ভবঘুরেকথা

মহাপ্রভুর জোনাসুর কুঠী যাত্রা
দীর্ঘ ত্রিপদী

হাকিম হুকুম যাহা প্রতক্ষ্যে ফলিল তাহা
নায়েব চলিয়া গেল বাড়ী।
গৃহদাহ বার্তা এল কার্যেতে জবাব হ’ল
ভয় প্রাণ কাঁপে থরহরি।।
বিপক্ষ গ্রামীরা যত রাগে হ’ল জ্ঞান হ’ত
বলে এত জুতা মারি পিঠি।
এত দিল জরিমানা তবু কীর্তন ছাড়ে না
লাফালাফি ক’রে ভাঙ্গে মাটি।।
যত সব জাতিনাশা নাহিক অন্য ব্যবসা
কিসে চলে খায় ব’সে ব’সে।
কেহ অন্ন বস্ত্রহীন বালক যুবা প্রবীণ
কি কৌশলে সবে এসে মিশে।।
নায়েব দিল লাঞ্ছনা বিশ টাকা জরিমানা
কার্য গেল চলে গেল বাটী।
যত সব দুষ্ট খল জুটিয়া পাষণ্ড দল
শেষে যায় জোনাসুর কুঠি।।
নজর দিয়া সবাই ডিক সাহেবের ঠাই
করে এক কেতা দরখাস্ত।
সাহেবের কাছে গিয়ে একে একে দাঁড়াইয়ে
বাচনিক বলিল সমস্ত।।
পাষণ্ডী মুখ নিঃসৃত যত আ’সে কহে তত
ভাল মন্দ নাহি যে বিচার।
যতসব ভাল ক্রিয়ে সেই সকল ত্যজিয়ে
কহে যত কুৎসিত আচার।।
সাহেব শ্রবণ করে বলে তাদের গোচরে
যেই নারী কীর্তনেতে নাচে।
কীর্তনের প্রেমাবেশে যেই নারী মিশে এসে
তাহাদের কেহ কি জেনেছে।।
কহে পাষণ্ডীগণ তাহাদের আত্মজন
অই কার্য বড় ভালবাসে।
সাহেব কহিছে হারে তাহারা যে কার্য করে
মোর মনে মন্দ নাহি আসে।।
সাহেব কহিছে বল না কহিস মিথ্যা ছল
কুকার্য কি করে কোন জনে।
নাচে গায় নিরবধি তার মধ্যে কাঁদে যদি
কুপ্রবৃত্তি জন্মিবে কেমনে।।
সাহেব কহিছে আমি দেখিব কেমন আদমি
যাহ হাম পেয়াদা পাঠাই।
পাষণ্ডীরা গৃহে গেল সাহেব লোক পাঠা’ল
উপনীত দশরথ ঠাই।।
পদ্মবিলা গ্রামে বাস শ্রীরামতনু বিশ্বাস
বুদ্ধিমান অতি বিচক্ষণ।
কাছারী কুঠি মোকামে রাজদ্বারে কিংবা গ্রামে
পরগণে মানে সর্বজন।।
নায়েব যেদিন মারে রামতনু অগোচরে
গোপনেতে করে যত খল।
শেষে সকল শুনিল ক্রোধে পরিপূর্ণ হ’ল
বলে এর দিব প্রতিফল।।
মানিব না উপরোধ দিব এর প্রতিশোধ
ভিটা বাড়ী করিব উচ্ছন্ন।
ঠাকুর বারণ করে বাছাধন বলি তোরে
তুমি কিছু কর না এ জন্য।।
তাহাতে বারণ হ’ল কুঠির পেয়াদা এল
রামতনু জানিবারে পায়।
দশরথ নিকটেতে কহে গিয়ে যোড়হাতে
এতে গুরু নাহি কিছু ভয়।।
রামতনু বাল্যকালে সাধু দশরথ স্থলে
পাঠশালে লেখাপড়া শিখে।
রামতনু সেইজন্য দশরথে করে মান্য
চিরদিন গুরু বলে ডাকে।।
তিনি ক’ন পেয়াদারে কেন আ’লি মরিবারে
বল গিয়া সাহেবের কাছে।
মূলমর্ম নাহি জেনে পেয়াদা পাঠা’লে কেনে
অত্যাচারে নায়েব ম’রেছে।।
রামতনু কুঠি গিয়ে নিরপেক্ষ ভাব ল’য়ে
সত্য জানাইল সাহেবেরে।
সাহেব কহে বিশ্বাস আর নাহি অবিশ্বাস
ঠাকুরে কি দোষ কার্য করে।।
বল শুনি রামতনু আমার জীবন তনু
ঠাকুরে কেন দেখিতে চায়।
শীঘ্র গিয়া কহ তুমি ঠাকুর দেখিব আমি
আসুন আমার কামরায়।।
সাহেবে কড়ার দিয়ে রামতনু গৃহে গিয়ে
গুরুদেব নিকটেতে কয়।
দশরথ পদ ধরে জানাইল ঠাকুরেরে
সাহেবেরে দেখা দিতে হয়।।
মহাপ্রভু শুনি তাই বলে যাব তার ঠাই
করিবারে রাজ দরশন।
যে দেখিতে চায় মোরে আমিও দেখিব তারে
মন চাহে তার সম্মিলন।।
ঠাকুর করিল দিন বল গিয়া আমি দীন
কুঠি যাব তিন দীন পরে।
রামতনু এইকালে বলে দশরথ স্থলে
এবে দণ্ড দিব পাষণ্ডীরে।।
সে কথা ঠাকুর শুনে কহে দশরথ স্থানে
মানা কর তোমার শিষ্যরে।
পাষণ্ডীর কিবা ভয় যারা মম কিছু নয়
তারা মম কি করিতে পারে।।
ঠাকুর কুঠিতে যাবে দিন ধার্য করি তবে
যে স্থানে যে ভক্তগণ ছিল।
প্রধান প্রধান ভক্ত নামগানে অনুরক্ত
আসিতে সবারে আজ্ঞা দিল।।
ঠাকুর সে দিন মত লইয়া ভকত কত
দশরথ ভবনে আসিল।
প্রেমিক প্রবীণ যত নাম বা লইব কত
এসে সবে একত্রিত হ’ল।।
রাউৎখামার বাসী অনেক মিশিল আসি
রামচাঁদ হীরামন বালা।
আইল বদনচন্দ্র কুবের আদি গোবিন্দ
নারিকেল বাড়ীর পাগলা।।
লক্ষ্মীপুর বাসী ভক্ত চূড়ামণি বুদ্ধিমন্ত
আসিলেন তারা দু’টি ভাই।
এল নাটুয়া পাগল ব্রজ নাটুয়া পাগল
হরিবোল বিনে বোল নাই।।
বিশ্বনাথ দরবেশ আসিল পাগলবেশ
নেচে নেচে ধায় আগে আগে।
যতেক ভকতগণ হরিনামেতে মগন
সিংহের প্রতাপে ধায় বেগে।।
গেল দশরথ ঘর সবে হ’ল একতর
ভয়ে ভীত হ’ল দশরথ।
ঠাকুরের সাঙ্গোপাঙ্গো দেখিয়ে হ’ল আতংক
লোক হ’ল দুই তিন শত।।
দশরথ পদ ধরে বলে প্রভুর গোচরে
এত ভক্ত কৈল আগমন।
দৈবে লোক বহুজন করাতে স্নান ভোজন
মম সাধ্য না হবে কখন।।
ঠাকুর কহিছে বাছা কেন তুমি ভাব মিছা
এল যত সাধু মহাজন।
যে করে হরির চিন্তে হরি করে তার চিন্তে
খেতে দিবে যাঁহার সৃজন।।
তুমি কি করিবে ভেবে যার কার্য সে করিবে
স্নান করাইয়া সবে আন।
যাইতে হইবে কুঠি মাথায় লইব মাটি
কেশ মুক্ত বেশই প্রধান।।
বিশ্বনাথ দরবেশে বলে স্নান কর এসে
কেশ ধৌত কর ল’য়ে মাটি।
তুই ফকির মানুষ হ’য়ে দেওনা পুরুষ
চুল ছেড়ে যেতে হ’বে কুঠি।।
মহাপ্রভু স্নান ছলে যান পুষ্করিণী জলে
এ দিকেতে যত নারীগণ।
কলসী লইয়া কাঁখে কেহ জল আনে সুখে
কেহ করে মস্তক মার্জন।।
কেহ বা গাত্র মার্জন কেহ পদ প্রক্ষালন
শ্রীঅঙ্গ মোছায় কোন নারী।
যেখানে যে কার্য করে সবে হরিষ অন্তরে
দলে দলে বলে হরি হরি।।
এদিকে মেয়েরা যত সবে হ’য়ে হরষিত
এসেছেন বিশ্বাসের বাটী।
কোন কোন নারীগণে আশ্চর্য মেনেছে মনে
শুনেছে ঠাকুর যাবে কুঠি।।
শুনেছে বাটী হইতে দশরথের বাটীতে
আসিয়াছে মতুয়া সকল।
কেহ এনেছে চাউল কেহ এনেছে ডাউল
কেহ আনে দধি দুগ্ধ ঘোল।।
কুষ্মাণ্ড কদলী আদি তরকারী নানা বিধি
থোড় মোচা শাক শিম মূল।
আলু কচুক আলাবু কেহ কেহ আনে লেবু
কেহ আনে পদ্মবীজ মূল।।
ব্যঞ্জন লাবড়া পাক সরিষা বাটা শুক্ত শাক
মেয়েরা রন্ধন করে ঘরে।
দৈবে এক মেয়ে এল সেই ঘরে প্রবেশিল
কোন মেয়ে নাহি চিনে তারে।।
তণ্ডুল ঠিক দু’মন পাক হইল যখন
এমন সময় দয়াময়।
গিয়া সেই রসই ঘরে নিষেধিল মেয়েদেরে
পাক ক্ষান্ত কর এ সময়।।
এই অন্নে হ’য়ে যা’বে বসাইয়া দেহ সবে
ক্ষুধার সময় বয়ে যায়।
ঠাকুর বাহিরে এসে বলিলেন হেসে হেসে
খেতে বৈস সাধুরা সবায়।।
যত সব ভক্তগণ ক্ষান্ত করি সংকীর্তন
মহাপ্রভু নামে ভীড় দিল।
করিতে অন্ন ভোজন করি পদ্ম পত্রাসন
তারপরে সকলি বসিল।।
ঠাকুরের প্রিয় দাস দেওড়া গ্রামেতে বাস
নামেতে প্রহ্লাদচন্দ্র ঘোষ।
ল’য়ে ছয় হাঁড়ি দধি গিয়াছিল ওঢ়াকাঁদি
উপনীত হইয়া সন্তোষ।।
কহিছেন হরিচাঁদ কি ক’রেছ রে! প্রহ্লাদ
ক্ষীর কি মাখন আন নাই।
সাধু সেবা হ’বে হেথা শুনিয়াছ এই কথা
তোর দধি বড় ভাল খাই।।
ঘোষ কহে হ’য়ে নত মেয়েরা এনেছে ঘৃত
সেই ঘৃত এবে হবে ব্যয়।
এই সেবা হোক শেষ ক্ষীর মাখন পায়স
আমি দিব বৈকালী সেবায়।।
ছয় হাঁড়ি দধি ছিল দুই হাঁড়ি মথি নিল
মাখন তুলিল সে সময়।
কতকাংশ জ্বাল দিয়া সদ্য ঘৃত বানাইয়া
উঠাইয়ে রাখিল শিকায়।।
মেয়েদের দেয় দুগ্ধ জ্বালাইয়া করি স্নিগ্ধ
ক্ষীর বানাইল কতকাংশে।
দিয়া মালাবতী স্থলে বলে লহ, মা! বৈকালে
দিও ঠাকুরের সেবা রসে।।
হইল পরিবেশন যত সব সাধুগণ
প্রভু প্রতি হরিধ্বনি দিয়া।
উত্তম ভোজন করি সবে বলে হরি হরি
আচমন করিল উঠিয়া।।
যে যে দ্রব্য এনেছিল সিকি মাত্র ব্যয় হ’ল
আর সব রহিল পড়িয়া।
প্রভু ক’ন মালাদেবী তুমি পরমা বৈষ্ণবী
এই সব দ্রব্য রাখ নিয়া।।
যতনে না কর ত্রুটি আমরা যাইব কুঠি
সাধু ভক্তগণ এই সব।
সব ল’য়ে সমিভ্যরে রাত্রি এসে তব ঘরে
পুনশ্চ করিব মহোৎসব।।
সাধ্বীগণ একতরে সবে বসি এই ঘরে
চিন্তা কর মঙ্গল আমার।
ঠাকুরের কুঠি যাত্রা শেষ লীলা শুভবার্তা
কহে দীন রায় সরকার।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!