ভবঘুরেকথা
দক্ষিনেশ্বরের কালী মন্দির

আমার জ্যেষ্ঠাভগিনী রমাদিদি কোলকাতার গিরিশ বিদ্যারত্ন লেনে থাকত। অল্প কিছুদিনের জন্য আমি তাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। রমাদিদি একদিন বলল, “দেখ, পতিব্রতা হিন্দু স্ত্রী হিসেবে অবিশ্যি স্বামীর বিরুদ্ধে আমার কোন নালিশ করা উচিত নয়; তথাপি আমার একান্ত ইচ্ছে যে নাস্তিকতার পথ থেকে তিনি ফিরুন। আমার ঠাকুরঘরে সাধুসন্ন্যাসীদের ছবিটবিগুলোকে উপহাস করে তাঁর ভারি উল্লাস ! ভাইটি আমার, তুমিই তাকে সাহায্য করতে পারবে- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”

দিদির এ’রকম কাতর অনুনয়ে আমার অন্তর গলে গেল, কারণ আমার বাল্যজীবনে রমাদিদি খুব একটা আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তার করেছিল, আর মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারে সেই শূন্যস্থান স্নেহভালোবাসা দিয়ে পূরণ করবার তার চেষ্টার আর অবধি ছিল না। আমি হেসে বললাম, “তা করব বই কি দিদিমণি, যতদূর পারি আমি তা নিশ্চয়ই করব।”

আমারও মনে একান্ত আগ্রহ যে শান্ত, নিরীহ, সদাহাস্যময়ী দিদিটির মুখ হতে চিরঅন্ধকার যেন ঘুচাতে পারি। অন্তরে নির্দেশ পাবার জন্য রমাদিদি আর আমি নীরবে প্রার্থনায় বসলাম। বছরখানেক আগে রমাদিদি আমায় তাঁকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষিতা করতে বলেছিল, আর তাতে তাঁর ক্রমশঃ উন্নতিও হচ্ছিল।

মনে একটা প্রেরণা এর। বললাম, “দেখ, কালকেই আমি দক্ষিণেশ্বরের মা কালী মন্দিরে যাচ্ছি। তুমিও আমার সঙ্গে চল, আর জামাইবাবুকেও সঙ্গে আনবার চেষ্টা করো। আমি মনে মনে বেশ টের পাচ্ছি- ঐ পুণ্যপীঠের পবিত্র প্রভাবেই মা কালী তাঁর মন গলিয়ে দেবেন। তবে সঙ্গে আনবার সময় আমাদের উদ্দেশ্য যে কি, তা তাঁকে বলো না যেন, বুঝলে?”

দিদিও আশান্বিতা হয়ে তখনই রাজী হয়ে গেল। তার পরদিন খুব ভোরে উঠে দেখলাম যে, রমাদিদি আর জামাইবাবু যাবার জন্য তৈরি। ছ্যাকরাগাড়ি আপার সারকুলার রোড (আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) দিয়ে দক্ষিণেশ্বরের দিকে এগোতে লাগল। ভগিনীপতি সতীশচন্দ্র বসু মহাশয় গুরুদের যোগ্যতা নিয়ে উপহাস করে মজা করতে লাগলেন। দেখলাম, রমাদিদি গাড়ির এক কোণে বসে নীরবে অশ্রুপাত করে চলেছে।

কানে কানে বললাম, “দিদি! কিচ্ছু ভেব না; জামাইবাবুকে জানতেই দিওনা যে, তাঁর হাসিঠাট্টা আমরা সত্যিসত্যিই সব বিশ্বাস করছি।” সতীশবাবু তখন বলছেন, “মুকুন্দ, আরে তোমার এইসব অপদার্থ বুজরুকদের কি করে যে ভক্তিটক্তি কর, তা ভেবেই পাই না‌। সাধুসন্ন্যাসীদের চেহারা দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়। হয় পাকাটির মত রোগা হবে, নইলে হাতির মত মোটা!”

আমি সশব্দে হেসে উঠলাম। আমার ভালমানুষী প্রতিক্রিয়া সতীশবাবুর কাছে বিরক্তিকর লাগল। তিনি গুম হয়ে চুপ করে বসে রইলেন। আর একটি কথাও বললেন না। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির চত্বরে গাড়ি প্রবেশ করবার সময় তিনি দন্তবিকশিত করে উপহাসের সঙ্গে বললেন, “তোমাদের দক্ষিণেশ্বর ভ্রমণের উদ্দেশ্য বোধহয় আমাকে সংশোধন করার চেষ্টা, কি বল?”

কোন কথা না বলে মুখ ফেরাতেই তিনি খপ করে হাতটি ধরে বললেন, “ওহে নবীন সন্ন্যাসী! দুপুরে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাটি ঠিক করে রাখবার জন্যে মন্দিরের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলতে ভুলো না যেন!” সতীশবাবু নিজে পূজারীদের সঙ্গে কোন প্রকার কথাবার্তা বলতে চান না।

তীক্ষ্ণস্বরে উত্তর দিলাম, “আমি এখন ধ্যানে বসতে যাচ্ছি। আপনার খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে ভাবতে হবে না- মা কালীই সব দেখবেন।” সতীশবাবু শাসিয়ে বললেন, “তোমার ও মা কালী আমার জন্যে এক বর্ণও যে কিছু করবেন, তা আমি বিশ্বাস করি না। আমার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থার জন্যে তুমিই দায়ী, বুঝলে ভায়া?”

আমি কালীমন্দিরের সামনে নাটমন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা থামের কাছে একটু আড়ালগোছের জায়গা বেছে নিয়ে পদ্মাসনে বসলাম। বেলা যদিও তখন সাতটা, কিন্তু রোদ বাড়লে গরম অসহ্য হয়ে উঠবে। গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে যেতে সারা পৃথিবী যেন আমার মন থেকে মুছে গেল। মনে মনে ভবতারিণীমায়ের ধ্যান করতে লাগলাম। “যুগাবতার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব”-এই মূর্তিপূজা আর ধ্যান করেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাঁর আকুল কান্নাতে মন্দিরের এই পাথরের মূর্তিই জীবন্ত আকৃতি পরিগ্রহ করে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই কথা বলতেন।

প্রার্থনা করলাম, “মাগো! তুমি তো কথাটি অবধি বল না। কিন্তু তুমিই তো মা, প্রিয়ভক্ত রামকৃষ্ণদেবের আকুল আহ্বানে জীবন্ত হয়ে উঠেছিলে; তবে কেন মা তোমার এই দীনসন্তানের ব্যাকুল কান্নায় কর্ণপাত করছ না?” আমার সাধনা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল, সঙ্গে সঙ্গে মনে এল এক ঐশ্বরিক প্রশান্তি। পাঁচঘণ্টা কেটে গেলেও এবং মাকে অন্তরে দর্শন করলেও যখন কোন উত্তর পেলাম না, তখন একটু হতাশ হলাম।

প্রার্থনা পূরণ করতে বিলম্ব করে ঈশ্বর মাঝে মাঝে ভক্তকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু তিনি শেষপর্যন্ত তাঁর দৃঢ় একনিষ্ঠ ভক্তের কাছে তাঁর ইষ্টমূর্তিতেই দেখা দেন। খ্রিষ্টানভক্ত যীশুখ্রিস্টের মূর্তি দর্শন করে, হিন্দু তার আরাধ্যদেবতা শ্রীকৃষ্ণ অথবা মা কালীর দর্শন পায়, অথবা কোন মূর্তিসাধক না হলে ভক্ত ক্রমবিকাশমান বিরাট জ্যোতিঃ দর্শনলাভ করে থাকে।

অনিচ্ছায় চক্ষুদুটি উন্মুক্ত করলাম; দেখি যে মন্দিরদ্বার একজন পূজারী তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করছে- দুপুরে দ্বারবন্ধ করাই প্রথা। নাটমন্দিরের সেই নির্জনস্থান হতে বেরিয়ে উঠানে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাথরের মেঝে মধ্যাহ্ন সূর্যের প্রকাণ্ড কিরণে অগ্নির ন্যায় উত্তপ্ত।

খালি পা যেন পুড়ে যেতে লাগল। মনে মনে নীরব অভিমানে বললাম, “দয়াময়ী, তুমি তো মা আমায় দর্শন পর্যন্ত দিলে না আর এখন তো তুমি মন্দিরের বন্ধ দরজার পিছনে লুকিয়েই রইলে। ভগ্নীপতির জন্যে যে তোমার কাছে বিশেষ প্রার্থনা জানাতে এসেছিলেন। তা তুমি মা আমার কথা শুনলে কই?”

সঙ্গে সঙ্গে আমার আন্তরিক প্রার্থনার উত্তর পেলাম। প্রথমে সব অস্বস্তি দূর করে মধুর শীতল শিহরণ আমার পৃষ্ঠদেশের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে পায়ের তলা পর্যন্ত পৌঁছল। তারপর কী আশ্চর্য! মন্দিরটি বিরাট আকৃতি ধারণ করল আর তার বড় দরজাটি ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হয়ে মা ভবতারিণীর পাষাণ প্রতিমা প্রকাশিত হল। ক্রমশঃ তা রূপান্তরিত হয়ে জীবন্তমূর্তি পরিগ্রহ করলো- মুখে কি অপরূপ মধুর হাসি। মাথা নেড়ে যেন আমায় ডাকছেন!

সে কি অপরিসীম রোমাঞ্চকারী আনন্দ! তা বর্ণনা করবার ভাষা আমার জানা নেই। মনে হলো কেউ যেন অদৃশ্য পিচকারি দিয়ে আমার সমস্ত শ্বাসবায়ু ফুসফুস হতে টেনে বের করে নিয়েছে, শরীর নিস্পন্দ কিন্তু তাতে জড়ত্ব নেই। ব্রহ্মানন্দের অনুভূতি এল। বা ধারে গঙ্গার উপর দিয়ে কয়েক মাইল দূরের সব জিনিস স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এবং মন্দির ছাড়িয়ে দক্ষিণেশ্বরের চারিদিকের সব তল্লাটও দেখছি। বাড়িঘরগুলোর দেওয়াল সব যেন ঝকঝক চকচক করছে; তার ভিতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি দূরে লোকজনরা সব চলাফেরা করছে।

যদিও আমার শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে না আর শরীরও অদ্ভুত স্থির, তবুও আমি হাত পা অবলীলাক্রমে নাড়তে পারছিলাম। মিনিট কতক ধরে আমি চোখ একবার খুলে আর বুঁজে পরীক্ষা করে দেখলাম। চোখ খোলাই থাক আর বন্ধই হোক, সমানভাবে আমি সারা দক্ষিণেশ্বরের সমস্ত দৃশ্য স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। আধ্যাত্মিক দৃষ্টি, এক্সরে-র মত সব জড়পদার্থেরই ভিতর ভেদ করে যেতে পারে।

দিব্যচক্ষুর কেন্দ্রে সর্বত্রই, কোথাও তার পরিধি নেই। সেই রৌদ্রদগ্ধ বিরাট প্রাঙ্গণের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি নূতন করে উপলব্ধি করলাম যে, বুদ্ধুদের মত অন্তঃসারশূন্য এই জড়জগতের স্বপ্নে ঈশ্বরের পথভ্রষ্ট সন্তানের অবস্থা হতে মানুষ যখন নিজেকে মুক্ত বলে অনুভব করতে পারে, তখন আবার সে তার অনন্তরাজ্য ফিরে পায়। যদি ‘অব্যাহতিলাভ’ করাই ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বে আবদ্ধ মানুষের একান্ত কাম্য হয়, তবে অন্য কোন অব্যাহতিই কি সর্বব্যাপিত্বের গৌরবের সঙ্গে উপমিত হতে পারে?

দক্ষিণেশ্বরে আমার যে ঈশ্বরীয় অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছিল তাতে দেখলাম- অসাধারণভাবে বর্ধিত একমাত্র বিরাট বস্তু হচ্ছে মন্দির আর তার ভিতরকার দেবীমূর্তি। বাকি সব কিছুরই স্বাভাবিক আকৃতি, যদিও প্রত্যেক জিনিসটি যেন একটা মৃদু আর স্নিগ্ধ সাদা, নীল আর বিচিত্র বর্ণের রামধনু রঙের আলোর ছটা দিয়ে ঘেরা।

শরীরটা মনে হল যেন বায়বীয় পদার্থে গড়া- এখনিই হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে। আশপাশের সবকিছু যে জড়পদার্থে তৈরি, তার পরিপূর্ণ জ্ঞান তখনও আছে। চারিদিকে তাকালাম, আর সে আনন্দস্বপ্ন ভাঙতে না দিয়ে দু’ এক পা করে এগোতেও লাগলাম।

মন্দিরের দেওয়ালের পিছনে হঠাৎ দেখতে পেলাম, ভগ্নীপতি একটি কাঁটাওয়ালা পবিত্র বেলগাছের নীচে বসে আছেন। তাঁর চিন্তাধারা কোন্ দিকে বইছে তাও বিনা আয়াসেই বুঝতে পারলাম। দক্ষিণেশ্বরের স্থানমাহাত্ম্যে যদিও তাঁর মন কতকটা উন্নত হয়ে উঠেছিল তথাপি আমার প্রতি মনে মনে তাঁর বিরাগ থেকেই গিয়েছিল। বরাভয়প্রদায়িনী মা ভবতারিণীর মূর্তির দিকে চেয়ে প্রার্থনা জানালাম, “মাগো! তুমি কি আমার ভগ্নীপতির মতিগতি ফিরিয়ে দেবে না মা?”

সেই অপরূপা দেবীমূর্তি, যা এতাবৎকাল নীরবই ছিল, শেষপর্যন্ত কথা বলল- “তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।”

অত্যন্ত সন্তোষের সঙ্গে ভগ্নীপতি সতীশবাবুর দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। যেন কোন আধ্যাত্মিকশক্তি তার ভিতর কাজ করছে, অন্তরের মধ্যে সহসা এইরূপ ভাবের উদয় হওয়াতে তিনি অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে ভূমিআসন ত্যাগ করে উঠে পরলেন। দেখলাম, মন্দিরের পিছনদিক দিয়ে তিনি দৌঁড়ে আসছেন; ঘুসি বাগাতে বাগাতে তিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন।

সর্বব্যাপী স্বপ্নদৃশ্য অন্তর্হিত হল। সেই মহীমময়ী দেবীমূর্তিকে আর দেখতে পেলাম না; বিরাট মন্দির তার স্বাভাবিক আকৃতি ধারণ করল, সঙ্গে সঙ্গে তার স্বচ্ছতাও অন্তর্হিত হল। আবার সর্বশরীর প্রখর রৌদ্রকিরণে ঝলসে যেতে লাগল। দৌঁড়ে নাটমন্দিরে উঠে পরলাম। সতীশবাবুও রাগের চোটে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ঘড়িতে দেখলাম- বেলা তখন একটা। দেবীদর্শন একঘণ্টাটাক স্থায়ী হয়েছিল।

ভগ্নীপতি রাগে চিৎকার করে বললেন, “দুষ্টু কোথাকার, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তুমি আসনপিড়ি হয়ে আর চোখ কপালে তুলে এখানে ঠায় বসে রয়েছ। তোমার খোঁজে বারবার আমি এখানে এসেছি আর গেছি। আমাদের খাবারের কি ব্যবস্থা হল? এখন ত’ মন্দির বন্ধ হয়ে গেল আর তুমিও মন্দিরের লোকেদের বলে রাখনি- এখন আর খাওয়াদাওয়া জুটবে কি করে?”

দেবীমূর্তি আবির্ভাবে যে পরম আনন্দ পেয়েছিলাম, তা অন্তরে তখনও বিদ্যমান। পরম নির্ভরতার সঙ্গে জবাব দিলাম, “মা কালীই আমাদের খাওয়াবেন।”

সতীশবাবু তো ক্রোধে অন্ধ হয়ে চিৎকার করে বললেন, “আচ্ছা বেশ! দেখি আগে হতে বন্দোবস্ত না থাকলে তোমার মা কালী কেমন করে আমাদের আজ এখানে খাওয়ান।”

তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই মন্দিরের একজন পুজারী উঠান পেরিয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। আমায় ডেকে বললেন, “বাবা, তোমার ধ্যানের সময় দেখলাম যে, তোমার মুখ এক স্বর্গীয় জ্যোতিঃতে উদ্ভাসিত। তোমাদের দল আজ সকালে এখানে এসেছে, তাও দেখেছি। আর তা দেখে তোমাদের খাওয়াদাওয়ার জন্যে প্রচুর খাবারও গুছিয়ে রেখেছি। অবিশ্যি আগে থাকতে বলে না রাখলে মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী কাউকে খেতে দেওয়া হয় না, কিন্তু আমার কাছে তোমাদের কথা আলাদা।”

আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে সোজাসুজি সতীশবাবুর দিকে তাকালাম। ভাবাবেগে উত্তেজিত হয়ে, নীরব অনুতাপে তিনি চোখ নামিয়ে নিলেন। যখন একটি বেশ ভালোমতো ভোজের বন্দোবস্ত হল- এমন কি তার মধ্যে অসময়ের নাম অবধিও ছিল, তখন দেখা গেল যে ভগ্নীপতি- মহাশয়ের ক্ষুধা অতি অল্প। তাঁর চিত্ত তখন উদ্ভ্রান্ত, চিন্তাসমুদ্রে ডুবে গেছেন।

কলকাতায় ফিরবার পথে সতীশবাবু অত্যন্ত কোমলভাবে সানুনয় দৃষ্টিতে আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিলেন। সতীশবাবুর স্পদ্ধাস্ফালনের সাক্ষাৎ উত্তর হিসাবেই যখন সেই পূজারীঠাকুর এসে আমাদের খেতে ডাকলেন, সেইমুহূর্ত থেকে তিনি আর একটি কথাও বলেন নি।

তার পরদিন বৈকালে দিদির বাড়ি গেলাম। দিদি সস্নেহে আমায় ডেকে উপরে নিয়ে গেল। বলল, “ভাই মুকুন্দ! কি আশ্চর্য ব্যাপার শুনেছ? কাল সন্ধ্যেবেলা তোমার ভগ্নীপতি আমার সামনে বসেই কাঁদছিলেন।

তিনি কি বললেন জান, ‘তুমি দেবী!’

তোমার ভাইয়ের আমার এই মতিগতি বদলাবার মতলবে আমি যে কি পর্যন্ত সুখি হয়েছি, তা আর মুখে কি বলবো। তোমার উপর যা কিছু আমি অন্যায় অবিচার করেছি, তার সব প্রায়শ্চিত্ত আমি করব। আজ রাত থেকে আমাদের বড় শোবার ঘরটা পূজোর ঘর হিসাবে ব্যবহার করব; আর তোমার ছোট্ট পূজোর ঘরটি আমাদের শোবার ঘর করে নেব। তোমার ভাইকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছি বলে সত্যি অনুতপ্ত।

যে নির্লজ্জ ব্যবহার আমি তার সঙ্গে করেছি তার শাস্তি হিসেবে যতদিন না সাধনপথে আমি বেশ অগ্রসর হতে পারি, ততদিন আর আমি মুকুন্দের সঙ্গে কোন কথা বলব না। আজ থেকে জগন্মাতার গভীর ধ্যান করব। কোন না কোন দিন নিশ্চয়ই আমি তাঁর দর্শন পাব বই কি।”

বহুবছর বাদে (১৯৩৬ সালে) দিল্লীতে ভগ্নীপতির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। দেখে অত্যন্ত আনন্দ হল যে, তাঁর খুব উচ্চ আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, জগন্মাতার দর্শনলাভও তাঁর ভাগ্যে ঘটেছিল। তাঁর সঙ্গে অবস্থানকালে আমি দেখেছিলাম যে, যদিও তিনি তখন একটা গুরুতর অসুখে ভুগছিলেন আর দিনের বেলায় তাঁকে অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতে হত, তবুও সতীশবাবু রোজ রাত্রের অধিকাংশ সময় গুপ্তভাবে ধ্যানধারণাতেই অতিবাহিত করতেন।

মনে কেমন যেন একটা ধারণা হলো যে, ভগ্নীপতি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। দিদিও আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল। বলল, “ভাই! আমি তো বেশ ভালো আছি কিন্তু তোমার ভগ্নীপতির অসুখ! তুমি জেনে রেখো যে, আমি সতী স্ত্রী, মরণ আমারই আগে হবে। আমার আর বেশিদিন নয়, তাও জেনো।”

তার এই অমঙ্গলসূচক কথায় আমি হতভম্ভ হয়ে গেলেও তার মধ্যে সত্যের দৃঢ়তা অনুভব করলাম। তার ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় বছরদেড়েক পরে আমার দিদি যখন মারা যায়, তখন আমি আমেরিকায়। আমার ছোটভাই বিষ্ণু তার বিস্তৃত সংবাদ দিয়েছিল।

বিষ্ণু লিখেছিল, “মরবার সময় রমাদিদি আর সতীশবাবু কলকাতাতেই ছিলেন। যেদিন মারা যান, সেদিন সকালে দিদি সাজলেন যেন বিয়ের কনে। সতীশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত সাজগোজ কিসের গো?’ দিদি বললেন, ‘পৃথিবীতে তোমার চরণসেবার আজই আমার শেষ দিন।’

কিছুক্ষণ বাদেই তাঁর বুকধড়ফড়ানি শুরু হল। তাঁর ছেলে যখন ডাক্তার ডাকবার জন্যে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল, দিদি তাকে বারণ করে বললেন, ‘বাবা! আমায় ছেড়ে আর কোথাও যেও না। ডাক্তার ডাকবার এখন আর দরকার নেই; তোমার ডাক্তার আসার আগেই আমি চলে যাব।’ মিনিটদশেক বাদে, স্বামীর চরণে মাথা রেখে, পরিপূর্ণ শান্তিতে, আর বিনা কষ্টে রমাদিদি সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেন।”

বিষ্ণু লিখেছিল, “দিদি মারা যাবার পর সতীশবাবু একলা থাকতেই ভালবাসতেন। একদিন তিনি আর আমি দিদির একটা বড় ফটোগ্রাফ দেখছি- দিদির হাসিমাখা মুখ। দিদি যেন সামনে দাঁড়িয়ে, সতীশবাবু চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘হাসছ কেন গো?’ মনে ভেবেছ যে আমার আগে পালিয়ে গেছ বলে তুমি বড় চালাক, না? সেটি হবে না, তা জেনে রেখো। দেখিয়ে দেব যে তুমি বেশিদিন আর আমার কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারবে না। শীগগিরই আমি তোমার কাছে যাচ্ছি।”

“যদিও এই সময়ে সতীশবাবু সম্পূর্ণ রোগমুক্তি ঘটেছিল আর তাঁর স্বাস্থ্যও বেশ চমৎকার ছিল- কিন্তু সেই ফটোগ্রাফের সামনে তাঁর ঐ অদ্ভুত উক্তির অল্প কিছুকাল পরেই তিনি মারা গেলেন। তার কারণ জানা গেল না।”
এমনি করেই দুটি প্রাণ নিঃশেষিত হয়েছিল, একটি আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় বড়দিদি রমা, অমাার ভগ্নীপতি সতীশবাবু- দক্ষিণেশ্বরে যার পরিবর্তন ঘটেছিল একজন নিতান্ত সাধারণ সংসারীলোক থেকে এক নীরব সাধুতে।

……………………………………..
যোগী-কথামৃত (Autobiography of a Yogi) শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত।

পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত।

মৎপ্রণীত ইংরাজী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী’র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই। – পরমহংস যোগানন্দ

পুণঃপ্রচারে বিনীত : প্রণয় সেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!