গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
-মূর্শেদূল মেরাজ
এক
কুমারীত্ব অক্ষত থাকবে এই শর্তে মৎস্যজীবীর কন্যা সত্যবতী পরাশর মুনির সন্তান নিজ গর্ভে ধারণের প্রস্তাবে সাড়া দিলে; তাদের মিলনে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। গায়ের বর্ণ কালো আর দ্বীপে জন্ম নেয়ায় কালো আর দ্বীপ মিলে শিশুটির হয়ে যায় ‘কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন’।
পরবর্তীতে এই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন চারটি বেদ, ১৮টি পুরাণ, উপপুরাণ, বেদান্ত দর্শন, ভাগবত পুরাণ সংকলন ও মহাভারত রচনা করে জগৎ বিখ্যাত হন। শত শাখাযুক্ত ‘বেদ’কে চার ভাগে ভাগ করে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন পরিচিত হয়ে উঠেন ‘বেদ ব্যাস’ নামে। যা পরবর্তীতে রূপ নেয় ‘ব্যাসদেব’ এ। ‘ব্যাস’ অর্থ ভাগ।
বলা হয়ে থাকে, ব্যাসদেবের থেকেই সূচিত হয় গুরু-শিষ্য পরম্পরা। যা ভারতবর্ষে জ্ঞান অর্জনের প্রধান ও অন্যতম ধারায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে সমাজের মূল ধারা এই পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসলেও; আধ্যাত্মজ্ঞান অর্জনে গুরু-শিষ্য পরম্পরা আজও সমান তালে প্রবাহিত।
ব্যাসদেবের প্রায় প্রতিটি রচনা বা সংকলনই গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে ঘিরে। এর মধ্যে ২১৬ স্তোত্রের ‘গুরুগীতা’ গুরু-শিষ্য পরম্পরা নিয়ে রচিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বলে বিবেচিত। জানা যায়, ব্যাসদেব এ গ্রন্থটি জগতের সকল গুরুদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। তাই ব্যাসদেবকে কেন্দ্র করে অনেকে এই গুরুপূর্ণিমাকে ‘ব্যাস পূর্ণিমা’ও বলে থাকেন।
এই গুরু-শিষ্য পরম্পরার জনক হিসেবে মহর্ষি বেদব্যাসকে ‘ভারতগুরু’ মেনে তার জন্মতিথি অর্থাৎ আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা মর্যাদা পায় ‘গুরুপূর্ণিমা’ নামে। তাই কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের সাধুগুরু তথা গুরুবাদী সকল মতবাদের ভক্তিবাদী মানুষ এই দিনটিকে অত্যন্ত ভক্তি-বিনয়-সমর্পণ ভাব নিয়ে গুরুত্বের সাথে পালন করে আসছে।
সাধুরা বলেন, গুরুর প্রতি শিষ্যের ভক্তি দিনক্ষণ মেনে বাড়ে বা কমে না; তা চলে সর্বক্ষণ অর্থাৎ সর্বশ্বাসেই। আর ভক্তের মনে যখন এমন ভাবের উদয় হয় তখনই গুরুর কৃপা পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। তারপরও গুরুশিষ্যের মাঝে বেশ কিছু দিন-ক্ষণ-কাল-লগ্ন আছে যাকে কেন্দ্র করে হয় বিশেষ সব ক্রিয়া। হয় ভক্তি প্রদর্শন।
এসব দিনের মধ্যে দীক্ষাগ্রহণের বারটি শিষ্যের কাছে বেশ গুরুত্ব বহন করে। সপ্তাহের এ দিনটিতে শিষ্য গুরুকে স্মরণ করে বিশেষ ভক্তি নিবেদন করে। আবার সপ্তাহের বৃহস্পতিবারকে বলা হয় গুরুবার। সেদিনটি গুরু-শিষ্য সকলেই নিজনিজ গুরুর প্রতি বিশেষ ভক্তি জ্ঞাপন করে থাকে।
তারপর খেলাফত বা গুরু হিসেবে স্বীকৃতির দিনটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই দিন গুরু যেমন নিজে নিজ গুরুকে ভক্তি জানায়। তেমনি শিষ্যও নিজ গুরুর খেলাফত দিবসে আনুষ্ঠানিকতা পালন করে। এরপর নিজ নিজ ধারার প্রথম গুরুর জন্ম-তিরোধান-খেলাফত দিবসের পাশাপাশি তিনি যদি কোনো বিশেষ দিন পালন করে থাকেন, সেই দিন ও অনুষ্ঠানগুলো গুরু-শিষ্য উভয়ই বিশেষ গুরুত্ব-মর্যাদা দিয়ে ভক্তি নিবেদন করে।
এরপর শাস্ত্রে বর্ণিত এবং মুনি-ঋষি-সাধকদের পালিত বিভিন্ন দিন-ক্ষণ-কালকেও নিজ নিজ মতাদর্শীরা বিশেষভাবে পালন করে। মোটকথা কেবল অনুষ্ঠান-উৎসব-দিনই নয় সকল কাজই শিষ্য নিজ নিজ গুরুর নামে শুরু করে।
তারই ধারাবাহিকতায় আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত গুরুপূর্ণিমা কেবল গুরুবাদীদের কাছেই নয় জগতের সকলের কাছেই গুরুর প্রতি নিবেদনের বার্তা নিয়ে আসে প্রতি বছর। এই মতে বিশ্বাসী সকলেই নিজ নিজ প্রথা-রীতিনীতে এই বিশেষ দিনটি পালন করে থাকে।
ব্যাসদেবের প্রায় প্রতিটি রচনা বা সংকলনই গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে ঘিরে। এর মধ্যে ২১৬ স্তোত্রের ‘গুরুগীতা’ গুরু-শিষ্য পরম্পরা নিয়ে রচিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বলে বিবেচিত। জানা যায়, ব্যাসদেব এ গ্রন্থটি জগতের সকল গুরুদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। তাই ব্যাসদেবকে কেন্দ্র করে অনেকে এই গুরুপূর্ণিমাকে ‘ব্যাস পূর্ণিমা’ও বলে থাকেন।
দুই
পুরাণ মতে, আদিযোগী শিব আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথিতে ‘আদিগুরু’তে রূপান্তরিত হন। আবার এই দিনেই তিনি তাঁর প্রথম শিষ্য সপ্তর্ষির সাত ঋষি- অত্রি‚ বশিষ্ঠ‚ পুলহ‚ অঙ্গীরা‚ পুলস্থ্য‚ মরীচি এবং ক্রতু (মতভেদ আছে)-কে মহাজ্ঞান প্রদান করেন।
অনেকে বলেন, আদিযোগীর ‘আদিগুরু’তে রূপান্তরিত হওয়ার এই ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে পনের হাজার বছর আগে। আবার কেউ কেউ বলেন এটি ঘটেছিল চল্লিশ বা ষাট হাজার বছরেরও আগেএবং তার থেকেই গুরুশিষ্য পরম্পরা যাত্রা শুরু করে। তিনি শিষ্যদের গুরুজ্ঞান দিয়ে, গুরু হয়ে উঠবার ধারা প্রবর্তন করেন।
জাগ্গুবাসুদেব সদগুরু বলেন, ‘প্রথম গুরুর জন্মের দিন হল গুরুপূর্ণিমা। যোগের সংস্কৃতিতে, শিবকে ভগবান মানা হয় না, তাকে আদি-যোগী বলে গণ্য করা হয়। সর্বপ্রথম যোগী। …এই দিনে, মানব ইতিহাসে প্রথমবার, মানুষকে এটা মনে করিয়ে দেওয়া হল যে তার জীবন পূর্ব-নির্দিষ্ট নয়।
যদি আপনি ইচ্ছুক হন পূর্ণ উদ্যমে প্রচেষ্টা করতে, সৃষ্টির প্রত্যেকটি দরজা উন্মুক্ত আপনার কাছে। এরকম একটা উন্নত ও অসামান্য ব্যাপার মানব ইতিহাসে প্রথমবার ঘটেছে, এটার উদযাপন করতেই গুরু পূর্ণিমা পালন করা হয়।
গুরু পূর্ণিমা এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর মধ্যে একটি ছিল। ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে এটি উদযাপন করা হতো। টাকা বা ঐশ্বর্য ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হতো না। সর্বোচ্চ মান ছিল জ্ঞান। আর সেই কারণেই গুরুর স্থান ছিল সর্বোপরি।’
আদিযোগীকে ঘিরে কাহিনীটি অনেকটা এরকম- হিমালয় থেকে নেমে আসলেন অজ্ঞাত এক যোগী। কোথায় তার জন্ম, কোথায় তার নিবাস, কি তার পরিচয় তা কেউ জানে না। তিনি অন্য যোগীদের মতো ছিলেন না। তার অদ্ভুত গতি-প্রকৃতি সবাইকে আকৃষ্ট করলো। লোকে ভিড় করে তাকে দেখতে আসলো।
সকলেই ভাবতে লাগলো এই যোগী নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটাবেন। তারা অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু সেই যোগী সকলকে হতাশ করলো। সে কিছুই করলো না। সে নিশ্চুপ হয়ে কেবল বসেই থাকলো। একেবারে স্থির হয়ে।
অপেক্ষা করতে করতে একসময় হতাশ হয়ে সকলে ফিরে গেলেও, সাতজন শেষ পর্যন্ত তার সামনে বসেই রইলো। এই সাত জন বুঝতে পারলো, এভাবে বসে থাকাই আসলে এক চমৎকারিত্ব। কারণ এটা তখনই সম্ভব যখন কেউ লৌকিকতার ঊর্দ্ধে অবস্থান করে।
তারা বিনীতভাবে যোগীর কাছে প্রার্থনা করলো- ‘আপনার কাছে নিশ্চয়ই এমন জ্ঞান আছে যা আমরা অনুভব করতে পারছি না। আমাদেরও সেই বিদ্যা দান করুন।’ একথা শুনে যোগী তাদের কিছু সাধন ক্রিয়া দিয়ে নিজেদের প্রস্তুত হতে বললো। সাতজন সেই সাধন শুরু করলো।
এভাবে দিন-মাস-বছর গড়িয়ে চুরাশি বছর শেষে তারা বুঝতে পারলো তারা জ্ঞান প্রাপ্তির জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তারা জানতে পারলো মানুষ সাধন বলে প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের ঊর্দ্ধে অবস্থান করতে পারে। আদিযোগী তাদের সেই শিক্ষার পদ্ধতি জানালেন।
এটাই গুরুভক্তির স্বরূপ। কারণ গুরুকে বোঝা শিষ্যের কর্ম নয়। গুরুর নির্দেশ ভক্তিভরে পালন করাই শিষ্যের কাজ। বাকিটা গুরু কৃপা। আর গুরুর প্রতি এই ভক্তিকে চির জাগরূক রাখতে আদিযোগীর ভক্ত-অনুসারীরা হাজার হাজার বছর ধরে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এই বিশেষ দিনে গুরুপূর্ণিমায় পালন করে আসছে।
নাম পরিচয় কিছুই প্রকাশ না করায় সাত যোগী তাকে আদিযোগী অর্থাৎ প্রথমগুরু নামে ডাকতে শুরু করলেন। আদিযোগী এই সপ্তঋষিকে ১১২টি পদ্ধতির কথা বললেন। এই জ্ঞানকে ১৬টি করে ৭ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ঋষিকে তা শিখালেন।
পরমের সান্নিধ্য লাভের ১৬টি করে উপায় এই সাত ঋষি শিখে নিলেন। চুরাশি বছরে তারা এই জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়ার পর আদিযোগী বললেন, এখন তোমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। তোমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে যেয়ে এই জ্ঞান প্রচার করো।
তারা যেতে উদ্যত হলে আদিযোগী বলে উঠলেন, আমার গুরুদক্ষিণা?
প্রকৃত অর্থে গুরুর দক্ষিণা নেয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু গুরু চান শিষ্য তার নিজের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি গুরুকে নিবেদন করে সমর্পনভাব জাগ্রত করুক।
সপ্তঋষি একথা শুনে বিচলিত হয়ে গেলো। কি বস্তু দান করা যায় আদিযোগীকে? শেষে অগস্ত্য মুনি বললেন, আমার কাছে আপনার উপহার দেয়া ১৬টি রত্ন আছে, তাই আপনার চরণে নিবেদন করছি।
৮৪ বছরের কঠিন সাধনায় যা অর্জন করেছিল তারা সকলেই তা গুরুর প্রতি নিবেদান করে শূন্য হয়ে গেলো।
তখন আদিযোগী বললো, তোমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
আর এটাই ছিল আদিযোগী শিবের অন্যতম শিক্ষা। শূন্য হয়ে যাওয়া। যা নেই তাই হয়ে যাওয়া। আর তা হতে পারলেই সেই পরম জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়।
তারা শূন্য হাতে পৃথিবীর পথে জ্ঞান বিতরণের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পরলো।
এটাই গুরুভক্তির স্বরূপ। কারণ গুরুকে বোঝা শিষ্যের কর্ম নয়। গুরুর নির্দেশ ভক্তিভরে পালন করাই শিষ্যের কাজ। বাকিটা গুরু কৃপা। আর গুরুর প্রতি এই ভক্তিকে চির জাগরূক রাখতে আদিযোগীর ভক্ত-অনুসারীরা হাজার হাজার বছর ধরে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এই বিশেষ দিনে গুরুপূর্ণিমায় পালন করে আসছে।
তিন
ইসলামে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নবুয়ত। যিনি স্রষ্টার সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং তাঁর থেকে প্রাপ্ত ঐশীবাণী দিয়ে মানব মুক্তির পথ দেখান তিনিই ইসলামে নবী নামে অভিহিত। আর নবীদের মধ্যে যাদের উপর পবিত্র শাস্ত্র প্রবর্তিত হয় তারা পরিচিত রাসুল নামে।
আরবে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে হজরত মোহাম্মদ (স)-এর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে ইসলামে নবী-রাসুলের আগমনের ধারা সমাপ্তি ঘটে। তিনিই ইসলামের শেষ নবী ও রাসুল। তাঁর দেহত্যাগের মধ্য দিয়ে নবুয়তের সফল সমাপ্তি ঘটে। সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার সরাসরি সংযোগ আড়ালে চলে যায়। উন্মুক্ত হয় নবীজীর সাথে সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের পথ।
সুফিবাদ মতে, নবীজীর দেহত্যাগের পর থেকেই যাত্রা শুরু করেছে বেলায়াত। অর্থাৎ স্রষ্টার সান্নিধ্যের জন্য নবীজীর সাথে সংযোগ স্থাপনের পথ। বেলায়াত অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব। যিনি বেলায়াত লাভ করেন তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন অলি হিসেবে। তিনি মাওলা নামেও পরিচিত।
গুরু রূপে তিনি শিষ্যকে বায়াত করে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অব্যাহত রাখেন। অলি অর্থ নিকটবর্তী বন্ধু, সাহার্যকারী, অভিভাবক, সংযোগ স্থাপনকারী ইত্যাদি। অর্থাৎ যিনি স্রষ্টার বন্ধুত্ব লাভ করেছেন।
৪৭১ হিজরীতে ইরানের অন্তর্গত জিলানের কাসপিয়ান সমুদ্র উপকূলের নাইদ নামক স্থানে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী জন্মগ্রহণ করেন। ৫২১ হিজরীর ১৬ শাওয়াল স্বপ্নযোগে তিনি নবীজীর কাছে থেকে ইসলাম প্রচারের নির্দেশনা পান। জীবদ্দশায় তিনি সেই নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
১১ রবিউসসানী ৫৬১ হিজরী তিনি দেহত্যাগ করলে ভক্ত অনুসারীরা তাঁর মতাদর্শে কাদেরিয়া তরিকা প্রবর্তন করেন। তরিকত বা তরিকা অর্থ রাস্তা বা পথ। আধ্যাত্মিক পরিভাষায় তরিকা হল বেলায়েতের জ্ঞান অর্জন করতে আল্লাহর অলিদের প্রবর্তিত বিভিন্ন সাধন পদ্ধতি।
কাদেরিয়া তরিকার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে বহু তরিকা আত্মপ্রকাশ করে এবং জগতে ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে প্রধান চারটি তরিকার পাশাপাশি আরো চারটি তরিকা ভারতীয় উপমহাদেশে গুরুত্ব বহন করে-
১. কাদেরিয়া তরিকা- প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাদির জিলানী।
২. চিশতিয়া তরিকা- প্রতিষ্ঠাতা খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি।
৩. নকশবন্দিয়া তরিকা- প্রতিষ্ঠাতা খাজা বাহাউদ্দিন।
৪. মুজাদ্দিদিয়া তরিকা- প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দী মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানি।
৫. সুহ্রাওয়ার্দিয়া তরিকা- প্রতিষ্ঠাতা শিহাব উদ্দ্বীন উমার সোহরাওয়ার্দীর।
৬. মাসুমিয়া তরিকা- প্রতিষ্ঠাতা খাজা মুহাম্মদ মাসুম আল-কাইয়্যুম।
৭. মাইজভান্ডারিয়া তরিকা- প্রতিষ্ঠাতা আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারি।
৮. ওয়াইসিয়া তরিকা- স্রষ্টা তার কোনো কোনো বান্দাকে সরাসরি ফয়েজ দান করে বেলায়েতের মর্যাদা দান করেন। এটাই পরিচিত ওয়াসিয়া তরিকা নামে।
সুফিবাদ বা তাসাউফ গুরুকে কেন্দ্র করে গঠিত। এই মতবাদে গুরুরা আনুসারীদের সঙ্গে নবীজীর সংযোগ বা সিলসিলা স্থাপন করার পথ দেখান। যতদূর জানা যায়, প্রাচীন ও আধুনিক সুফিদের অধিকাংশই ইসলামের সুন্নি ধারার অনুসারী। তবে মধ্যযুগের শেষভাগে ইসলামের শিয়া ধারাতেও সুফিবাদের বিকাশ ঘটে। সুফিরা কট্টর রীতিনীতির বিরোধী হলেও তারা ইসলামী আইন মেনে চলে।
কার্ল ডব্লিউ আর্নস্টের মতে, সুফিবাদের প্রাচীনতম ব্যক্তিত্ব স্বয়ং নবীজী এবং তার সাহাবীরা। সুফি তরিকাগুলোর ভিত্তি হল বায়াত (অঙ্গীকার/চুক্তি/শপথ); যা সাহাবীরা নবীজীর কাছে করতেন।
হিজরী পঞ্জিকা চন্দ্রবর্ষ হলেও সুফিবাদে গুরুপূর্ণিমা পালনের কোনো রীতির কথা জানা যায় না। তবে প্রতি নতুন চাঁদেই তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের রীতি প্রচলিত। এসময় গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে মেহফিল হয় সামাহ হয়। তাদের মধ্যে একসময় কাওয়ালী-গজল গানের ব্যাপক প্রচলন থাকলেও, পরবর্তীতে স্থানীয় বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-লালন গানেও ভাব-ভক্তির মিলন মেলা ঘটে।
সুফিবাদের বিশ্বাস, সুফিসাধকের কাছে বায়াত বা শপথ গ্রহণ মানে নবীজীর কাছেই আনুগত্যের শপথ করা। ফলে শিষ্য গুরুর সাথে, গুরু নবীজীর সাথে আর নবীজী স্রষ্টার সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এতে শিষ্য গুরু-শিষ্য পরম্পরায় স্রষ্টার সাথে সংযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়।
নবীজীর সঙ্গী বা সাহাবীদের মাঝে হজরত আলী ছিলেন প্রধান ব্যক্তি, যিনি সরাসরি নবীজীর কাছে বায়াত পাঠ করেন। সে কারণে সুফিসাধকরা আলীর মাধ্যমেই এই শপথকে বজায় রাখে। যেন নবীজী সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন ও তার সাথে সংযোগ স্থাপন সহজ হয়।
সুফিবাদ এ্যাবিয়ান অঞ্চল থেকে ভারতবর্ষে এসেছে এমন মত বহুল প্রচলিত থাকলেও। কোনো কোনো গবেষক বলেন মূলত ভারতবর্ষ থেকেই সুফিবাদের মূলতত্ত্ব ইরানে গিয়ে সেখানে তা বিকাশ লাভ করে। সুফিবাদের উদ্ভব যে অঞ্চলেই হোক না কেনো ভারতবর্ষের আধ্যাত্মচর্চায় সুফিবাদের ভূমিকাও ব্যাপক।
সুফিবাদে পীরের হাতে হাত রেখে বা পবিত্র গ্রন্থে বা পবিত্র বস্তুতে শপথ করে কিংবা সিলসিলার অগ্রবর্তী পীরের সমাধির সামনে গুরু শিষ্যকে বয়াত করেন। সিলাসিলা স্মরণ করে পরম ভক্তিতে গুরু শিষ্যকে যেমন নিজের করে নেন। তেমনি শিষ্যও গুরুর প্রতি সমর্পিত হয়।
ভারতবর্ষ জুড়ে অগনিত সুফিসাধকের আগমন যেমন ঘটেছে, তেমনি এ অঞ্চলেও বহু সুফি ধারার প্রবর্তন হয়েছে। সুফিবাদীরা সাধারণত আরবি হিজরী দিন-ক্ষণের হিসেবেই সকল গুরুকর্ম করে থাকে। তাদের কাছে নবীজীর জন্ম, নবুয়তলাভ, মহরম, সিলাসিলার প্রথমগুরু, নিজগুরু-দাদাগুরুর জন্ম-বয়াত-ওফাত-গুরু দিবস বিশেষ ভাবে পালন করে থাকে।
হিজরী পঞ্জিকা চন্দ্রবর্ষ হলেও সুফিবাদে গুরুপূর্ণিমা পালনের কোনো রীতির কথা জানা যায় না। তবে প্রতি নতুন চাঁদেই তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের রীতি প্রচলিত। এসময় গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে মেহফিল হয় সামাহ হয়। তাদের মধ্যে একসময় কাওয়ালী-গজল গানের ব্যাপক প্রচলন থাকলেও, পরবর্তীতে স্থানীয় বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-লালন গানেও ভাব-ভক্তির মিলন মেলা ঘটে।
শুধু বাংলা অঞ্চলই নয় সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে সুফি সাধকদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মাজার, রওজা, দরবার, খানকা শরীফ, ইবাদতখানা গুলো গুরু-শিষ্য পরম্পরার উজ্জ্বল নির্দশন। ভক্তরা এখানে পাক-পবিত্র হয়ে, সুগন্ধি ব্যবহার করে গুরুর প্রতি ভক্তি নিবেদনে মিলিত হয়।
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………….
আরো পড়ুন:
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তিন
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়
গুরুপূর্ণিমা
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com