ভবঘুরেকথা
গঙ্গা নদী

-ড সৌরভ মণ্ডল

আজ উত্তরায়ণ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে প্রতি বৎসরের ন্যায় গঙ্গাসাগর তীর্থে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়া পালিত হইতেছে।

ধন্যতীর্থ গঙ্গাসাগর মহিমা অপার,
ভক্তিতে করিলে তীর্থ মুক্তি সবাকার।।

আচার্য্য আদি শঙ্করাচার্য্য গঙ্গার দেবীর স্তুতি করিয়া বলিয়াছেন-

দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে
ত্রিভুবন তারিণী তরলতরঙ্গে,
শঙ্করমৌলি নিবাসিনী বিমলে
মম মতিরাস্তাং তব পদ কমলে।।

সুদূর হিমালয় হইতে গঙ্গা নির্গত হইয়া সাগরে আসিয়া মিলিত হইয়াছে এবং ইহার ধারা অদ্যাবধি অব্যাহত রহিয়াছে। মিলিত হইবার পূর্বে একটি লম্বা দ্বীপভূমি (সাগর দ্বীপ) রচনা করিয়া তাহার দুই পাশ দিয়া বহমান হইয়া, যেই স্থানে আসিয়া সাগরে মিলিত হইয়াছে তথায় মহাতীর্থ গঙ্গা সাগর সৃষ্টি হইয়াছে। সাংখ্যাচার্য মহা মুনি কপিলদেবের আশ্রম ও এই স্থানেই রহিয়াছে।

শাস্ত্রমতে সগর বংশ উদ্ধারের নিমিত্তে রাজা ভগীরথ বিষ্ণুপাদোদ্ভূতা ‘দেবী গঙ্গা’কে স্বর্গ হইতে মর্তে আনয়ন করেন।

কিন্তু ভাবিবার বিষয় হইলো গঙ্গাস্নানে কি প্রকৃতই আমাদিগের সর্ব পাপ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়? পুণ্য সলিলা দেবী গঙ্গায় অবগাহন করিলে দেহের মল বিদুরিতো হয় বটে, কিন্তু মনের মল? তা কি যায়?

যদি যাইতো তাহা হইলে গঙ্গাস্নান করিয়া সিক্ত বসনেও যদি বিষ্ঠা স্পর্শ করিয়া ফেলি, তাহা হইলেই আবার গঙ্গায় স্নানের নিমিত্ত ধাবিত হই কেন?

যখন গঙ্গা স্পর্শ মাত্রই পবিত্র বিবেচিত হয় তখন গঙ্গা সিক্ত অবস্থায়ও অপবিত্রতা বোধ, কারণ বিষ্ঠার স্পর্শ, ইহাতে সহজেই অনুমেয় এই বাহিরের গঙ্গাস্নানে দেহের মল যাইলেও মনের মল দূরীভূত হইবার নহে।

তাহা হইলে এক্ষণে দেখা যাউক কে এই ভগীরথ, প্রকৃত গঙ্গাকে ও মকর সংক্রান্তির গঙ্গাস্নান কি?

যোগ শাস্ত্র হঠোযোগ প্রদীপিকা মতে-

যাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাহা আছে ভাণ্ডে,
যাহা নাই ভাণ্ডে, তাহা নাই ব্রহ্মাণ্ডে।।

অর্থাৎ এই ব্রহ্মাণ্ড মাঝে যাহাই আছে তাহা সকল কিছুই আছে এই দেহের মাঝে।

ভগীরথ = রথ অর্থাৎ যাহার উপরে উঠিয়া যাওয়া আসা রূপ কার্য হইয়া থাকে। এই দেহই প্রকৃত রথ পদবাচ্য। কারণ প্রাণ এই দেহকেই আশ্রয় করিয়াই গমনাগমন করিয়া থাকে। প্রাণ না থাকিলে এই দেহের কোন মূল্য নাই।
আর মন এই শরীরটার মাধ্যমেই সকল কিছু ভোগ করিয়া থাকে। শরীর না থাকিলে মনের কোন অস্তিত্তই নাই। অতএব মনই এই ভোগায়তন ক্ষেত্র দেহের রাজা; তাই মনই প্রকৃত ভগীরথ।

গীতার দশম অধ্যায়ের ৩১ নম্বর শ্লোকে ভগবান বলিয়াছেন-

ঝসাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী।

অর্থাৎ মৎস্যগণের মধ্যে আমি মকর ও স্রোত মধ্যে আমি জাহ্নবী। গঙ্গার অপর নাম হইলো জাহ্নবী। ভগবান বলিয়াছেন স্রোতমধ্যে অর্থাৎ যেখানে গমন ও আগমন রহিয়াছে যাহা স্থির নয়। আমাদের শরীরে প্রাণ বায়ু ও স্থির নয় তাহার গমন ও আগমন সর্বদাই চলিতেছে। তাহা না হইলে অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস না চলাচল করিলে মৃত বলিয়া থাকি।

এই প্রাণ বায়ু যে পথে গমনাগমন করিতেছে তাহা হইলো ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী। অতএব প্রাণরূপী আত্মাই প্রকৃত গঙ্গা। ইনি দেহের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে প্রকাশিত।

দেহের অধঃস্থানে পাতালে বা নাভী হইতে পদতল পর্যন্ত প্রাণ ধারা অর্থাৎ মূলাধারে ভোগবতী বা তামসিক গঙ্গা। দেহের মধ্যস্থানে অর্থাৎ হৃদিস্থানে বা নাভীর ঊর্ধ্ব হইতে কণ্ঠ পর্যন্ত ইহা জাহ্নবী বা রাজসিক গঙ্গা।

দেহের ঊর্ধ্বস্থানে অর্থাৎ কণ্ঠ হইতে মস্তক পর্যন্ত অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে ধীরা মন্দাকিনী স্বরূপা সাত্ত্বিক গঙ্গা।

ভগীরথ অর্থাৎ মন কর্তৃক প্রাণ প্রবাহ রূপা দেবী গঙ্গা আজ্ঞাচক্র বা স্বর্গ হইতে চঞ্চল হইয়া বা তরঙ্গায়িত হইয়া ইড়া ও পিঙ্গলা নামক দুই নাড়ী পথ দিয়া মূলাধারে বা পাতালে আছড়াইয়া পড়ে।

এই পথে আগমনকালে দেবী গঙ্গা তিনটি গ্রন্থি সৃষ্টি করেন। বিষ্ণুপাদোদ্ভূতা দেবী গঙ্গা যখন ঊর্ধ্বে (আজ্ঞাচক্র) থাকেন তখন তাহাকে বিষ্ণুগ্রন্থি অতিক্রম করিতে হয়।

তাহার পর মহাদেব তাহাকে আপন মস্তকে ধারন করেন অর্থাৎ মধ্যস্থানে হৃদয়ে (অনাহতচক্র) রুদ্রগ্রন্থি বা হৃদয়গ্রন্থি অতিক্রম করিতে হয়।

সর্বশেষে তিনি নিম্নে পাতালে অর্থাৎ (মূলাধারচক্র) মূলাধার গ্রন্থির সৃষ্টি করেন।

তাই সাধক যখন প্রাণরূপী প্রকৃত গঙ্গায় অবগাহন করিতে চাহেন তখন তাহাকে সুষুম্না পথে এই তিন গ্রন্থি অতিক্রম করিতে হয় তাই সাধারণে তিনটি ডুব দেবার প্রচলন।

এই পথে গমনকালে একটু অগ্রসর হইলেই সাধক গুরুকৃপায় যখন মূলাধার গ্রন্থি ভেদ করিয়া সিদ্ধি লাভে উদ্যত হন। তখন তিনি এক পিঙ্গল বর্ণ যুক্ত বা পীতজ্যোতির মধ্যে ঘনশ্যাম বর্ণ গোলাকার এক জ্যোতির প্রকাশ দেখিতে পান, উহাই কপিল মুনি। তাই গীতার দশম অধ্যায়ের ২৬ নম্বর শ্লোকে ভগবান বলিয়াছেন, ‘সিদ্ধানাং কপিল মুনি’ অর্থৎ সিদ্ধগণের মধ্যে আমিই কপিল মুনি।

মকর সংক্রান্তি = মকর দেবী গঙ্গার বাহন স্বরূপ।

অজপাই প্রকৃত মকর পদবাচ্য। ইড়া নাড়ী মধ্যে অজপারূপ মৎস বিচরণ করিতেছে। তাই গীতার দশম অধ্যায়ের ৩১ নম্বর শ্লোকে ভগবান বলিয়াছেন, ‘ঝসাণাং মকরশ্চাস্মি’ অর্থাৎ মৎস্যগণের মধ্যে আমি মকর। এই মকররূপি মৎস্যের শেষ অবস্থাই অর্থাৎ অজপারূপ প্রাণের স্থির অবস্থাই মকর সংক্রান্তি।

তাই আসুন আমরা সবাই মকর সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে জ্ঞানগঙ্গা রূপী প্রাণ গঙ্গায় অবগাহন করিয়া মুক্তি প্রাপ্ত হই-

জ্ঞান গঙ্গা হৃদি মাঝে বহে সর্বক্ষণ
সে নীরে করিলে স্নান শুদ্ধ হবে মন,
মকর কুম্ভীর যত জাহ্নবীতে রয়
জ্ঞান বিনা তাহাদের মুক্তি নাহি হয়।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!