ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

১৩৪ নং পত্র
পৃষ্ঠা ২০৯/২১০/২১১/২১২
ওয়াশিংটন, ২৭ অক্টোবর, ১৮৯৪

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমার শুভ আশীর্বাদ জানিবে। এতদিনে তুমি নিশ্চয়ই আমার অপর পত্রখানি পাইয়াছ। আমি কখনও কখনও তোমাদিগকে কড়া চিঠি লিখি, সেজন্য কিছু মনে করিও না। তোমাদিগের সকলকে আমি কতদূর ভালবাসি, তাহা তুমি ভালরূপই জান।

তুমি অনেকবার আমি কোথায় কোথায় ঘুরিতেছি, কি করিতেছি, তাহার সমুদয় বিবরণ ও আমার বক্তৃতাগুলির সংক্ষিপ্ত আভাস জানিতে চাহিয়াছ। মোটামুটি জানিয়া রাখ, ভারতেও যাহা করিতাম, এখানে ঠিক তাহাই করিতেছি।

ভগবান যেখানে লইয়া যাইতেছেন, সেখানেই যাইতেছি- পূর্ব হইতে সঙ্কল্প করিয়া আমার কোন কার্য হয় না। আরও একটি বিষয় স্মরণ রাখিও, আমাকে অবিশ্রান্ত কার্য করিতে হয়, সুতরাং আমার চিন্তারাশি একত্র করিয়া পুস্তকাকারে গ্রথিত করিবার অবসর নাই। এত বেশী কাজ রাতদিন করিতে হইতেছে যে, আমার স্নায়ুগুলি দুর্বল হইয়া পড়িতেছে- আমি ইহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি।

ভারত হইতে যথেষ্ট কাগজপত্র আসিয়াছে, আর আবশ্যক নাই। তুমি এবং মান্দ্রাজের অন্যান্য বন্ধুগণ আমার জন্য যে নিঃস্বার্থভাবে কঠোর পরিশ্রম করিয়াছ, তাহার জন্য তোমাদের নিকট আমি যে কি কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ, তাহা বলিতে পারি না। তবে ইহা জানিয়া রাখ, তোমরা যাহা করিয়াছ, তাহার উদ্দেশ্য আমার নাম বাজান নহে; তোমাদের শক্তি সম্বন্ধে তোমাদিগকে সজাগ করাই ইহার উদ্দেশ্য। সংগঠন-কার্যে আমি পটু নই; ধ্যানধারণা ও অধ্যয়নের উপরই আমার ঝোঁক। আমার মনে হয়, যথেষ্ট কাজ করিয়াছি- এখন একটু বিশ্রাম করিতে চাই।

আমি এক্ষণে আমার গুরুদেবের নিকট হইতে যাহা পাইয়াছি, তাহাই লোককে একটু শিক্ষা দিব। তোমরা এখন জানিয়াছ, তোমরা কি করিতে পার।

মান্দ্রাজের যুবকগণ, তোমরাই প্রকৃতপক্ষে সব করিয়াছ- আমি তো নামমাত্র নেতা! আমি সংসারত্যাগী (অনাসক্ত সন্ন্যাসী); আমি কেবল একটি জিনিষ চাই।

যে ধর্ম বা যে ঈশ্বর বিধবার অশ্রুমোচন করিতে পারে না অথবা অনাথ শিশুর মুখে একমুঠো খাবার দিতে পারে না, আমি সে ধর্মে বা সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। যত উচ্চ মতবাদ হউক, যত সুবিন্যস্ত দার্শনিক তত্ত্বই উহাতে থাকুক, যতক্ষণ উহা মত বা পুস্তকেই আবদ্ধ, ততক্ষণ উহাকে আমি ‘ধর্ম’ নাম দিই না।

চক্ষু আমাদের পৃষ্ঠের দিকে নয়, সামনের দিকে- অতএব সম্মুখে অগ্রসর হও, আর যে ধর্মকে তোমরা নিজের ধর্ম বলিয়া গৌরব কর, তাহার উপদেশগুলি কার্যে পরিণত কর- ঈশ্বর তোমাদিগের সাহায্য করুন।

আমার উপর নির্ভর করিও না, নিজেদের উপর নির্ভর করিতে শেখ। আমি যে সর্বসাধারণের ভিতর একটা উৎসাহ উদ্দীপিত করিবার উপলক্ষ হইয়াছি, ইহাতে আমি নিজেকে সুখি মনে করি। এই উৎসাহের সুযোগ লইয়া অগ্রসর হও- এই উৎসাহ স্রোতে গা ঢালিয়া দাও, সব ঠিক হইয়া যাইবে।

হে বৎস, যথার্থ ভালবাসা কখনও বিফল হয় না। আজই হউক, কালই হউক, শত শত যুগ পরেই হউক, সত্যের জয় হইবেই, প্রেমের জয় হইবেই।

তোমরা কি মানুষকে ভালবাস? ঈশ্বরের অন্বেষণে কোথায় যাইতেছ? দরিদ্র, দুঃখী, দুর্বল- সকলেই কি তোমার ঈশ্বর নহে? অগ্রে তাহাদের উপাসনা কর না কেন? গঙ্গাতীরে বাস করিয়া কূপ খনন করিতেছ কেন? প্রেমের সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস কর। নামযশের ফাঁকা চাকচিক্যে কি হইবে? খবরের কাগজে কি বলে না বলে, আমি সে দিকে লক্ষ্য করি না।

তোমার হৃদয়ে প্রেম আছে তো? তবেই তুমি সর্বশক্তিমান্। তুমি সম্পূর্ণ নিষ্কাম তো? তাহাই যদি হও, তবে তোমার শক্তিকে রোধ করিতে পারে? চরিত্রবলে মানুষ সর্বত্রই জয়ী হয়।

ঈশ্বরই তাঁহার সন্তানগণকে সমুদ্রগর্ভে রক্ষা করিয়া থাকেন! তোমাদের মাতৃভূমি বীর সন্তান চাহিতেছেন- তোমরা বীর হও। ঈশ্বর তোমাদিগকে আশীর্বাদ করুন। সকলেই আমাকে ভারতে আসিতে বলিতেছে। তাহারা মনে করে, আমি গেলে তাহারা বেশী কাজ করিতে পারিবে।

বন্ধু, তাহারা ভুল বুঝিয়াছে। আজকাল যে উৎসাহ দেখা যাইতেছে, ইহা একটু স্বদেশহিতৈষণা মাত্র- ইহাতে কোন কাজ হইবে না। যদি উহা খাঁটি হয়, তবে দেখিবে অল্পকালের মধ্যেই শত শত বীর অগ্রসর হইয়া কার্যে লাগিয়া যাইবে। অতএব জানিয়া রাখ যে, তোমরাই সব করিয়াছ, ইহা জানিয়া আরও কার্য করিতে থাক, আমার দিকে তাকাইও না।

অক্ষয় এখন লণ্ডনে আছে- সে লণ্ডনে মিস মূলারের নিকট যাইবার জন্য আমাকে একখানি সুন্দর নিমন্ত্রণপত্র লিখিয়াছে। বোধ হয়, আগামী জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারী তে লণ্ডন যাইব। ভট্টাচার্য আমাকে ভারতে যাইতে লিখিতেছেন। এস্থান প্রচারের উপযুক্ত ক্ষেত্র।

বিভিন্ন মতবাদ লইয়া কি করিব? আমি ভগবানের দাস। উচ্চ উচ্চ তত্ত্ব প্রচার করিবার উপযুক্ত ক্ষেত্র এদেশ অপেক্ষা আর কোথায় পাইব? এখানে যদি একজন আমার বিরুদ্ধে থাকে তো শত শত জন আমায় সাহায্য করিতে প্রস্তুত। এখানে মানুষ মানুষের জন্য ভাবে, নিজের ভ্রাতাদের জন্য কাঁদে, আর এখানকার মেয়েরা দেবীর মত।

মূর্খদিগকেও যদি প্রশংসা করা যায়, তবে তাহারাও কার্যে অগ্রসর হয়। যদি সব দিকে সুবিধা হয়, তবে অতি কাপুরুষও বীরের ভাব ধারণ করে। কিন্তু প্রকৃত বীর নীরবে কার্য করিয়া চলিয়া যান। একজন বুদ্ধ জগতে প্রকাশিত হইবার পূর্বে কত শত বুদ্ধ নীরবে জীবন দিয়া গিয়াছেন!

প্রিয় বৎস আলাসিঙ্গা, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, মানুষকে বিশ্বাস করি; দুঃখী দরিদ্রকে সাহায্য করা, পরের সেবার জন্য নরকে যাইতে প্রস্তুত হওয়া- আমি খুব বড় কাজ বলিয়া বিশ্বাস করি।

পাশ্চাত্যগণের কথা কি বলিব, তাহারা আমাকে খাইতে দিয়াছে, পরিতে দিয়াছে, আশ্রয় দিয়াছে, তাহারা আমার সহিত পরম বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করিয়াছে- খুব গোঁড়া খ্রীষ্টান পর্যন্ত। তাহাদের একজন পাদ্রী যদি ভারতে যায়, আমাদের দেশের লোক তাহার সহিত কিরূপ ব্যবহার করে? তোমরা তাহাদিগকে স্পর্শ পর্যন্ত কর না, তাহারা যে ম্লেচ্ছ!!!

বৎস, কোন ব্যক্তি- কোন জাতিই অপরকে ঘৃণা করিলে জীবিত থাকিতে পারে না। যখনই ভারতবাসীরা ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দ আবিষ্কার করিল ও অপর জাতির সহিত সর্ববিধ সংস্রব পরিত্যাগ করিল, তখনই ভারতের অদৃষ্টে ঘোর সর্বনাশের সূত্রপাত হইল।

তোমরা ভারতের দেশবাসীদের প্রতি উক্ত ভাবপোষণ সম্বন্ধে বিশেষ সাবধান হইও। বেদান্তের কথা ফস্ ফস্ মুখে আওড়ান খুব ভাল বটে, কিন্তু উহার একটি ক্ষুদ্র উপদেশও কার্যে পরিণত করা কি কঠিন!

আমি শীঘ্রই এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, সুতরাং এখানে আর খবরের কাগজ পাঠাইবার প্রয়োজন নাই। প্রভু তোমাকে চিরদিনের জন্য আশীর্বাদ করুন।

তোমাদের চিরকল্যাণাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

পু: দুইটি জিনিষ হইতে বিশেষ সাবধান থাকিবে- ক্ষমতাপ্রিয়তা ও ঈর্ষা।
সর্বদা আত্মবিশ্বাস অভ্যাস করিতে চেষ্টা কর।
জয়তু স্বামীজী।

ভবঘুরে কথার জন্য লেখাটা সংগ্রহ করেছেন:
নূর মোহাম্মদ মিলু

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!