ভবঘুরেকথা

-সৈয়দ তারিক

এক.
মহাপরাক্রমী আলেকজান্ডার যখন বিশ্বজয়ে লিপ্ত, তখন তারই দেশে ডায়োজেনেস নামে এক সন্ন্যাসী জাগতিক সুখ পরিত্যাগ করে একটা গামলায় বসে-বসে অনুধ্যানে মগ্ন। একে জীবন হতে পলায়ন বলা যাবে কি? বলা যাবে কি আত্মরতি?

সেই স্বর্ণযুগের গ্রিসের দার্শনিকেরা বিপণিবিতানে বিলাসসামগ্রী দেখে নিজেকে প্রশ্ন করতেন- কী-কী জিনিস ছাড়াই আমার দিব্যি চলে যাবে? বিলাসহীন ও সরল জীবনযাপন এবং উচ্চতর চিন্তন ছিল সেকালের জ্ঞানীদের আদর্শ। আর সক্রেটিস মানবজাতির জন্য একটি চিরকালের অনুজ্ঞা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন- ‘নিজেকে জানো’।

নিজেকে জানো- এই উপদেশ দিয়েছেন যুগ-যুগান্তরের প্রজ্ঞাবানেরা, ঋষি ও সন্ন্যাসীরা, দরবেশ ও সন্তরা। নিজেকে জানার মানে হলো, নিজের মনের স্তরসমূহ ও প্রবণতাগুলোকে জানা, নিজের স্বভাবগত সীমা কাটিয়ে ওঠা, নিজের চেতনার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়া‌। চেতনার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়া মানে সকল দ্বৈততার উপরে ওঠা।

এটি এমন নিরপেক্ষতা যার মাধ্যমে ছোট-বড়, ভালো-মন্দ, সাদা-কালো ইত্যাদি দ্বৈততা-মূলক বাস্তবতাকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিবেচনা করা সম্ভব হয়। এই কেন্দ্রস্থতার ফলে সবকিছুকে আমাদের নিজের অবস্থান-পছন্দ-প্রয়োজন থেকে বিবেচনা করবার যে-প্রবণতা আছে তা থেকে মুক্ত হয়ে বস্তু ও ঘটনাসমূহকে ওরা যেমন ঠিক তেমন ভাবেই দেখবার অবকাশ ঘটে।

এটা আত্মকেন্দ্রিক হওয়া নয়, অহমের পরিধি পেরিয়ে যাওয়া, নিজেকে শুদ্ধ করা। এই বিশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ সেই পূর্ণতা অর্জন করে যার ফলে সে দিব্য জীবনের অধিকার লাভ করে।

দুই.
অহম, বাসনা ও প্রতিক্রিয়া- এই তিনটি জিনিসকে চিনতে ও শোধন করতে হয়। অহম হল ‘আমিত্ব’, আমি নয়। আমিত্ব হলো অহমিকা- এর সাথে একরকম প্রবৃত্তি-আবেগ-অনুভূতির যোগ রয়েছে। আর আমির বোধ হলো নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা, যা ব্যক্তিগত হয়েও নৈর্ব্যক্তিক।

আমিত্ব হলো আমি- আমি, আমার-আমার ভাব। সিদ্ধ পুরুষের মধ্যেও আমির বোধ থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তাতে আমিত্ব থাকে না। তিনি এরই মধ্যে পূর্ণতার যে স্বাদ গ্রহণ করেছেন তার ফলে তার চেতনার উত্তরণ ঘটে গিয়েছে। কিন্তু দেহ-মনে তার স্বকীয় অস্তিত্বের বাস্তবতাও থাকে। ফলে তিনি একই সঙ্গে ব্যক্তি এবং সমগ্র।

বাসনার পরিধিতে কাম, লোভ এবং মোহ রয়েছে। প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ক্রোধ, ঈর্ষা, ঘৃণা ও ভয় রয়েছে। আর, অহম-বাসনা-প্রতিক্রিয়া – এই তিনটি জিনিস পরস্পর পৃথক নয়; বরং সম্পর্কিত।

সুতরাং অহম, বাসনা ও প্রতিক্রিয়া- এই তিনটি জিনিসকে পরিশোধন করলে বা নিয়ন্ত্রণ করলে, মানবিক গুণগুলো অর্জিত হলে ও দোষগুলো বর্জিত হলে মানুষ পরিপূর্ণতা অর্জন করে। আর সেটাই কামালিয়াত বা দিব্য জীবন।

সেই সাথে ওই ব্যক্তি ধ্যানযোগে অন্তর্লোকের ও বিশ্বলোকের সত্য ও সৌন্দর্য ও আনন্দ লাভ করে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে প্রজ্ঞা অর্জন করে এবং প্রেমানন্দে মহামানবের জীবন যাপন করে।

তিন.
পুরো ব্যাপারটি হলো আত্মদর্শনের। প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার, এই আত্মদর্শন জিনিসটি কী? কী বুঝিয়েছেন সাঁইজি যখন তিনি বলছেন, ‘আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে’?

সুফিবাদের মূল কথা পাওয়া যায় এই হাদিসে কুদসিতে- মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু- যে নিজের নফ্সকে (প্রাণকে/প্রবৃত্তি-প্রবণতাকে) চিনেছে সে তার প্রভুকে (আল্লাহকে/পরমাত্মাকে) চিনেছে।

সুফিতত্ত্ব অনুসারে নফ্স আর রুহ এই দুই মিলে পুরো আমি। রুহ অনেক গভীরের বিষয়, তাই আগে নফ্সের সাথে হিসাব চুকাতে হবে।

নফ্স হলো জীবাত্মা অর্থাৎ জীবের প্রবৃত্তি ও প্রবণতাসমূহ। কাজেই ব্যক্তির যা-কিছু বৈশিষ্ট্য ও মাত্রা সেগুলোকে জানতে হবে। জানার দুটো দিক আছে- একটি হলো বাহ্যিকভাবে জানা। এই জানাটা বিজ্ঞানের অন্তর্গত।

একটি মানুষের শরীর আছে, তার সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত ইতিহাস আছে, তার শরীরতত্ত্ব আছে। এই সকল বিষয়ে ধারণা সাধকের থাকতেও পারে, কিন্তু তার প্রধান বিষয় হলো ভিতর থেকে নিজেকে জানা, অর্থাৎ নিজের মনকে জানা।

‘আমি’-কে অনুভব করে মন; মনকেও অনুভব করে মন। এই মনের কী-কী দিক রয়েছে, নিরন্তর সেগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

প্রবৃত্তি, আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তি- এই তিনটি জিনিস সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। জিনিসগুলো পরস্পর যে আলাদা তা নয়, আবার একও নয়। প্রবৃত্তি প্রধানত শারীরিক; আবেগের শারীরিক ভিত্তি থাকলেও তা মানসিক; আর বুদ্ধিবৃত্তি আরেকটু উপরের স্তরের- তা গাণিতিক ও যৌক্তিক সূত্রে কাজ করে।

উদাহরণ দেওয়া যাক। কাম বা ক্ষুধা প্রবৃত্তির বিষয়। কাম্যবস্তু বা খাদ্য পাওয়া গেলে কিংবা না পাওয়া গেলে যে সন্তুষ্টি অথবা অসন্তুষ্টি বা এই সংক্রান্ত যে মানসিক অনুভূতিরাশি তা হলো আবেগ। আর কাম্যবস্তু বা খাদ্য পাওয়ার উপায় কিংবা কাম্যবস্তু বা খাদ্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চিন্তা হলো বুদ্ধিবৃত্তির বিষয়।

এইরকমভাবে আমাদের সকল চাওয়া-পাওয়া ও না-পাওয়ার সাথে আমাদের মন যেভাবে জড়িয়ে আছে, যেভাবে সে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে, সেগুলো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমরা আমাদের মনের কার্যক্রম লক্ষ্য করতে পারি। আসল ব্যাপারটি হলো মনের কার্যক্রম নিরন্তর লক্ষ্য করা।

এভাবে মনকে জানার ফলে দেহ-মনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে-সকল ব্যাপার ঘটে সেগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আসে। এটি আত্মজয়ের একটি মাত্রা। এভাবে প্রতিটি মনোদৈহিক প্রবণতাকে সনাক্ত ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

কিন্তু ধ্যান-সাধনার সাথে এইসকল পর্যবেক্ষণের সম্পর্ক কী?

ধ্যান-সাধনার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে অর্থাৎ নিজের সীমাকে অতিক্রম করে যাওয়া। ধ্যানের লক্ষ্য হচ্ছে নিজের ভেতরে অবস্থিত অসীম পরমসত্তা বা রুহ বা পরমাত্মা যা অজ্ঞাতভাবে রয়েছে তাকে জ্ঞানের সীমানায় নিয়ে আসা।

পরম সত্তা বা রুহকে বা পরমাত্মাকে চেতনায় জাগিয়ে তুলতে হলে তার কাছে সজ্ঞানে পৌঁছাতে হবে আর তা করতে হলে নফ্সের সীমা পেরিয়ে যেতে হবে। নফ্সের সীমানা পেরোনোর অর্থ এই নয় যে প্রবৃত্তি ও প্রবণতাসমূহের মৃত্যু ঘটে, বরং সেগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আসে এবং সেগুলো গোপনে অর্থাৎ আমাদের অজ্ঞাতে আমাদের উপর যে প্রভুত্ব করত সেই স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।

চার.
চেতনার পূর্ণ বিকাশ-সাধন হল লক্ষ্য। জড় থেকে জৈব সত্তা হয়ে চেতনার যে বিকাশ হয়েছে তার অধিসচেতন বিকাশ ঘটাতে হবে। কিন্তু শুধু সে চেতনায় সমাধিস্থ থাকা নয়, জড় ও জীবজগতের উপরে এই অধিসচেতন সত্তার জাগ্রত অবস্থান রাখতে হবে। সেটাই পূর্ণতা। সেটি জ্ঞানময়, আনন্দময় ও কল্যাণময় অবস্থা।

জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ ও ধ্যানযোগের সমন্বিত অবস্থা জারি রাখতে হবে। আসক্তিহীনভাবে জগতের স্বাদ ও সৌন্দর্য উপভোগ, স্বার্থপরতামুক্ত জীবনযাপন, জগৎ ও জীবনের তাৎপর্য অনুধাবন ও মানবিকতার উত্তরণের জন্য যথাযথ পদ্ধতির অনুশীলন করতে হবে। এর মাধ্যমে বিকাশমান সৃজনশীলতায় পরমকে অনুধাবন করতে হবে।

সাধনমার্গ সবসময়েই নৈতিক অনুশীলনের নির্দেশ দেয়। বৌদ্ধ-জৈন-পাতঞ্জল-সুফি: সব সাধনমার্গই নৈতিক গুণাবলী চর্চার বিধান দেয়।

ধ্যানে একদিকে নিজের প্রবৃত্তিগত সীমাকে চিনতে ও অতিক্রম করতে হয়, অন্যদিকে চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করে ক্রমশ অধিচেতনায় পৌঁছাতে হয়।

চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করার ফলে সাধক মানসিক শক্তি অর্জন করে। অধিচেতনায় পৌঁছুবার ফলে সে জড় ও জীবজগতের পূর্বের সীমা অতিক্রম করে। প্রেম তাকে মানবিক ও কল্যাণময় করে। ধ্যান তাকে প্রজ্ঞামণ্ডিত করে।

ঈশ্বর হলো সর্বোত্তম আদর্শ। ঈশ্বর হলো পরিপূর্ণতা। ঈশ্বর হলো প্রজ্ঞা ও প্রেমের পূর্ণ বলয়। শক্তিও প্রয়োজন। আত্মশক্তি। নৈতিকতার জন্য, কর্মের জন্য শক্তি প্রয়োজন। শক্তি মানে আমেলিয়াত বা তান্ত্রিক অভিচার নয়। আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রকাশের ক্ষমতাই শক্তি।

প্রজ্ঞার শক্তি আছে। প্রেমেরও।

পাঁচ.
এই যে আমাদের দেহ, এটা কোটি-কোটি কোষের সমষ্টি। প্রতিটি কোষ একক সত্তা। কিন্তু সবগুলো কোষ মিলিতভাবে একটি অখণ্ড বৃহৎ সত্তা তৈরি করে। সেই সত্তাটি আমি। প্রতিটি কোষের যদি চেতনা থাকত ‌বা থাকে, সেটি হলো ব্যক্তি-মানুষের মনের মতো।

আর ঈশ্বর হলেন সবগুলো কোষ মিলিত হয়ে ব্যক্তি-কোষের চেতনা হারিয়ে মানুষের মন হয়ে ওঠার মতো। জগতের সমস্ত ব্যক্তিমনগুলোর একত্রিত রূপ হলো ঈশ্বর। শুধু মানুষ নয়: সকল প্রাণী ও সকল জীবের চেতনা, এমনকি সকল বস্তুর নিজস্ব অবস্থা বা suchness বা thatness এর সমষ্টি হলো ঈশ্বরের মন।

কাজেই ব্যক্তি মানুষ যখন আমিত্বের সীমা ছাড়িয়ে নিজের মনকে পূর্ণতার কাছে সমর্পণ করে বা পূর্ণতাকে উপলব্ধি করে তখন সে ঈশ্বরের মনকে জানতে পারে। তার মন তখন ঈশ্বরের মনের সাথে মিলিত হয়। সে তখন ঈশ্বরিত হয়ে যায়। তখনই তার উচ্চারণ হয়- আনাল হক – আমিই পরম সত্য।

……………………………………..
সৈয়দ তারিক
সুফি কবি ও লেখক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!