১৮৮৫, ৩১শে অক্টোবর
শ্রীরামকৃষ্ণ ও Jesus Christ – তাঁহাতে খ্রীষ্টের আবির্ভাব
ঠাকুর ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা এগারটা। মিশ্র নামক একটি খ্রীষ্টান ভক্তের সহিত কথা কহিতেছেন। মিশ্রের বয়ঃক্রম ৩৫ বৎসর হইবে। মিশ্র খ্রীষ্টানবংশে জন্মিয়াছেন। যদিও সাহেবের পোশাক, ভিতরে গেরুয়া আছে। এখন সংসারত্যাগ করিয়াছেন। ইঁহার জন্মস্থান পশ্চিমাঞ্চলে। একটি ভ্রাতার বিবাহের দিনে তাঁহার এবং আর একটি ভ্রাতার একদিনে মৃত্যু হয়। সেই দিন হইতে মিশ্র সংসারত্যাগ করিয়াছেন। তিনি কোয়েকার্ সম্প্রদায়ভুক্ত।
মিশ্র – ‘ওহি রাম ঘট্ ঘটমে লেটা।’
শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট নরেনকে আস্তে আস্তে বলিতেছেন – যাহাতে মিশ্রও শুনিতে পান – ‘এক রাম তাঁর হাজার নাম।’
“খ্রীষ্টানরা যাঁকে God বলে, হিন্দুরা তাঁকেই রাম, কৃষ্ণ, ঈশ্বর – এই সব বলে। পুকুরে অনেকগুলি ঘাট। একঘাটে হিন্দুরা জল খাচ্ছে, বলছে জল; ঈশ্বর। খ্রীষ্টানেরা আর-একঘাটে খাচ্ছে, – বলছে, ওয়াটার; গড্ যীশু। মুসলমানেরা আর-একঘাটে খাচ্ছে – বলছে, পানি; আল্লা।”
মিশ্র – মেরির ছেলে Jesus নয়। Jesus স্বয়ং ঈশ্বর।
(ভক্তদের প্রতি) – “ইনি (শ্রীরামকৃষ্ণ) এখন এই আছেন – আবার এক সময়ে সাক্ষাৎ ঈশ্বর।
“আপনারা (ভক্তেরা) এঁকে চিনতে পাচ্ছেন না। আমি আগে থেকে এঁকে দেখেছি – এখন সাক্ষাৎ দেখছি। দেখেছিলাম – একটি বাগান, উনি উপরে আসনে বসে আছেন; মেঝের উপর আর-একজন বসে আছেন, – তিনি তত advanced (উন্নত নন।)
“এই দেশে চারজন দ্বারবান্ আছেন। বোম্বাই অঞ্চলে তুকারাম ও কাশ্মীরে রবার্ট মাইকেল; – এখানে ইনি; – আর পূর্বদেশে আর-একজন আছেন।”
শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি কিছু দেখতে-টেকতে পাও?
মিশ্র – আজ্ঞা, বাটীতে যখন ছিলাম তখন থেকে জ্যোতিঃদর্শন হত। তারপর যীশুকে দর্শন করেছি। সে-রূপ আর কি বলব! – সে সৌন্দর্যের কাছে কি স্ত্রীর সৌন্দর্য!
কিয়ৎক্ষণ পরে ভক্তদের সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে মিশ্র জামা পেন্টলুন খুলিয়া ভিতরের গেরুয়ার কৌপীন দেখাইলেন।
ঠাকুর বারান্দা হইতে আসিয়া বলিতেছেন – “বাহ্যে হল না – এঁকে (মিশ্রকে) দেখলাম, বীরের ভঙ্গী করে দাঁড়িয়ে আছে।”
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইতেছেন। পশ্চিমাস্য হইয়া দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ।
কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া মিশ্রকে দেখিতে দেখিতে হাসিতেছেন।
এখনও দাঁড়াইয়া। ভাবাবেশে মিশ্রকে শেক্ হ্যাণ্ড (হস্তধারণ) করিতেছেন ও হাসিতেছেন। হাত ধরিয়া বলিতেছেন, “তুমি যা চাইছ তা হয়ে যাবে।”
ঠাকুরের বুঝি যীশুর ভাব হইল! তিনি আর যীশু কি এক?
মিশ্র (করজোড়ে) – আমি সেদিন থেকে মন, প্রাণ, শরীর, – সব আপনাকে দিয়েছি!
[ঠাকুর ভাবাবেশে হাসিতেছেন]
ঠাকুর উপবেশন করিলেন। মিশ্র ভক্তদের কাছে তাঁহার পূর্বকথা সব বর্ণনা করিতেছেন। তাঁহার দুই ভাই বরের সভায় সামিয়ানা চাপা পড়িয়া, মানবলীলা সম্বরণ করিলেন, – তাহাও বলিলেন।
ঠাকুর মিশ্রকে যত্ন করিবার কথা ভক্তদের বলিয়া দিলেন।
[নরেন্দ্র, ডা: সরকার প্রভৃতি সঙ্গে কীর্তনানন্দে ]
ডাক্তার সরকার আসিয়াছেন। ডাক্তারকে দেখিয়া ঠাকুর সমাধিস্থ। কিঞ্চিৎ ভাব উপশমের পর ঠাকুর ভাবাবেশে বলিতেছেন – “কারণানন্দের পর সচ্চিদানন্দ। – কারণের কারণ!”
ডাক্তার বলিতেছেন, হাঁ!
শ্রীরামকৃষ্ণ – বেহুঁশ হই নাই।
ডাক্তার বুঝিয়াছেন যে, ঠাকুরের ঈশ্বরের আবেশ হইয়াছে। তাই বলিতেছেন – “না তুমি খুব হুঁশে আছ!”
ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন –
গান – সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয়কালী বলে,
মন মাতালে মাতাল করে, মদ মাতালে মাতাল বলে।
গুরুদত্ত গুড় লয়ে, প্রবৃত্তি তায় মশলা দিয়ে (মা)
জ্ঞান শুঁড়িতে চুয়ার ভাঁটি, পাল করে মোর মন মাতালে।
মূলমন্ত্র যন্ত্র ভরা, শোধন করি বলে তারা,
প্রসাদ বলে এমন সুরা, খেলে চতুর্বর্গ মেলে।
গান শুনিয়া ডাক্তার ভাবাবিষ্টপ্রায় হইলেন। ঠাকুরেরও আবার ভাবাবেশ হইল। ভাবে ডাক্তারের কোলে চরণ বাড়াইয়া দিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে ভাব সম্বরণ হইল, – তখন চরণ গুটাইয়া লইয়া ডাক্তারকে বলিতেছেন – “উহ্! তুমি কি কথাই বলেছ! তাঁরই কোলে বসে আছি, তাঁকে ব্যারামের কথা বলব না তো কাকে বলব। – ডাকতে হয় তাঁকেই ডাকব!”
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুরের চক্ষু জলে ভরিয়া গেল।
আবার ভাবাবিষ্ট। – ভাবে ডাক্তারকে বলিতেছেন – “তুমি খুব শুদ্ধ! তা না হলে পা রাখতে পারি না!” আবার বলিতেছেন। “শান্ত ওহি হ্যায় যো রাম-রস চাখে!
“বিষয় কি? – ওতে আছে কি? – টাকা-কড়ি, মান, শরীরের সুখ – এতে আছে, কি? রামকো যো চিনা নাই দিল্ চিনা হ্যায় সো কেয়া রে।”
এত অসুখের পর ঠাকুরের ভাবাবেশ হইতেছে দেখিয়া ভক্তেরা চিন্তিত হইয়াছেন। ঠাকুর বলিতেছেন, “ওই গানটি হলে আমি থামব; – হরিরস মদিরা।”
নরেন্দ্র কক্ষান্তরে ছিলেন, তাঁকে ডাকানো হইল। তিনি তাঁহার দেবদুর্লভ কণ্ঠে গান শুনাইতেছেন:
হরিরসমদিরা পিয়ে মম মানস মাতো রে।
(একবার) লুটায়ে অবনীতল হরিহরি বলি কাঁদো রে।
গভীর নিনতদে হরিনামে গগন ছাও রে
নাচো হরি বলে, দুবাহু তুলে, হরিনাম বিলাও রে।
হরিপ্রেমানন্দরসে অনিদিন ভাসো রে,
গাও হরিনাম হও পূর্ণকাম, নীচ বাসনা নাশো রে!
শ্রীরামকৃষ্ণ – আর সেইটি? ‘চিদানন্দসিন্ধুনীরে?’
নরেন্দ্র গাইতেছেন:
(১) চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী,
মহাভাব রসলীলা কি মাধুরী মরি মরি।
মহাযোগে সব একাকার হইল, দেশকাল ব্যবধান সব ঘুচিল রে,
এখন আনন্দে মাতিয়া, দু বাহু তুলিয়া বল রে মন হরি হরি।
(২) চিন্তয় মন মানস হরি চিদ্ঘন নিরঞ্জন।
ডাক্তার একাগ্রমনে শুনিতেছেন। গান সমাপ্ত হইলে বলিতেছেন, ‘চিদানন্দসিন্ধুনীরে, ওইটি বেশ!’ ডাক্তারের আনন্দ দেখিয়া ঠাকুর বলিতেছেন – “ছেলে বলেছিল, ‘বাবা, একটু (মদ) চেখে দেখ তারপর আমায় ছাড়তে বল তো ছাড়া যাবে।’ বাবা খেয়ে বললে, ‘তুমি বাছা ছাড় আপত্তি নাই কিন্তু আমি ছাড়ছি না।’ (ডাক্তার ও সকলের হাস্য)
“সেদিন মা দেখালে দুটি লোককে। ইনি তার ভিতর একজন। খুব জ্ঞান হবে দেখলাম, – কিন্তু শুষ্ক। (ডাক্তারকে, সহাস্যে) কিন্তু রোসবে।”
ডাক্তার চুপ করিয়া আছেন।