠলাম। অন্ধকার গলে শাল মুড়ি দিয়ে রাজীব কাকা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কি কাকা পাগলের আখড়ায় আইসাই কি পাগল হইলা? একা একা হাসতাসো কেন? রাজীবের উপস্থিতি বা তার কথা আমাকে ততটা নড়া দিতে পারছে না। যতটা বাস যাত্রীদের কানে হাত না দিয়ে চিলের পেছনে ছোটার কথা মনে পরছিল।
সেই রাতে অবশ্য আরো অনেক কাহিনী ঘটেছে। রাজীব কাকা যে গল্পে আছে তাতে কাহিনী, রোমাঞ্চ, রম্য থাকবে এটা খুবই স্বাভাবিক। সময় পেলে সে গল্প আরেক দিন বলা যাবে। আজ এ পর্যন্তই থাক।