ভবঘুরেকথা
স্বামী পরমানন্দ

ধর্মের শিক্ষা মানবকে বিনয়ী করে। ধর্মের জ্ঞান মানবকে মহান করে। মানবের এই জ্ঞানকে জীবনে যোজনা করতে হবে। এই জানা যদি জীবনে না যুক্ত হয়, তাহলে সমস্তই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু যদি এটা জীবনে যোজনা বা অনুশীলন করা যায়, তাহলেই এর সার্থকতা।

যে কোন অনুভূতি যোজনা বা অনুশীলন সাপেক্ষ অর্থাৎ সব কিছুই যোজনা বা অনুশীলনের অপেক্ষা রাখে। সেইহেতু এই জানাকে জীবনে যোজনা করাই মানব জীবনের সাধনা। সত্যাশ্রয়ী, নিষ্কপট, সহজ মানবই একমাত্র জানাকে জীবনে যোজনা করতে পারেন। আর যিনি যোজনা করতে পারেন, তিনিই কেবল এই পরম উপলব্ধি লাভ করতে পারেন।

উপরোক্ত আলোচনায় আমরা নিশ্চিত হলাম যে, অনুভূতিই ধর্মের প্রাণ—অনুভূতি বিহীন ধর্ম নিষ্ফল। মুসলমান হলে যদি খোদার অনুভূতি হয়, খ্রীষ্টান হলে যদি গড্‌ (God) এর অনুভূতি হয়, হিন্দু হলে যদি পরমেশ্বরের অনুভূতি হয় কিংবা বৌদ্ধ হলে যদি পরম নির্বাণ লাভ হয়, তাহলে আমি তা-ই হতে রাজি। আমি তো ঐ পরম সত্যস্বরূপ পরমেশ্বরের অনুভূতির কাঙ্গাল।

বাদ বা মতবাদ নিয়ে আমার বিরোধ করার অবকাশ কোথায়! আমি বাদ-বিতণ্ডার কবলে পড়তে চাই না, আমি চাই সেই পরমতত্ত্বের উপলব্ধি। যেখানে সমস্ত বাদের পরিসমাপ্তি হয়—যেখানে পরম বোধের উপলব্ধি হয়—আমি সেখানে যেতে চাই।

তাই আমি করজোড়ে প্রার্থনা করি- ‘হে পরমেশ্বর! আমাকে তুমি এমন স্থানে নিয়ে চল-যেখানে সাম্প্রদায়িক চেতনা, গোষ্ঠীচেতনা এবং মতবাদ নিয়ে কোন বিরোধ নেই এবং বাদ-বিবাদ ও স্বার্থবুদ্ধির কোন স্থান নেই। হে পরমেশ্বর, সেখানে শুধু তোমার উপলব্ধি বিদ্যমান এবং সেখানে শুধু তুমিই বিরাজমান।

বাদ সমস্ত বিবাদের মূলে। জগতে যত রকমের দুর্ঘটনা, বিবাদ ও সংঘর্ষ-তাদের মূলে ঐ বাদ। কোন বাদকে ভিত্তি করে হয় রাষ্ট্রবিপ্লব, আবার আসে নতুন বাদ। বাদের বিরুদ্ধে হয় সংঘর্ষ-বিনষ্ট হয় বাদ, আবার নতুন কোন বাদের অভ্যুদয় ঘটে।

এইভাবে বাদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ সংঘটিত হয়, কারণ মানব হীন স্বার্থবুদ্ধিতে বাদগ্রস্ত বা আচ্ছন্ন। যতদিন না মানব স্বার্থবদ্ধি ত্যাগ করে সহজ হচ্ছে, ততদিন মানবের বাদগ্রস্ততার পরিসমাপ্তি হবে না। এইজন্য মানবকে সর্বপ্রথম সহজ হতে হবে এবং সমস্ত বাদের ঊর্ধ্বে পরম বোধের অনুভব করতে হবে।

প্রত্যেকটি মানবের মধ্যে রয়েছে সমুন্নত হবার ও দেবত্ব লাভের সম্ভাবনা। সুতরাং কোন মানবই হেয় বা অবজ্ঞার পাত্র নয়। মানব কখনই হীন বা তুচ্ছ নয়। মানবকে হীন বা তুচ্ছ বলে উপেক্ষা করা মোটেই সমীচীন নয়। মানব মহান, পরমাত্মার প্রকাশ।

মানব মহাপুরুষদের অনুসরণ করে মহাপুরুষদের সমকক্ষ হোক, মানবের ক্রমোন্নতির ধারা বলিষ্ঠ হোক, মানবের আত্মভাব প্রতিষ্ঠা হোক- এটাই আমার একান্ত ইচ্ছা।

মানব জাতির অনগ্রসরতার মূলে ধর্মবোধের অভাব। মানব ঋষি মহর্ষি প্রবর্তিত পথ ভুলে বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ ছেড়ে কতকগুলি নেতিবাচক, সংকীর্ণমনা সাম্প্রদায়িক নেতাকে অনুসরণ করছে, আর ধর্মের নামে অসংহতি, সংকীর্ণতা ও অসাম্যের বীজ বপন করছে।

বিকৃত দেশাচার ও সাম্প্রদায়িক বিকারগ্রস্ত ক্ষমতাপিপাসু কিছু লোক ঘৃণা ও হিংসার কালো মেঘ সৃষ্টি করে মানব জাতির ক্রমোন্নতির ধারা ও প্রগতির পথকে রুদ্ধ করছে। ধর্মের নাম দিয়ে মানবকে দানবে পরিণত করছে। তাই মানব আজও হয়ে উঠল না মাধব।

তারা ধর্মের মাস্টারমশায় সেজে সাম্যের পরিবর্তে ভেদাভেদ ও সংকীর্ণতা, প্রেমের পরিবর্তে ঘৃণা ও অবহেলা, মৈত্রীর পরিবর্তে হিংসা-দ্বেষ ও বঞ্চনা, শান্তির পরিবর্তে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে ডেকে আনছে। এর ফলে মানবগণ, ধর্মের প্রকৃত পথ ও ভাব হতে দূরে সরে গিয়ে ভণ্ডামিতে আকৃষ্ট হচ্ছে।

সমগ্র মানবসমাজ এক অবক্ষয়মুখী অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মানব বিবেককে সুপ্ত রেখে বিকৃত আচারে বা ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত। প্রশ্ন হতে পারে—ভ্রষ্টাচার কি?—বিচার বিহীন আচারই হল ভ্রষ্টাচার।

………………………………….
স্বামী পরমানন্দের ‘সহজতা ও প্রেম’ থেকে

আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে ভারতের সাধক সাধিকা: 

পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!