-স্বামী জয়ানন্দ
ধম্মং শরণং গচ্ছামি-
আমি ধর্মের শরণ নিলাম।
সংঘং শরণং গচ্ছামি-
আমি সংঘের শরণ নিলাম।
একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে ভগবান্ বুদ্ধদেব তাঁহার পাঁচজন শিষ্যকে লইয়া ঋষিপত্তনের অদূরবর্তী এক হ্রদের তীরে গমন করিলেন। হ্রদের একপার্শ্বে উচ্চ-ঢিবি রহিয়াছে। ঐ ঢিবির নিম্নদেশ হইতে সোপান বাহিয়া জলাশয়ে নামিতে হয়।
দীক্ষার্থী শিষ্যরা জলান্তে উপস্থিত হইলে বুদ্ধ কহিলেন- ‘বৎসগণ! তোমাদের আজিকার স্নান প্রতিদিনের স্নানের ন্যায় একান্ত সামান্য নহে, আজ তোমাদের কেবলমাত্র দেহের মলিনতা ধুইয়া ফেলিলে চলিবে না, আজ তোমাদের দেহের ও মনের সর্ব্বপ্রকার মলিনতা ধুইয়া-মুছিয়া অন্তরে বাহিরে পবিত্র হইতে হইবে।’
স্নান শেষ করিয়া শিষ্যেরা তীরে আসিলেন। বুদ্ধদেব জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘বৎসগণ! তোমাদের অন্তর ও বাহির পবিত্র হইল কি?’
শিষ্যেরা উত্তর করিলেন, ‘হাঁ!’
তখন তিনি মধুরকণ্ঠে গম্ভীরভাবে বলিতে লাগিলেন- ‘বৎসগণ! সাধারণতঃ তিন শ্রেণীর শিষ্য দেখা যায়। এক শ্রেণীর শিষ্যদিগকে অধোমুখ কুম্ভের সহিত তুলনা করা যায়। অধোমুখ কুম্ভ জলে নিমগ্ন হইয়াও ভরিয়া উঠে না, ইহাদের মনও তেমনি গুরুর উপদেশের প্রতি বিমুখ বলিয়া কস্মিন্ কালেও তাঁহার উপদেশামৃতে পূর্ণ হইয়া উঠে না। ইহারা যুগের পর যুগ গুরুর সহিত বাস করিয়াও কোন সুফল প্রত্যাশা করিতে পারে না। তোমরা কি এই শ্রেণীর শিষ্য হইতে চাও?’
শিষ্যেরা উত্তর করিলেন- ‘না’।
বুদ্ধ বলিতে লাগিলেন, ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর শিষ্যদিগকে উৎসঙ্গবদর নাম দেওয়া যাইতে পারে। আঁচল ভরিয়া কুল গ্রহণ করিয়া যদি কোন ব্যক্তি সেগুলিকে না বাধিয়া দণ্ডায়মান হয়, তাহা হইলে তাহার ক্রোড়স্থিত আঁচলের সমস্ত কুল ভূতলে পড়িয়া যায়।
তদ্রূপ এক শ্রেণীর শিষ্যেরা গুরুগৃহে অবস্থান সময়ে গুরুর নানা গুণ বাহ্যতঃ লাভ করিয়া থাকে। তখন তাহাদের বাক্যে কার্য্যে ও ব্যবহারে সুজনতা প্রকাশ পাইয়া থাকে, কিন্তু গুরুর বিবিধগুণ ও উপদেশ শ্রদ্ধাপূর্ব্বক হৃদয়ে বাধিয়া রাখিবার জন্য তাহাদের কোন চেষ্টা থাকে না বলিয়া, যখন গুরুর সঙ্গ হইতে তাহারা দূরে চলিয়া যায়, তখন তাহারা সেই ক্ষণস্থায়ী গুণগুলি উৎসঙ্গস্থিত বদরের ন্যায় হারাইয়া ফেলে। তাহাদের প্রকৃতি তখন আমূল পরিবর্তিত হইয়া থাকে। বৎসগণ! তোমরা কি এই শ্রেণীর শিষ্য হইতে ইচ্ছা কর?’
উত্তর হইল না।
বুদ্ধ ধীরকণ্ঠে আবার কহিলেন- ‘সৌম্যগণ, তৃতীয় প্রকারের শিষ্যদিগকে উৰ্দ্ধমুখ কুম্ভের সহিত তুলনা করা হইয়া থাকে। উর্দ্ধমুখ কুম্ভ যেমন সহজেই সলিলের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কানায়-কানায় পূর্ণ হইয়া থাকে, এই-জাতীয় শিষ্যদের চিত্তও তেমনি অবাধে গুরুর উপদেশামৃতের মধ্যে নিমগ্ন হইয়া অমৃতরসে ভরিয়া উঠে। পূর্ণকুম্ভের বারি যেমন তৃষিত তাপিতের পিপাসা ও তাপ দূর করে, এই শ্রেণীর শিষ্যদের হৃৎকুম্ভস্থিত অমৃতরসও তেমনি শত শত পাপতাপ-জর্জ্জরিত নরনারীর পাপ তাপ দূর করিয়া থাকে। তোমরা কি এই-জাতীয় শিষ্য হইতে ইচ্ছা কর?
শিষ্যেরা বিনীতভাবে দৃঢ়কণ্ঠে কহিলেন- ‘হাঁ’।
রাত্রির স্নিগ্ধতা ও স্তব্ধতা সূত্র প্রসারিত হইল। গুরুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ শিষ্যেরা জলান্ত হইতে উচ্চ ভূমির উপরিভাগে আরোহণ করিলেন। শ্রদ্ধা নম্র শিষ্যেরা তাঁহাদের হৃদয়পাত্রের মুখ উন্মোচন করিয়া নিঃশব্দে গুরুর সম্মুখে ধারণ করিলেন। তিনি তাঁহার সত্যধৰ্ম্মের রসধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন।
শিষ্যেরা হৃদয় দিয়া বুঝিলেন যে, এই সত্যধর্মের আদিতে কল্যাণ, অন্তে কল্যাণ। গুরুর উপদেশে তাঁহাদের চিত্তের সমস্ত সংশয় দূর হইবামাত্র তাঁহারা-
১. জগতে দুঃখের অস্তিত্ব।
২. দুঃখের উৎপত্তির কারণ।
৩. দুঃখ-অতিক্রমের পন্থা এবং
৪. দুঃখ-নিবৃত্তির উপায়।
এই চতুরার্য্য সত্যের সুস্পষ্ট উপলব্ধি করিলেন; অর্থাৎ তাঁহারা বুঝিলেন, জগতে সুখ দুঃখ আছে ইহা সত্য, দুঃখ-উদ্ভবের কারণ রহিয়াছে ইহা সত্য, দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করা যায় ইহা সত্য এবং দুঃখ দূর করিবার উপায় আছে, ইহাও সত্য।
এই দুঃখ দূর করিবার জন্য-
১. সম্যক্-দৃষ্টি।
২. সম্যক্-সঙ্কল্প।
৩. সম্যক্-বাক্।
৪. সম্যক্-কর্মন্ত।
৫. সম্যগাজীব।
৬. সম্যক্-ব্যায়াম।
৭. সম্যক্-স্মৃতি।
৮. সম্যক্-সমাধি, আষ্টাঙ্গিক সাধনা আবশ্যক।
শিষ্যেরা বুঝিলেন দুঃখের নির্ব্বাণ করিয়া পরমানন্দ পরমশান্তি লাভ করিতে হইলে যে সাধনা গ্রহণ করিতে হয়, তাহা প্রাণহীন বাহ্য অনুষ্ঠান নহে, সেই সাধনা গ্রহণ করিতে হইলে, সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিতে হইলে, দৃষ্টি, সঙ্কল্প, বাক্য, কম্ম, জীবিকা, ব্যায়াম, স্মৃতি, ধ্যান পবিত্র করিতে হইবে।