-শ্রী সীতারাম ওঙ্কারনাথদেব
যোগ:
আমার করুণাময় শ্রীভগবান্ শঙ্কর তাঁর কাছে নিয়ে যাবার জন্য মন্ত্রযোগ, হঠযোগ, লয়যোগ ও রাজযোগের সৃষ্টি করেছেন। মন্ত্রযোগের ধ্যেয় শ্রীভগবানের সচ্চিদানন্দঘন শ্রীবিগ্রহ, হঠযোগের ধেয় জ্যোতি, লয়যোগের ধাতব্য নাদ ও বিন্দু আর রাজযোগ সমাধি একার্থবাচক। সব পথ শেষে মিশেছে একটিতে।
মন্ত্রযোগ- ধ্যেয় মূর্ত্তি, সিদ্ধির নাম মহাভাব।
হঠযোগ- ধ্যেয় জ্যোতি, সিদ্ধির নাম মহাবোধ।
লয়যোগ- ধ্যেয় নাদবিন্দু, সিদ্ধির নাম মহালয়।
রাজযোগ- ধ্যেয় নির্গুণব্রহ্ম ওঙ্কার, সিদ্ধির নাম ব্রহ্মনির্বাণ।
মন্ত্র জপ করতে করতে সব আপনা আপনি প্রকাশ পায়। চরমজন্মে যোগত্রয়ের সাধকগণ সেই কোটিসূর্য্যসমপ্রভ, কোটিচন্দ্রসুশীতল পরমবিন্দুতে একীভূত হয়ে যান, এর নাম নির্বাণ।
সাধক-সাধিকা স্ব স্ব কর্ম্মানুসারে সালোক্য (একলোকে বাস), সারূপ্য (সমানরূপ, চতুর্ভুজাদিরূপ) লাভ করে বৈকুণ্ঠে বা গোলকে (দ্বিভুজ মূরলীধর রূপে) অবস্থান করেন। সাযুজ্য (তাঁর দেহে অবস্থান), কিন্তু প্রকৃত ভক্ত যাঁরা, তাঁরা মুক্তি চান না, ‘আসিব যাইব চরণ সেবিব, হইব প্রেম অধিকারী।’
শ্রীভগবান গৌরব করে বলেছেন-
“আমার ঐকান্তিক ভক্ত মুক্তি দিতে গেলেও নেয় না।”
জন্মজন্মান্তরের কর্ম্মফলে যে যেমন অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তার সেই পথে অত্যধিক আকর্ষণ হয়ে থাকে।
মন্ত্রযোগ:
শোন! শ্রীভগবান্ তাঁকে পাওয়ার জন্য চারটি পথ বলেছেন। সব পথ শেষে মিশেছে একটিতে। যার মধ্যে প্রথম পথ হল- মন্ত্রযোগ-ধ্যেয় মূর্ত্তি, সিদ্ধির নাম-’মহাভাব’।
মন্ত্রযোগের উপাস্য-
আকাশস্যাধিপো বিষ্ণুরগ্নেশ্চাপি মহেশ্বরী।
বায়োরগ্নিঃ ক্ষিতেরীশো জীবনস্য গণাধিপঃ।।
আকাশতত্ত্বের অধিপতি বিষ্ণু, অগ্নিতত্ত্বের মহেশ্বরী, বায়ুতত্ত্বের সূর্য্য বা অগ্নি, ক্ষিতিতত্বের শিব, জলতত্ত্বের গণেশ।
যে সাধকের যে তত্ত্বের আধিক্য আছে সেই তত্ত্বাধিষ্ঠাত্রী দেবতার মন্ত্র নিয়ে মন্ত্র জপ করতে থাকেন। মন্ত্র উচ্চারণের শব্দটিই মন্ত্রের প্রথম শরীর, নাদ জ্যোতি প্রভৃতি দ্বিতীয় শরীর, মন্ত্র চৈতন্য হলে ঐ জ্যোতি প্রভৃতি লীলা করেন। কলিযুগের লঘূপ্রায় নাম, লীলাচিন্তা, শুদ্ধ আহার ও ব্রহ্মচর্য।
নিয়মিত জপ, লীলাচিন্তা করতে করতে ক্রমে মন্ত্রলয়ের অবস্থা আসে। যেমন কারো মন্ত্র ‘রাম’। ক্রমাগত ‘রা-ম্-ম্-ম্-’ করতে করতে মন্ত্র ওঙ্কারে লয় হয়, মন্ত্র উচ্চারণের শক্তি বিলুপ্ত হয়। ক্রমে জপ পূজা পাঠ সব চলে যায়।
চণ্ডীপাঠ করবার সময় কাঁদতে কাঁদতে চণ্ডীপাঠ বন্ধ হয়ে যায়, ভক্ত ভগবৎপ্রসঙ্গে অশ্রুপূর্ণ নয়নে রোমাঞ্চিত কলেবরে প্রতিনিয়ত অবস্থান করেন, ভাবসমাধি আরম্ভ হয়, তাঁর নিজের কিছু থাকে না, অবশেষে ভগবদ্ দর্শনে সকল কর্ম্মের অবসানে মহাভাব লাভ করত ভক্ত কৃতার্থ হন।
তাঁর সেবা ছাড়া কিছু প্রার্থনা থাকে না-
ভক্তের কামনা-
‘আসিব যাইব চরণ সেবিব হইব প্রেম অধিকারী।’
তিনি ইহলোকে সেবা, নাম নিয়ে থাকেন। অন্তে দেবযান-পথে বৈকুণ্ঠে বা গোলোকে গমন করত তাঁর অভিলষিত ভগবৎ-সেবা নিয়ে অবস্থিত হন। ভক্ত মুক্তি চান না, তাঁর কাম্য প্রেমভক্তি। শ্রীভগবান্ গৌরব করে বলেছেন- ‘আমার ঐকান্তিক ভক্ত মুক্তি দিতে গেলেও নেন না।’
হঠযোগ:
শ্রীভগবানের নিকট পৌঁছানোর চারটি পথ আছে। মন্ত্রযোগ, হঠযোগ, লয়যোগ ও রাজযোগ। দ্বিতীয় হঠযোগ- ধ্যেয় জ্যোতি, সিদ্ধির নাম- মহাবোধ। পঞ্চভূতাত্মক স্থূলদেহের ক্রিয়াবিশেষের দ্বারা চিত্তের বহির্মুখী বৃত্তিগুলির নিবৃত্তিপূর্ব্বক সাধনার উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলাই হঠযোগ।
সাধক নির্বাণ চান।
আসন, মুদ্রা, বন্ধ, প্রাণায়াম তাঁদের পথ। প্রথমে ক্রিয়ার দ্বারা জ্যোতি দর্শন, পরে স্বতঃ জ্যোতি আবির্ভূত হন। সাধনকালে বিভিন্ন জ্যোতির ক্রিয়া চলতে থাকে। প্রাণায়ামাই হঠযোগী সাধকের শ্রেষ্ঠ সাধন। মূলবন্ধ, উড্ডীয়ান বন্ধ, জালন্ধর বন্ধ এই বন্ধত্রয়ের অভ্যাসে সাধক কৃতার্থ হন। এর সিদ্ধির নাম মহাবোধ।
এরই সাথে যদি রাজযোগের অভ্যাস চলে তাহলে ক্ষেত্র একাগ্র হয়। পাতঞ্জলোক্ত অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভে সাধক ধন্য হন।
লয়যোগ:
শ্রীভগবানের নিকট পৌঁছানোর চারটি পথ আছে। মন্ত্রযোগ, হঠযোগ, লয়যোগ ও রাজযোগ। তৃতীয় লয়যোগ। ধ্যেয়- বিন্দু, সিদ্ধির নাম- মহালয়। লয়যোগ বহুবিধ। শ্রীভগবান্ শঙ্করাচার্য্য বলেছেন-
নাদানুসন্ধানসমাধিমেকং
মন্যামহে মান্যতমং লয়ানাম্।।
এই লয়যোগে নাদানুসন্ধানই প্রধান। সাধক প্রথমে এই নাদ কৃত্রিম উপায়ে প্রাপ্ত হন। কালজয়ী ক্রিয়ার দ্বারাও লাভ হয়। খোলকরতালাদি বাদ্যসহ সনৃত্য নামকীর্ত্তনে সহজে নাদ পাওয়া যায়। মন্ত্রযোগের মন্ত্র জপ করতে করতেও এই নাদব্রহ্ম কৃপা করেন। লয়যোগে সিদ্ধ মহাপুরুষকে আর রাজযোগাদি করতে হয় না।
ব্রহ্মগ্রন্থি নাভিতে ধ্যেয় রক্তবর্ণ চতুর্মুখ ব্রহ্মা। সেই ব্রহ্মগ্রন্থি সাধন দ্বারা অথবা গুরুকৃপায় ভেদ হলে কুণ্ডলিনী হৃদয়ে উপস্থিত হন। দ্বিজগণের এখানে ধ্যেয় নীলোৎপলদলপ্রভ নারায়ণ। হৃদয়ে লীলাচিন্তা, স্থূলধ্যান, মূর্ত্তি প্রভৃতি ধ্যান করতে হয়। শ্রীগুরুর কৃপায় বিষ্ণুগ্রন্থি ভেদ হলে কুণ্ডলিনী দ্বিদলের নিম্নে উপস্থিত হয়ে আকাশময়ী হন।
শত শত নানাবর্ণের চিদণু নৃত্য করতে থাকেন। সূক্ষ্মতর, সূক্ষতম, নিরতিশয় সূক্ষতম বিন্দুরূপ চিদণুসকল নৃত্য করতে থাকেন। কুণ্ডলিনীশক্তি নিম্নাভিমুখী হয়ে কুণ্ডলিনীরূপ ধারণ করত মূলাধারে সার্দ্ধত্রিবলায়াকারে স্বয়ম্ভু লিঙ্গ বেষ্টন করত ব্রহ্মদ্বার রোধ করে নিদ্রা যান। গুরুকৃপায় জাগরিতা হয়ে যোগিগণের হৃদয়ে নৃত্য করেন।
জাগরণের আগে হৃদয়ে ইনিই দীপশিখারূপে অবস্থান করে থাকেন। যেমন এক প্রাণবায়ু স্থানভেদে প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যানরূপে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আকারে পৃথক পৃথক কাজ করেন, তেমনি সেই একই পরমাত্মা সহস্রারে কোটিসূর্য্য সমপ্রভ, কোটিচন্দ্র সুশীতল বিন্দুরূপে, হৃদয়ে দীপশিখার আকারে, মূলাধারে কুণ্ডলিনীরূপে লীলা করেন।
রুদ্রগ্রন্থি ভেদ হলে সেই এক পরমাত্মা আকাশরূপ ধারণ করেন। ভ্রূমধ্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চিদণুসকল আগমনী গান করতে থাকেন, গুরুগম্ভীর মেঘনাদ, কখনও সোহহং, কখনও বা ব্যোমনাদ চলে। অতি সূক্ষ্ম নাদ আকর্ষণ করে অজানা দেশে নিয়ে যান। ‘জয়গুরু’, ‘ওঁ গুরু’ নাদ ব্যক্তি বিশেষে অবিরাম লীলা করেন, আরও কত অব্যক্ত নাদ চলে, কখনও অতি সূক্ষ্ম, কখনও স্থূল। দক্ষিণ চক্ষু হতে একটি রশ্মি বহির্গত হয়ে ভিতরে বাহিরে দক্ষিণাবর্ত্তে ঘুরে ঘুরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিন্দুবৃন্দের সঙ্গে খেলা করেন।
কখনও সব থেমে যায়- সাধক যেন ঘুমিয়ে পড়েন। এখানেই কাজ শেষ হয় না। উপদেশ এই পর্যন্ত, এর পরের কথা বলতে পারি না। কেউই বলতে সমর্থ হন না। ‘বোবার গুড় খাওয়া’- এরূপ আখ্যা মহাজনগণ দেন।
তার আগে নাদ শুনতে শুনতে কোনও কোনও সাধকের মুদ্রিত চক্ষু উন্মীলিত হয়। চক্ষুর দৃষ্টি ভ্রূমধ্যে উঠতে চেষ্টা করে, তাঁর কামনা ভ্রূমধ্যে একেবারে নিশ্চল হয়ে অবস্থান করে। এইটি লয়যোগের শেষ পরিণতি, এই পর্যন্তই বলা যায়।
রাজযোগ:
শ্রীভগবানকে পাওয়ার চারটি পথ আছে। এই চারপথের সর্ব্বশেষটি হল রাজযোগ। যোগচতুষ্টয়ের মধ্যে রাজযোগ সর্বশ্রেষ্ঠ বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। রাজযোগ মনের পুনঃপুনঃ বিচার দ্বারা চিত্তনিরোধের প্রণালী মাত্র। পূর্বোক্ত যোগত্রয়ের পর সাধক এই রাজযোগের অধিকারী হতে পারেন। একে জ্ঞানযোগও বলা যায়।
মন্ত্রযোগী মহাভাব লাভ করলে, হঠযোগী মহাবোধ লাভ করে কৃতার্থ হলে এবং লয়যোগীর মন-প্রাণ পরমাত্মায় বিলীন হলে সমাধি হয়। রাজযোগের নামান্তর সমাধি।
মানুষ নিজ নিজ পূর্ব্বকর্ম্মবশে মন্ত্র, হঠ, লয়যোগ লাভে কৃতার্থ হয়। শ্রীশ্রীকরুণাময় শ্রীগুরুদেব মাত্র মন্ত্রদান করেই আমাদের তিন যোগের অধিকারী করেছেন। বাবাদের, মায়েদের মধ্যে অনেকেই নাদ, জ্যোতি, বিন্দু পেয়েছেন। চলছে কৃপার প্লাবন। তাঁর বাণী-
“কেহ না রহিবে ক্ষুণ্ণ”!
আজ এই যুগসঙ্কটে মানুষকে পরমানন্দ সাগরে নিমজ্জিত করবার জন্য ঠাকুর আমার-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
এই মন্ত্রের ভিতর দিয়ে কৃপার প্লাবন এনেছেন। নাম কর, আনন্দে থাকো।
মন্ত্রদানের সময়ে শ্রীগুরুদেব শিষ্যের অধিকৃত তাঁর দেহটি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে ‘আমি’ ‘আমার’ ভুলে গিয়ে ‘এ দাস’ ‘এ দাসের’ বলতে শেখান। সাধক-সাধিকা স্ব- স্ব প্রাক্তন কর্মফল ক্ষয় করত অগ্রসর হন। সঞ্চিত সমস্ত কর্ম্মের অবসানে অবিদ্যা অর্থাৎ ‘আমি দেহ’ এই বুদ্ধি চিরতরে দূর হয়। সাগরের বুকে তরঙ্গ উঠে সাগরেই খেলা করে আবার তাতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
তবে এসব কি?
“তত্তু লীলাকৈবল্যম্”- এসব কেবল লীলা!
(সংক্ষিপ্ত)