প্রেম অকারণ, অর্থাৎ প্রেমের কোন কারণ নেই। তাই প্রেম স্বভাবজ। যখন মানব হৃদয়ে প্রেমের বর্ষা হয়, তখনই মানব ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় এবং মানবের সম্পূর্ণতা আসে। প্রেমহীন মানব মৃতসম। এতে জীবনের লক্ষণ নেই। সেহেতু তারা অসহজ।
জীবনে প্রেমের বর্ষা নামলে ধ্যানের কিরণছটায় জ্ঞানের প্রকাশ হয়। প্রেম বা ধ্যান জীবন সাধনার পথে, আত্মউপলব্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং ভালবাসতে থাক। ভালবাসাই পথ, প্রেম-সাধনা এবং পরমেশ্বর-লক্ষ্য।
ভালবাসতে ভালবাসতে তোমার অন্তরে প্রেমের বর্ষা নেমে আসবে আর জ্ঞানের প্রকাশ ঘটবে। যারা অসহজ, তারা প্রেমিককে বলে উন্মাদ। কিন্তু প্রেম-সম্রাট। ত্যাগের মহিমায় প্রেম উজ্জ্বল। নিঃস্বার্থ প্রেমই সহজ ধর্ম। প্রেমিকের মতো মহান সম্রাট আর কে আছে!
প্রেমের প্রকাশ তখনই ঘটে, যখন আমি’র পাহাড়টা আর থাকে না। একমাত্র তখনই মানবের বাণী বদলে যায়। তখন আর ‘আমি’ ‘আমি’ নয়, শুধু ‘তুমি’ ‘তুমি’-সব তোমাতে, তুমি সবেতে। এই বিশ্বে একমাত্র তুমিই আছ। একমাত্র প্রেমেতেই মানবের অবিদ্যারূপ আমির পাহাড়টা সরে যায়।
প্রেমের প্রবাহ বইতে থাকে অন্তরে, প্রেমের সিঁড়ি বেয়ে পরমেশ্বরের উপলব্ধি হয়। মানব উন্নীত হয় অভাব হতে স্বভাবে এবং স্বভাব হতে মহাভাবে, মৃত্যু হতে জীবনে এবং জীবন হতে মহাজীবনে, খাল হতে নদীতে এবং নদী হতে সাগরে।
মানব উপনীত হয় অসহজ মানব হতে সহজ মানবে, ব্যষ্টি চেতনা হতে সমষ্টি চেতনায়, জীবত্ব হতে শিবত্বে, ভক্ত হতে ভগবানে এবং বাসনা হতে প্রেমে। পরমজ্ঞানে ও পরমপ্রেমে স্বরূপতঃ কোন ভেদ নেই। যতক্ষণ অপূর্ণতা, ততক্ষণই দ্বন্দ্ব। জীবন স্বরূপতঃ আত্মা বা ব্রহ্ম।
মায়া বা অজ্ঞান সামান্য বুদ্ধির কারণ-এটাই অসহজতা। মূলতঃ কোন কিছুতেই ভেদ নেই, ভেদ শব্দটা মিথ্যা যার প্রকৃত অস্তিত্ব নেই, ভ্রান্তি ও অসহজ অবস্থায় এর অস্তিত্ব অনুভব হয়, নতুবা কিছুই নয়।
যা দুই বা ভেদ-তাই ভ্রান্তি। মানবের অনুভূতিতে এই ভেদ কিসের জন্য? -‘আমি’-‘আমি ভাব’-এইজন্য এত ভেদ। যতক্ষণ ঐ ‘আমি-আমি ভাব’ থাকবে, ততক্ষণ ঐ ভ্রান্তি বা ভেদও থাকবে- এটাই অহংকার বা অসহজতা। এই অহংকার যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ ভগবৎ প্রেমের অনুভব নেই।
প্রকৃত প্রেম হল একাত্ম অনুভূতি। সহজ প্রেমের অনুভূতি হল- ‘আমি রূপ’ অহংকারের প্রাচীরটা লুপ্ত হয়ে যাওয়া অর্থাৎ যতক্ষণ ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যেকার অহংকাররূপ প্রাচীরটা (যা স্বার্থরূপ কংক্রীটের প্লাষ্টার করা) ভেঙে না পড়ে, ততক্ষণ প্রেমের অনুভূতি নেই। প্রেম অদ্বৈত ভূমির অনুভব-তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
ভালবাসা মানে শুধু হা-হুতাশ নয়, কিংবা কেবলমাত্র সুখের কথা বা চোখের জল ফেলা নয় অথবা কেবল মনের বৃত্তি বা মানসিক উত্তেজনাও নয়। ভালবাসার তাড়নায় মানব অপরের কষ্ট মোচনের জন্য নিজেকে ভুলে যায়। ভালবাসার তাড়না আচরণে প্রকটিত হয়। ভালবাসার তাড়নাতেই ঘর ছেড়ে পথে নেমেছেন মহামানবগণ।
আদর্শ প্রেমিক চরিত্রের উৎকর্ষ মানবকে যেরূপ মহিমান্বিত করে থাকে, দেবতারাও তার কাছে নত হন। সমগ্র প্রাণী-জগতের প্রতি অতলান্ত ভালবাসাই হল মহাপ্রেমিকের লক্ষণ। প্রেম হল অন্ধকার হতে জ্যোতিতে উত্তরণের আকূতি। প্রেমের প্রভাব সুদূর প্রসারী।
বস্তুতঃ মানব একটি ভাবসত্তা আর এই জড় দেহকে আশ্রয় করে ঐ ভাবসত্তারই অভিবিকাশ বা প্রকাশ। অখণ্ড প্রেমই হল ধর্ম। প্রেম ছাড়া মানবের আর কি ধর্ম হতে পারে! প্রেমিক ভেদবুদ্ধিরহিত। তিনি কারও প্রতি ভেদবুদ্ধি পোষণ করতে পারেন না। কারণ এই বিশ্ব অখণ্ড প্রেমের প্রকাশ। খণ্ড খণ্ড মহাবিশ্বকে অখণ্ড প্রেমই ধরে রাখছে বা ধারণ করে আছে।
বিশ্ব জুড়ে ঐ অখণ্ড প্রেম বিরাজিত আর সসীম ও সীমিত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে তার ভেতর দিয়ে সীমাহীন, অপার, অখণ্ড প্রেমের স্ফুরণ ও প্রকাশই হল তার ভাগবত্ব। এইজন্য এই বিশ্ব সংসারে অসংখ্য ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ হচ্ছে।
………………………………………..
স্বামী পরমানন্দের ‘‘সহজতা ও প্রেম’’ থেকে
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে :
পুণঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন